গত ৫ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে এই জয় পান। ট্রাম্প ২০১৬ সালে যখন প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তখনো ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়েছিলেন। দুইবারই তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দুজন নারী এবং উভয়েই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী।
তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে গিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পুরুষ প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে (বর্তমান প্রেসিডেন্ট)। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছ থেকে ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্ববাসী অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে এই নির্বাচনটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আসছে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মোড়লগিরি’ করার অভ্যাস রয়েছে।
তবে ‘অর্থনৈতিক’ স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার অর্থেই যে সেসব করা হয় তা নয়, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’ দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণের বিস্তার ঘটানোর উদ্দেশ্যেও করা হয়ে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হওয়ার ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়াস যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো মানবিক, কখনো আবার অমানবিক করে তোলে। তাইতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সে কখনো কোনো রাষ্ট্রের ত্রাণকর্তা হিসেবে এগিয়ে যায় আবার কখনো কোনো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার প্রয়াসে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলে। ফলে কেউ উচ্ছ্বসিত হয় আবার কারো কপালে উদ্বেগের ভাঁজ পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে চলতে পারা যেকোনো রাষ্ট্রের, বিশেষ করে কোনো ছোট রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না, সে কথা সবাই জানে। আর সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোন পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়, তা বিশ্বের প্রতিটি দেশ এবং জনগণ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সাধারণত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে তেমন বড়সড় পরিবর্তন না ঘটলেও ক্ষমতায় দলের পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু বিষয়ে-ক্ষেত্রে নীতির পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আর এসবের অনেকটাই হয়ে থাকে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির আলোকে বা দলীয় আদর্শ বিবেচনায়।
নির্বাচনের আগে ও পরে ট্রাম্প প্রশাসন কী রকম হবে বা বৈদেশিক ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কোথায় দাঁড়াবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে যেমন আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তেমনি বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল অর্থনীতি, অভিবাসন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু ইত্যাদি। তাই নির্বাচনে জয়ের পরদিন ট্রাম্প বলেন, ‘আমি একটি সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করব। সেটি হলো যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, সেগুলো প্রতিপালন করা। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করব।’ অন্যদিকে তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোতে যেমন দেখা যাবে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সব ক্ষেত্রেই ওই নীতি প্রাধান্য পেতে পারে। অনেকেই মনে করে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি যেসব নীতি অনুসরণ করেছিলেন, অনেক ক্ষেত্রে সেসবের পুনরাবৃত্তিও ঘটতে পারে।
ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলমান যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করেছেন। তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার লড়াই বন্ধ করার উদ্যোগ নেবেন। দুটি দেশকেই তিনি অবিলম্বে স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর জন্য আহ্বান জানাতে পারেন। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থ এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে উভয় পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি করাতে পারলে সেটি শুধু ট্রাম্পের নির্বাচনী অঙ্গীকারের বাস্তবায়নই হবে না, শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবে। তবে এ ক্ষেত্রে ন্যাটো সদস্যদের নিয়ে তাকে বসতে হবে এবং যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনে যেহেতু তিনি যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করেছেন এবং সে আলোকে এরই মধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানিয়েছেন, তাই আশা করা যায় যে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের চলমান ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ হবে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে তার যে আন্তরিকতা, সেটি ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে না-ও দেখা যেতে পারে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদিবলয়ে থাকা দেশগুলোর (জিসিসি) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করার অভিপ্রায় পূরণের জন্য ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসায় পৌঁছানো প্রয়োজন বলে মনে হয়। যেমনটি নেতানিয়াহুর উদ্দেশে ট্রাম্প বলেছেন, ‘এসব শেষ করেন। লড়াই বন্ধ করেন এবং শর্তে আসুন।’ কিন্তু তার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, তিনি কি ইসরায়েলকে সম্মত করাতে পারবেন? পারলে তাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা হবে কি? অন্যদিকে লেবাননেও যুদ্ধ বন্ধ করতে তিনি উদ্যোগ নিতে পারেন। আমরাও তার এই অঙ্গীকার এবং ইচ্ছার আশু বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করি।
নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বাস করা অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করার কথা বলেছেন। গত মেয়াদেও তিনি এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। এমনকি সে সময় মেক্সিকো সীমান্তে যে প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেছিলেন, সেটি শেষ করার অঙ্গীকারও এবার করেছেন। তবে তিনি আগেও বিষয়টির বাস্তবতা অনুধাবন করেছেন এবং এবারো তাকে তা করতে হবে। আর সেই বাস্তবতা হলো এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, সেটি অনুধাবন ও নির্ধারণ করা। কারণ এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ুক, সেটি নিশ্চয়ই তিনি চাইবেন না। বিষয়টিতে তিনি হয়তো একটি সহনীয় এবং গ্রহণযোগ্য পথ বেছে নিতে পারেন। তা ছাড়া সব অবৈধ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়া খুব একটি সহজ কাজও হবে না। তাই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গেলে এ ক্ষেত্রে তাকে বেশ কিছুটা ছাড় দিতে হতেই পারে।
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য অনেকগুলো সমীকরণ কাজ করে থাকে। এর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তেমন একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কারণ ট্রাম্প তার দেশে যাওয়া চীনা পণ্যের ওপর যদি শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করেন (যেমনটি তিনি এরই মধ্যে ইঙ্গিত করেছেন), তাহলে বিষয়টি দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করবে। সর্বোপরি চীনা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের মানুষের ওপর যে অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়বে, সে বিষয়টিও তাকে ভাবতে হবে। অন্যদিকে তাইওয়ান প্রসঙ্গ নিয়েও চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে যে পথ অনুসরণ করেছেন, ট্রাম্প হয়তো কমবেশি সেভাবেই সম্পর্ক চালিয়ে যাবেন। শুধু দক্ষিণ কোরিয়াকে শঙ্কামুক্ত রাখার জন্যই নয়, চীনা প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য উত্তর কোরিয়ার প্রতি তার নজর দেওয়ার আভাসও পাওয়া যায়। অর্থাৎ চীনাবলয় থেকে কিছু দেশকে কীভাবে নিজের দিকে টানা যায়, সে প্রচেষ্টা যে তিনি অব্যাহত রাখবেন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে সাফল্য কতটুকু আসবে, তা সময়ই বলে দেবে।
ট্রাম্প এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তার বন্ধুত্বের বার্তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার ইচ্ছা তার রয়েছে। তবে ইদানীং ভারত ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের যে উন্নতি লক্ষ করা যায়, তা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, সেটিও ভাবার বিষয়। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী সম্পর্কের সমীকরণ নির্ণয়ে ভূমিকা রাখবে কিনা সে প্রশ্নটিও রয়ে যায়। যা হোক, এ ক্ষেত্রে ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষভাবে প্রভাবিত না করে, তাহলে সম্পর্ক যেমন আছে সে ধারায়ই চলবে, খুব একটা হেরফের হবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা দেখার জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। ইরান প্রসঙ্গে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি তার প্রথম মেয়াদের মতোই থাকবে বলে মনে হয়। তবে ইরানের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের যে উন্নতি হয়েছে এবং ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যতে সম্পর্ক আরো শক্তিশালী করার যে চিন্তা-ভাবনা রয়েছে, সেসব বিচার করলে বলা যায় না যুক্তরাষ্ট্র ইরানের প্রতি নমনীয় হয়েও উঠতে পারে।
নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয়, উভয় প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একজন মানবিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রকে একটি মানবিক দেশ হিসেবে পেতে চাই। ট্রাম্প বিশ্ব থেকে যুদ্ধ চিরতরে বন্ধ করার যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন, তার প্রতি বিশ্বের সব শান্তিকামী মানুষের পূর্ণ সমর্থন থাকবে বলেই বিশ্বাস। বিশ্বের যেখানে যে সমস্যারই উদ্ভব হোক না কেন, আমরা কোনো যুদ্ধ বা ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে চাই না, শুধুই শান্তি চাই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরকারের কাছে সেই প্রত্যাশাই রইল।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব।
আজকালের খবর/আরইউ