বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
সাহিত্যে স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি
এনাম রাজু
প্রকাশ: শনিবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪, ৪:২৬ PM
পৃথিবীর সমান বয়স নিয়ে শিল্পের উচ্চাসনে বসে আছে কবিতা। সে আসন থেকে ধারণ করে চলেছে পঙ্ক্তিমালা। তবে সে পঙ্ক্তিমালা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই আলোড়িত হবে কিনা, তার গতি নির্ধারণ সে করে না। এ নিয়ে বিতর্কের ডালপালাও তাই ছড়ায়নি আমাদের সাহিত্যাঙ্গানে। 

অনেকের কাছে সাহিত্য মানেই সত্য বলা, ভালোর পথে চলা। আর প্রতিটি সাহিত্যসাধক যেন এক একজন স্রষ্টা। যেহেতু সাহিত্যসাধককে পাঠকসমাজের অনেকাংশ সৃজনকর্তা মেনেই নিয়েছেন, তাই তারা এও মনে করেনÑ কবি-সাহিত্যিক সব সময় সুন্দরের পক্ষে। তবে কালে কালে সাহিত্যজগৎ বিশ্লেষণে নানা প্রশ্নও ভর করেছে আলোচনার গালিচায়। 

আমরা মনে করি, স্রষ্টা তোষামোদকারী নন। তিনি অহেতুক তোষামোদ পেতেও পছন্দ করেন না। যদিও গুণগান অন্য বিষয়। যার গুণ আছে, তার গান করাই যেতে পারে। তা সে ভালো গুণ কিংবা খারাপ। স্রষ্টা আসল রূপটিই তুলে ধরতে পছন্দ করেন। অথচ বর্তমান বাংলাসাহিত্যে প্রায়শই ভালোকে আলো আর খারাপকে আলোকিত করে তোলার প্রতিযোগিতাও দেখা যায়। কবিতার ছত্রে ছত্রে, পদ্যের ছন্দের ছন্দে, ছড়ার দুলুনীতেও মহান করে তোলা হয়। 

কখনো কখনো সাহিত্যিকদের ভয়ানক হিংসার উদোমনৃত্যও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। সাহিত্যে হিংসা ভালো। সে হিংসা প্রতিযোগিতার। নিজের লেখাকে আরও পরিশীলিত করার। ব্যক্তি অহমিকায় পড়ে আগেও খোচাখুচি করতে দেখা গেছে। তবে সেখানে লেখার শব্দই ছিল এক একটি অস্ত্র। বর্তমানে তা বিরল। সামাজিক নগ্নতার পাশাপশি তারা যেন খুলে চলেছে শব্দের শরীরের এক একটি পর্দা। যদিও এমন প্রয়াসে তেমন কোন শক্তি দেখি না। 

সকল সাহিত্যিকদেরই এক পাল্লায় মেপে যারা তাদেরকে পুজনীয় মনে করেন, তাদের কাতারে দাঁড়িয়ে একটিবার ভেবে নেওয়া যেতে পারেÑ সাহিত্যিকদের মনে কোনো গলদ নেই। ব্যক্তি বিশেষে হয়তো বোধের অভাব থাকতে পারে। এমন বোধ থেকে চলুন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে ঘুরে আসি। জীবনানন্দের মতো কবিকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত গ্রাম্য ও তৃতীয় শ্রেণির কবি ভাবতেন। 

এভাবেই যুগের পর যুগ কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যেও একটা স্বীকার ও অস্বীকারের দ্বন্দ্ব চলে এসেছে। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ ‘রফিক আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি পড়ে বলেছেনÑ রফিক আজাদের সমগ্র রচনায় আমি একটিও কবিতা পাইনি...। [কবির আত্মবিশ্বাস, পৃষ্ঠা ৫০-৫১] যদিও এখানে দ্বন্দ্ব ততোটা স্পষ্ট না হলেও আলোচনা আক্রমণাত্মক।

