বাংলাদেশের হাজার বছরের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিশাল অংশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোক সাহিত্যের একটি বড় অংশ লোকমুখে সচরাচর ব্যবহৃত হলেও অনাদর অবহেলায় যেন কালের গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের অবহেলায় দিন দিন হারিয়ে গেছে কত অমূল্য লোকজ সাহিত্য, শিল্প সম্ভার। সে সব পুনরুদ্ধারের জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকুল প্রচেষ্টায় যে কজন লোকশিল্প ও লোকসাহিত্যের নিবেদিত প্রাণ অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ তাদের অন্যতম ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। অপরিমেয় শ্রম, মেধা ও মননশীলতায় বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে ঘুরে ঘুরে দীনেশ চন্দ্র সেন উদ্ধার করে এনে জড়ো করেছেন লোকসাহিত্যের যত অমূল্য সম্পদ । ড. দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন শিক্ষাবিদ, গবেষক, লোক-সাহিত্যবিশারদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার। দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জগন্নাথ স্কুল থেকে এনট্রান্স (১৮৮২), ঢাকা কলেজ থেকে এফএ (১৮৮৫) পাস করেন। ১৮৮৯ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন সিলেটের হবিগঞ্জ স্কুলে (১৮৮৭)। পরে কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন (১৮৮৯) ও ভিক্টোরিয়া স্কুলের (১৮৯০) প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। ১৮৯০-এ কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুথি সংগ্রহ করেন এবং সেসব উপকরণের সাহায্যে ১৮৯৬-এ ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ শিরোনামে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেন। গ্রামের তথাকথিত পিছিয়ে থাকা নিরক্ষর মানুষদের ভেতরেও যে সাহিত্যের ধারা বয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে বাংলার মূল ধারার সাহিত্যের পরিচয় ঘটান তিনি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রত্যেকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন দীনেশচন্দ্রকে।
লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ সাহিত্যে দীনেশচন্দ্র সেনের অবদানের বিষয়ে বলেন, ‘বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অবদান রয়েছে-এই সত্য দীনেশচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। আধুনিকতা-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে মুসলমান গ্রামীণ কবিদের সাহিত্যকর্মকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছেন দীনেশচন্দ্র। এ জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ তার কাছে ঋণী। তার সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলে ও তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।’
দীনেশচন্দ্র সেনকে বাঙালি মনে রেখেছে তার বিপুল সংগ্রহ, সৃষ্টির মহত্ত্বে ও মহিমার জন্য। বিশেষভাবে তার অমর সৃষ্টি ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ (১৮৯৬) যা ভাষা ও সাহিত্যের যথাযথ ইতিবৃত্ত। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বাঙালির জীবনে আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের আবির্ভাব এক পরম গৌরবের বিষয়। বাংলা সাহিত্য ইতিহাস রচনা যজ্ঞের তিনিই যথার্থ অর্থে আদি পুরোহিত। বাংলার অবহেলিত উপেক্ষিত লোক সাহিত্যকে প্রাণের টানে হৃদয়ের গভীরে শ্রদ্ধায় প্রতিষ্ঠিত করে বাংলার ঘরে ঘরে তার রসপ্রবাহকে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রবাদ প্রতিম গীতিকা সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে দীনেশ চন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বলেছেন, আমি শক্তিহীনের মতো যতদিন বাঁচিয়া থাকিব, ততদিন গ্রীকে ভাস্করাচার্য ফিডিয়াসের মতো স্মৃতি মনোমন্দিরে পূজা করিব।
বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে দীনেশ চন্দ্র দেখা দিয়েছেন রাজার মতো। রবীন্দ্রনাথের পর দীনেশ চন্দ্র সেনই প্রথম ব্যক্তি যিনি অদম্য চেষ্টা ও আন্তরিকতায় লোকসাহিত্যেও বিলুপ্ত অধ্যায় আবিস্কার করেন। বাংলার লোকসাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি অদম্য প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। ‘মৈয়মনসিংহ গীতিকা’ প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যা নামে মুদ্রিত হয় ১৯২৩ খ্রীস্টাব্দে। প্রথম খণ্ডের উল্লেখযোগ্য গীতিকাগুলি হলো-মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, কঙ্ক ও লীলা প্রভৃতি। পূর্ববঙ্গ গীতিকার দ্বিতীয় খণ্ডে, দ্বিতীয় সংখ্যায় চৌদ্দ খানা গীতিকা স্থান পেয়েছে। তারমধ্যে-ধোপার পাট, মইষাল বন্ধু, কাঞ্চন মালা, ভেলুয়া উল্লেখযোগ্য। পূর্ববঙ্গ গীতিকার তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডে মঞ্জুর মা, ভেলুয়া হাতীখেদা, আয়না বিবি, শীলা দেবী, মুকুট রায়, জিরালনী প্রভৃতি গীতিকার নাম উল্লেখযোগ্য। মৈমনসিংহ গীতিকায় স্থান করে নেওয়া পালাগুলো উদ্ধারে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে চষে বেড়িয়েছেন। আজও লোকমুখে শুনা যায় প্রত্যন্ত পল্লী-গ্রাম মস্কা, গোরালীর মতো কত গ্রামে তিনি তার গবেষণা কর্মের তাবু ফেলেছিলেন। লোকমুখে যে গীতিকার কাহিনীগুলো প্রচলিত ছিল তা তিনি ধৈর্য সহকারে শুনে শুনে বাণীবদ্ধ অতপর লিপিবদ্ধ করে পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিলেন। এ সমস্ত পাণ্ডুলিপি ছাপার আগে বারে বারে সথকের (পরিবেশনকারী শিল্পী) বয়ানের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে অবিকৃতভাবে গ্রন্থগত করা হয়েছিল। তাতে যতিও মাত্রা চিহ্ন ব্যবহারে দীনেশ চন্দ্র সেনের মুন্সিআনা রয়েছে। একাধিক গায়ক এই গীতিকাগুলো পরিবেশন করতেন বলে তাদের নিয়েও তিনি পাণ্ডুলিপি রচনার পূর্বে সমন্বয় করেছিলেন এবং পূর্ণ অবয়বদান করে চূড়ান্ত সফলতা লাভ করতে পেরেছিলেন। ড. দীনেশচন্দ্রের লেখা ‘মৈমনসিংহ গীতিকা (পূর্ব বঙ্গ গীতিকা) এক অপূর্ব শিল্প সমৃদ্ধ গ্রন্থ। চার খণ্ডে প্রকাশিত পুস্তকটি বাংলা লোক সাহিত্যের লোক উপাচারের অনন্য সম্ভার হিসেবে প্রত্যেক সাহিত্য প্রেমিককে আকর্ষণ করে। দীনেশ চন্দ্র বলেছেন, মৈমনসিংহ গীতিকার আমরা বাংলা ভাষায় স্বরূপটি পাইতেছি।
দীনেশ চন্দ্র সেন একদিকে ছিলেন লোকসাহিত্যের এক অভুতপূর্ব শিল্প লেখক অন্যদিকে এক অক্লান্ত সংগ্রাহক। তিনি জানতেন সেই শিক্ষিতেরা (শিক্ষিত যুবক) লোকসাহিত্য সংগ্রহ কার্যে নানাক্রটি-বিচ্যুতি করবে। কেননা লোক সাহিত্য গ্রামীণ কিংবা আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। গুরুগম্ভীর ভাষা গ্রামীণ সমাজে অনেকটা দুর্ভেদ্য। পান্ডিত্যপূর্ণ ভাষা এখানে অনেকটা অচল। দীনেশ চন্দ্র সেন সেইটুকু অনুভব করতে পেরেছিলেন। ‘অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত লোকেরা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষা বুঝেন না। কিন্তু তাহাদের অন্তরেও আনন্দ, বেদনা, প্রেম, বিরহ, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি ভাবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, উচ্ছ্বাস বয়ে যায়। আনন্দ এবং দুঃখের আতিশয্যে কথায় সুব আসে, সেই সুরই গান ও বেদ, রাগ-বাগিনীতে ভরিয়াছিল।’
তাই তিনি নিরক্ষর চাষা, অর্ধ শিক্ষিত ভদ্রলোক যারা লোকগানের সমঝদার, তারাই এই কার্যের উপযুক্ত বলে ধারণা যেমন করেছিলেন তেমনিভাবে তা সঠিক বলে বিবেচিত হয়েছিল। আচার্য্য দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা লোকসাহিত্য চর্চার প্রবাদ পুরুষ। তার অদম্য সাহস, মনোবল আর প্রতিভা অনন্য ও অসাধারণ। তার বিদ্যাচর্চা বিলাস নয়, প্রাণের গভীর টান, জীবনের মহৎ তৃষ্ণা, মহাকালের সোনার তরীতে সোনার ধান তুলে দেওয়ার সৌভাগ্য সকলের হয় না।
যাদের হয় তারা পৃথিবীর মায়ের অমর সন্তান। দীনেশ চন্দ্র সেন পৃথিবী মায়ের সেই অমর সন্তান, অমৃতের পুত্র। কবির ভাষায়- এ পৃথিবী একবারই পায় তারে পায় নাকো আর। দীনেশচন্দ্র সেন যুগবিভাজন করে তার ভাবনা ও বক্তব্যকে সুপরিস্ফুট করেছেন। বিস্মিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য বলিয়া এত বড়ো একটা ব্যাপার আছে তাহা আমরা জানিতাম না।
