বাংলাদেশ ইস্যুতে আজ বুধবারও উত্তাল ছিল কলকাতা। তবে গত দিনগুলোর মতো অতটা উগ্র ছিল না।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) কার্তিক মহারাজের নেতৃত্বে কলকাতাস্থি বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের স্মারকলিপি জমা দিলেন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এসময় তার সাথে ছিলেন সুবীর সান্যাল, মানিক পাল, চন্দ্রনাথ দাস, কুলনন্দ মহারাজ এবং প্রদীপ্ত মহারাজ।
পরে সাংবাদিকদের সামনে কার্তিক মহারাজ বলেছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
মানবিকতার প্রশ্নে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
তবে ত্রিপুরার ঘটনার পর কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আসবে। ফলে অতি তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল কলকাতা পুলিশের মধ্যে। মিশনের বাইরে কড়া নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছিল পুলিশ। চারদিক থেকে ঘিরে রাখা হয়েছিল মিশন।
ধারণা করা হচ্ছিল, সহস্রাধিক জমায়েত হবে। এর জেরে বড় কোনো প্রভাব পড়তে পারে। তবে বিকেল গড়াতেই তা ম্লান হয়ে যায়। কারণ ৬ জনের প্রতিনিধি ছাড়া সংগঠনের একজনও আসেননি। ফলে বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি কলকাতা বেগবান অঞ্চলে।
এর আগে গত ২৮ নভেম্বর ১৭টি হিন্দু সংগঠন একত্রিত হয়ে ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের ওপর হামলে পড়েছিল। তাদের ঠেকাতে রক্তাক্ত হন এক পুলিশ। এ সময় জ্বালানো হয় কুশপুত্তলিকা। পরদিনও ২৯ নভেম্বর মুসলিম রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) আরও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। তারা মিশনের গেট আগলে অবরোধ করেন। যার কারণে বেশ অনেকক্ষণ কেউ-ই মিশেনের বাইরে এবং ভেতরেও প্রবেশ করতে পারেনি। পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী ও সেই দলের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি আসায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে।
সেই ঘটনাগুলোর পরে এবং ঘটে যাওয়া ত্রিপুরায় সাম্প্রতিক ঘটনার পর এদিন আর তৎপর ছিল কলকাতা পুলিশ। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছিল কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন।
এদিকে বাংলাদেশ ইস্যুতে বুধবারও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে। এদিন বিকালে পূর্ব বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরের পথে নামেন আইনজীবীরা। দুর্গাপুর মহকুমা আদালতের আইনজীবীরা সিটি সেন্টার জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল করেন।
পাশাপাশি অপর একটি ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গণশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, সকল শ্রেণীর মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সেই দেশের সরকারের কর্তব্য। ইসলাম ধর্মের নামে কারোর ওপর আঘাত আনা পাপ।
একই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন দিল্লির জামে মসজিদের শাহী ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি। অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সুনাম অক্ষুণ্ন থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের একজন বিশ্বস্ত প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে আমি আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ইস্যুতে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেবেন। তাকে নিশ্চিত করতে হবে যে তার যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে সেটা যেন অমলিন থাকে।
বুখারি আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং প্রভাবশালী মহল বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা শেখ হাসিনা ওয়াজিদ এবং তাদের দল আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কূটনৈতিক বিষয়, আন্তর্জাতিক বিষয় এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে, বাংলাদেশও সবসময় ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদের সীমান্তে প্রাচীন ‘মিলন মেলা’ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও বিএসএফ। গত কয়েক দশক ধরেই কাঁটাতার মাঝে রেখে ৬ ডিসেম্বর মিলিত হন দুই দেশের মানুষ। সীমানার দুই প্রান্ত থেকে প্রিয়জনদের উপহার ছুড়ে দেওয়ার রীতিও রয়েছে।
ফলে বিগত বছরগুলোর মতো এবার আর দেখা হবে না ওপারের প্রিয়জনদের সঙ্গে। তবে মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মন বিষাদগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশে শান্তি ফেরানোর আর্জি জানাচ্ছেন স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অবিভক্ত বাংলায় দিনাজপুরের পীরগঞ্জে ওই অংশে পাথর কালীপুজোকে কেন্দ্র করে বসত মেলা। বর্তমানে সেই পাথর কালীপূজা বাংলাদেশের পীরগঞ্জে হয়ে থাকে। আর সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে প্রতি বছর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে হেমতাবাদ ব্লকের চৈনগর পঞ্চায়েতে বাংলাদেশ সীমান্তের এই মিলন মেলায় অংশ নেন দুই বাংলার মানুষ।
অন্যদিকে দুই দেশের সম্পর্কের আঁচ পড়েছে শিল্প জগতেও। বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে অনুষ্ঠান করতে দিতে নারাজ পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার মধ্যমগ্রাম নাগরিক সমাজের একাংশের। আগামী ২৮ ডিসেম্বর মধ্যমগ্রামের সুভাষ মেলা ময়দানে পরিবেশ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকার কথা ছিল রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার।
কিন্তু তার আগেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট করে মেলা কর্তৃপক্ষ মধ্যমগ্রাম পৌরসভার কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, বন্যা যাতে ওই অনুষ্ঠানে না আসেন। সেখানে লেখা হয় ‘একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মধ্যমগ্রাম পৌরসভার কাছে আবেদন জানাচ্ছি আগামী ২৮ ডিসেম্বর মধ্যমগ্রাম পরিবেশ মেলায় বাংলাদেশের শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান পরিবেশন অবিলম্বে ক্যানসেল করুন। বাংলাদেশের কোনো শিল্পীকে প্লিজ কোনো অনুষ্ঠান করতে দেবেন না। আগে দেশ তারপরে সব কিছু। বিষয়টি প্লিজ ভেবে দেখবেন। ’
আজকালের খবর/ এমকে