কাব্যাঙ্গনে দল ভারি করার বিষয়টিও স্বচ্ছ কাচের মতোন ফুটে উঠেছে। বিশেষ সুবিধা পেতে কখনো কখনো এমন কর্ম করেছেন, এমনকি এখনো করছেন বরেণ্যরা। ‘করতলে মহাদেশ, (দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২০৭-২০৮) গ্রন্থে একটি লেখাকে কবিতা বলে চালিয়ে দিলেন। সেই কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে একজন শব্দকারকে কবি হিসাবে দিলেন স্বীকৃতি। এমন স্বীকার-অস্বীকার, স্বীকৃতি-খেতাবের দোলাচলে ফুলে উঠতে দেখা গেছে করপোরেট কবিদেরও। আর এখন তো বলাই বাহুল্য। 

এই যে সাহিত্যের ভেতর-বাহিরের এত স্বজন-প্রীতি, ভালোলাগা-মন্দলাগা বোধকরি সমকালীন সব লেখকই তা জানতেন। আর বর্তমানের অবস্থা এ অঙ্গনের সবাই জানেন। কিন্তু অধিকাংশের মুখ কুলুপ আঁটা। কলম নিরব। এসবের পেছনে লেগে থাকে অদৃশ্য স্বার্থ। সেই স্বার্থ হাসিলের অপেক্ষায় চলছে এবং চলেছে এমন মৌনতা।

বিশেষ করে, তরুণ লেখকদের মধ্যে অসুস্থ প্রবণতা ভর করেছে বেশি। এসব তরুণদের পথভ্রষ্ট হওয়ার পেছনে সমকালের প্রধান লেখকরাই দায়ী। তাইতো দেশের উত্তরবঙ্গ যখন বন্যায় ভেসে যায়, গাছে মাচা তৈরি করে সাপের সঙ্গে এক বিছানায় থাকে, জলখাবারটিও জোটে না, দিগন্ত চিড়ে কোন একটি নৌকাভর্তি হয়ে তাদের জন্য খাবার আসবে ভেবে পিটপিট চোখে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধা, তখন ওই সব ধ্বজাধারী তরুণ কবিদের কেউ কেউ  লেখেন, ‘ওগো প্রিয়া তুমি খুলে দাও হৃদয়ের দরজা।’ 

‘শিল্পের সকল শাখার প্রধান এবং মাতা হলো কবিতা।’ কবি ও সার্থক কবিতা একটি গোষ্ঠী বা একটি ভাষার করিডোরে আটকে থাকে না। তা সমগ্র মানবজাতির জন্য বিবেচিত এবং আয়নাস্বরূপ। এই কবিতার স্রষ্টারা, বিশেষ করে বাংলার অঙ্গনে প্রধান প্রধান কবিদের বেশির ভাগই একজন আরেকজনকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রযুগে তা প্রকট আকার ধারন করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কম জল ঘোলা হয়নি। তিনিও অন্যকে নিয়ে বলতে কম ছাড়েননি। সেই সময়ে বিশ্বকবিকে নিয়ে এমন মন্তব্যও শোনা যায়, ‘কলিকাতার চাকমা মহলে তিনি ঋষি হইতে পারেন, কিন্তু বাংলার শিক্ষিত সমাজে তাঁহার প্রভাব বড়োই কম।’ কেউ কেউ তো রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে অস্বীকারও করেছিলেন। শুধুই গোষ্ঠীগত ও ঈর্ষার কারণে এসব ঘটেছে। তারই ধারাবাহিকতা যুগের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বর্তমান। 

কবি রবীন্দ্রনাথের যে কবিতাই হয় না, সেকথা বাংলাসাহিত্যে আজও ভেসে বেড়ায়। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের মতে, তার কবিতা না কাব্য না কবিতা, ‘কেবল কাব্যিক’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে ছোট করতে পিছপা হয়নি। এমনকি কবি কাজী নজরুল ইসলামের দারিদ্র নিয়েও আঘাত করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথের সেই কথায় খুবই দুঃখ পেয়েছেন। নজরুলকে নিয়ে কটাক্ষ ও বিদ্রুপ করার ক্ষেত্রে সম্ভবত সজনীকান্ত দাস সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রুপ করার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন নজরুলের কবিতা ও গান। তিনি নজরুলের অসংখ্য কবিতা ও গান প্যারোডি করেছেন। এমনকি নজরুল সম্পর্কে  এবং তার সমসাময়িক সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কাছে পত্র লিখেছেন। সেখানে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম ও তার সমসাময়িক কবিদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন। 