বলা বাহুল্য দীনেশচন্দ্র অনেক বই লিখলেও ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ই তার বিজয় বৈজয়ন্তী। পরবর্তীকালে সে পথের পথিক হয়েছিলেন বহু কৃতবিদ্য ব্যক্তি। বাংলাদেশের কৃতবিদ্য লোক সাহিত্যিক ড. আশরাফ ছিদ্দিকী দীনেশ চন্দ্র সেনের কর্মে প্রাণিত হয়ে সারা বাংলা জুড়ে লোক শিল্পের নানা উপাদান আজও সংগ্রহ করে লোক সাহিত্যের ভূমি উর্বর করে চলেছেন।
‘ঘরের কথা’ ও ‘যুগসাহিত্য’ গ্রন্থপাঠে আমরা জানতে পারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রবেশ সহজ ও সুগম ছিল না। ঈর্ষাতুর, হীনমন্য বহু ব্যক্তির কুৎসা ও বিরোধিতা তাকে বারে বারে বিব্রত করে তুলেছিল। তবে তিনি সৌভাগ্য বলে পাশে পেয়েছিলেন গুণধর ও প্রজ্ঞাবান প্রণোদনাকারী স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে।
ফলে পঠন-পাঠন-সাহিত্য রচনা সবই ঘুর্ণাবর্তে দিশাহারা। এমন প্রতিকূল পরিবেশে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের শ্রমনিষ্ঠা, সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যপ্রীতি আমাদের প্রেরণা ও আশ্রয় বলেই মনে করি। দেশের জেলায় জেলায় নতুন নতুন লোকসাহিত্যের উপাদান আজও উদ্ধার হচ্ছে। সেই যাত্রার অগ্রদূত ড. দীনেশ চন্দ্র সেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিছু লোক উপাদান লোক নির্যাস সংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন এবং তাতে বেশ চমৎকৃতও হযে সম্ভাবনা আর উপযোগীতার অনুভব করেছিলেন। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বহু প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। ত্রিপুরা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ থেকে তিনি প্রচুর পুঁথি সংগ্রহ করেন। এই সংগ্রহ কার্যে লিপ্ত হয়ে দীনেশ চন্দ্রকে বহুবার অনিদ্রা অনাহারকে পথের সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে ছিলেন।
পুঁথি সংগ্রহের ফলে দীনেশ চন্দ্র ১৫০-এর অধিক মনসা দেবীর ভাসান গানের সন্ধান পেয়েছিলেন। সেখান হতে ২২ কবির মনসা মঙ্গল পুঁথির চাঁদ সওদাগর, বেহুলা, সওদাগরের, দয়ার, নাচারী, ত্রিপদী ছন্দে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আখ্যান তারই শ্রমসাধ্য ফসল। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন ‘রামায়ণী কথা’, ‘বেহুলা’, ‘জড় ভরত’, ‘ধরা দ্রোন’ ও ‘কশধ্বজ’, ‘সুকথা’ ইত্যাদির মত বহু মূল্যবান লোক সাহিত্যের উপাদান সমৃদ্ধ পুস্তুক আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। তার লেখা ‘বৃহৎ বঙ্গ’ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রচনা। এই গ্রন্থটিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত সময় কালের সমাজও রাষ্ট্রীয় জীবন, লোক শিল্প, লোক সাহিত্যের হরেক রকম উপাচার। লিখিত বিশাল সংগ্রাম-যা প্রতিটি মানব হৃদয়কে অনায়াসেই আকর্ষণ করতে পারে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় বৃহৎবঙ্গ, কাজে কাজে দীনেশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ একে অপরের খুব কাছাকাছি এসে পড়েন। দীনেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিকাশ সাধনাকে যেমন সম্মান দিয়েছিলেন, ঠিক রবীন্দ্রনাথও দীনেশ চন্দ্রের প্রতিটি রচনাকে শিল্প ও সাহিত্যের অনুসঙ্গে অপূর্ব সম্পদ বলে স্বীকার করেছেন। ১৯১১ সালে দীনেশ চন্দ্রের লেখা ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ ইংরেজিতে প্রকাশিত হলে পাশ্চাত্যের বহু মনীষীর কাছ থেকে তিনি ভুঁয়সী প্রশংসা লাভ করেন। এই পুস্তকখানি সেই সময় তাকে মুকুটহীন সম্রাটের সম্মান এনে দেয়। পাশ্চাত্য সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র সেনাটি, রিচ, ডেভিস, বারনেট, ব্যারন এবং বার্গ প্রমুখ বিখ্যাত ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের কাছে ব্যাপকভাবে তিনি সমাদৃত হন।
আজকালের খবর/আরইউ