রাজরাজাদের আমল ছিল কাব্যিক তোষামদগার। যোগ্য লেখক না হয়েও কেবলি গুণকীর্তন ও তোষামোদীর কারণে অনেকেই সভাকবি হয়েছেন। মিলেছে পদক, খ্যাতি। বাংলাসাহিত্যের বর্তমান সময়ও কম যায় না। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে একজন কবি তো একটি দলের বলেই দিয়েছেন ঘোষণা। আবার চেয়েও নিয়েছেন পদক। অন্যদিকে গোষ্ঠীগত কারণে অনেক বড় বড় কবি হারিয়েছেন কালের গভীরে। তাদের কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছতে দেওয়া হয়নি। ভাগ্যে জোটেনি পদক-পুরস্কার। আর এখন তো  মিডিয়ার দখলদারিত্ব। কবি বানানোর মেশিন হয়ে উঠেছে এগুলো। রাতারাতি কবিকে অকবি আর অকবিকে কবি স্বীকৃতি দেওয়ায় ব্যস্ত তারা।  

কবি ও কবিতা নিয়ে আদিমযুগ থেকে আজ অবধি বিরূপ আলোচনার শেষ নেই। তাই হয়তো প্লেটোর মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব তার রিপাবলিক থেকে কবিদের দূরে রেখেছিলেন। অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন, কবিরা মিথ্যাচরণ করে। যদিও কবিরা মিথ্যাচার করে না, করতেই পারে না বলে আমি আজও বিশ্বাস রাখি। তারা করে, যারা কবি সাজতে ব্যস্ত।

বিভিন্ন যুদ্ধে, দেশের সামগ্রিক স্বার্থে পক্ষপাত করেছেন কবিরা। এটা তাদের নৈতিক অবস্থান ছিল। কিন্তু যুদ্ধ যেহেতু বিজয়ীর কথা বলে। তাই যেসব কবিগণ পরাজিতের পক্ষে যুদ্ধচলাকালীন শব্দবাণ সৃষ্টিতে ব্যস্ত ছিলেন, তাদেরকে বিষবাষ্পের সামনে পড়তেই হয়েছে। আজীবন কষ্ট পেতে হয়েছে। সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে ওই কবিকে মিথ্যাবাদী বলা বা দোষ দেওয়া যৌক্তিক নয়। 

পরিশেষে বলতে চাই, কবি ও কবিতা নিয়ে যতই বিদ্রুপ ও মাদকতা ছড়াক না কেন, কবিতা সমাজের আয়না। তাই এ যুগে এসেও যদি কবি ও সাহিত্যিকরা লোভী ও দলবাজি করে, নিজেকে সাহিত্যের জগতে ডন হিসেবে অন্যের কাছে পরিচয় দেন, কিংবা সাহিত্যকে পুঁজি করে অন্যের কণ্ঠরোধ করতে চেষ্টা করেন, সেটা হবে বোকামি। আবার এ বোকামি দেখে আশ্চর্য বা বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই বোকারা না হতে পারবেন বক, না হতে পারবেন মাছরাঙা। বরং কাক হয়েই সাহিত্যজগতে বিচরণ করবেন। অতীতেও এমন কাকের সংখ্যা কম ছিল না। তাইতো কবি জীবনানন্দ বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ আর কবি সৈয়দ সাজু বলেছেন, ‘কাউকে কবি বলার আগে, তার কবিত্ব যাচাই করে নিতে হয়।’ 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
জাতীয় দিবস উদযাপন ও নীতি নির্ধারণে ইবির স্ট্যান্ডিং কমিটি পুনর্গঠন
গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র ছাড়া এই সরকার বেআইনি ও অবৈধ : ফরহাদ মজহার
তারেক রহমান বরাবর জাবি ছাত্রদলের পদবঞ্চিতদের স্মারকলিপি প্রদান
কসবায় ভাইয়ের হাতে ভাই খুন
গবাদিপশুর স্বল্পমূল্যের ম্যাসটাইটিস টিকা উদ্ভাবন করলেন বাকৃবির অধ্যাপক
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
গাজীপুর প্রেসক্লাবের বার্ষিক ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠিত
একে একে সবাইকে ধরা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
তাড়াশে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মহিলা মেম্বারকে মারধরের অভিযোগ
প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিলো চার কমিশন
নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য: জাকারবার্গকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান ভারতের
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft