শহরে মহানগরে সত্যিই নিজেকে আবিষ্কার করার মতো একটি বই। গল্প শুধু গল্প নয়। এ যে জীবন সমাজ সংসারের বাস্তবতার রূপরেখা।
বইটি যতই পড়ছি ততই ভাবিয়েছে আমাকে। গল্পগুলো আমাদের, গল্পগুলো সমাজ বাস্তবতার চালচিত্র। হালচালের সমসাময়িক তথা সমস্ত কালের ঘটনা। মনস্তাত্ত্বিক রকমসকমের প্যাচানো জটিল এক মিথস্ক্রিয়ার নির্যাসমিশ্রিত মধু এমনকি টক-ঝাল-মিষ্টির এক অপূর্ব রসায়ন। গল্পকার যেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়েছেন; বাস্তব-কল্পনার জগতকে আলো-আঁধারির মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে ডুবিয়েছেন, আবার কখনো ভাসিয়েছেন। পাঠককে গল্পগুলো পাঠ করার সময় গল্পের সাগরে ডুবতে হবে; আবার সাঁতারও কাটতে হবে। নইলে মিস করবেন অনন্য গল্পের কাহিনী। বলা যেতে পারে গল্পগুলো হৃদয়কে ঝালাই করার, হৃদয়কে পোক্ত করার, শাণিত করার এক মোক্ষম হাতিয়ার। বইটি আশাতীত পাঠকপ্রিয়তা পাবে আশাবাদী। ‘শহরে মহানগরে’র গল্পগুলো আমাকে বিস্তর ভাবিয়েছে। ছোটগল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথকে খুব মনে পড়ছিল গল্পগ্রন্থটি পড়ার সময়। ছোটগল্পের রাজা রবীন্দ্রনাথ তবে শহরে মহানগরের গল্পকারও কম নয়। বইটির গল্পগুলোর মধ্যে শুরু থেকে শেষাবধি চরম নাটকীয়তা রয়েছে। গল্পকারের সার্থকতা এখানে।
গল্পকার ফারুক আহমেদের জন্ম ২২ অক্টোবর ১৯৭৯। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। সাহিত্য সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ২০ বছর। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। যুগান্তর, সমকাল, ইত্তেফাক, সকালের খবর, বাংলানিউজ২৪.কম, বণিক বার্তা প্রভৃতি সংবাদমাধ্যম ঘিরে পেশাজীবন আবর্তিত।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ চারটি: কয়েকজন দীর্ঘশ্বাস ২০০৭, অবজ্ঞাফল আবেগসকল বিবিধ ২০১৩, মন এইভাবে স্থির করা আছে ২০১৪, উপমাজংশন ২০২০। উপন্যাস : ঘূর্ণির ভেতর জীবন, শিশুতোষ: গল্পগুলো সবুজ, মেঘেদের মাঠে গহীন ইত্যাদি প্রকাশিত গদ্য। বর্তমানে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ সাহিত্য সম্পাদক (সহকারী সম্পাদক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শহরে মহানগরে বইটিতে নয়টি গল্প রয়েছে। অর্পার আশ্চর্য ডানা গল্পে নারী এক আশ্চর্যের নাম। অকপটে বলা যায়, অসম্ভব রকমের রহস্যময়তার অধিকারিণী। পৃথিবীতে অসংখ্য অগণিত প্রেমিক আছে প্রেমিকার থেকে স্পষ্ট জবাব পেতে চায় কিন্তু প্রেমিকা কিছুটা চাপের মধ্যে প্রেমিক পুরুষকে রাখতে চায়। জ্বালা যন্ত্রণার সাগরে ভাসাতে চায়। এটি বোধহয় এই সুন্দর পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়ম। শুধু প্রেমিক পুরুষকেই নয়; কাছের হৃদয়ের স্বজনদের যাদের বসবাস ঠিক হৃদয়ের মধ্যে। তবে প্রতিটি প্রেমিকা চায় তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে তার আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগিও করতে- যেটির অর্পার মধ্যে লক্ষণীয়। অর্পা যখন বৃষ্টিতে ভিজছিল হঠাৎ তার চিৎকারের লেখক স্বয়ংই তার কাছে ছুটে যায়। বোঝা যায় গল্পকার অর্পার প্রতি প্রচন্ডভাবে টান আর দুর্বলতার লক্ষণ। গল্পের নায়ক অর্পাকে নিয়ে খুবই শঙ্কিত আর চিন্তিত ছিল। ছিল দুঃশ্চিন্তায়; কারণ অর্পা একটি কঠিন অসুখে ভুগছিল। কিন্তু অর্পা কখনোই গল্পকারকে বুঝতে দেয়নি আসলে তার হয়েছিল কী। হঠাৎ একদিন অর্পা না ফেরার দেশে চলে গেছে গল্পের নায়ক অর্থাৎ গল্পকারকে একা করে। তবে বিষয়টি বাস্তবিক না কাল্পনিক না-কি গল্পকারের স্বপ্নের ঘোরে একটি কল্পনার জগৎ তৈরি করেছিলেন বিষয়টি আসলে আমার বোধগম্য নয়। বোধহয় এখানেই গল্পকারের চরম স্বার্থকতা। পাঠককে ভাবনার জগৎ-সংসারে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর। গল্পকারের মতো বলি, ‘আমিও বেদনার মতো ফুটে আছি কিন্তু আমি ভাবনায় নুয়ে গেছি।‘
প্রজাপতি ও বালিকার গল্প-এ গল্পকার শুরুতেই গল্পটি শীতসকালের কুয়াশার হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া অথবা পরশ দিয়েছেন। সকালকে নান্দনিক করে তুলেছেন- ভালোবাসাময় করে তুলেছেন। পরক্ষণেই মনে হয়েছে শহরের কোনো পতিতার কথা; ‘নীরব শহরে‘ একজোড়া চোখকে একটা নোট গুঁজে দেবার প্রসঙ্গ। আবার এসেছে দু‘জোড়া চোখ পরস্পর দৃষ্টি বিনিময়- শহর মহানগরের রাতের শহরে- কিছুটা পথ চলা, কিছুটা কথা বলা, তাও একজোড়া নারী ও পুরুষ- যেনো নিভৃতচারী, নিশাচরী কী কৌশলী কথা- শহরে কথা বলার ঘণ্টা পেরিয়েছে।
‘প্রজাপতি ও বালিকার জগৎ‘ গল্পটি পড়ে যতই সামনের দিকে এগোচ্ছিলাম ততই যেনো কোনোনা কোনো গোলকধাঁধায় আটকে ফেলছিলাম নিজেকেই। গল্পকারকেই প্রচণ্ড শক্তিমান মনে হয়েছে। মনে হয়েছে রহস্যময়তার অধিকারী। বোধহয় গল্পকার পাঠককে নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন মানে পাঠককে নির্ভেজাল অর্থাৎ একনিষ্ঠ পাঠক হতে হবে নইলে গল্পের নির্যাস মিস করবেন। গল্পটির নায়ক মনে হয়েছিল ‘কবি‘কে - যিনি একটি গাছ নিয়ে ঘোরেন। কী গাছ, গাছের নাম কী, কোন ধরনের গাছ? গাছ না-কি সবই বোঝেন! বিষয়টি ঘোরের মধ্যে ফেলেন। পরবর্তীতে বুঝেছি।
শহরের জীবন যেন স্যাঁতসেঁতে জলাভূমি; জল নেমে যাবার উত্তরসময়। কথা নেই বলা নেই কোনও পুরুষের কক্ষে বেগানানারী যা নগরজীবনের নষ্টামির ছাপ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
গল্পকার প্রজাপতি ও বালিকার গল্পের তৃতীয় পরিচ্ছেদে কারোর ভালোবাসার গল্পের বর্ণনা দিয়েছেন। যেখানে মেয়েটির নাম উল্লেখ করেননি। মেয়েটি যাকে ভালোবাসে সে তাকে বানোয়াট কেচ্ছাকাহিনীর ভূগোল পড়ান অথচ তার পরিবারের ঠিকানা দেন না- কিছুটা লুকোচুরি কিছুটা পীড়াপীড়ি। এ কেমন ভালোবাসা? আবার মেয়েটি ছেলেকে ভালোবাসে বুঝলাম কিন্তু অন্যবালক মানে এক্সবন্ধুর সঙ্গে কে কফিশপে? ছেলেটিই বা কে, পরিচয় কী তার কোনো আলামত খুঁজে পাইনি। তবে হাত ধরাধরি, চুমো খাওয়া-চুমোচুমির সঙ্গে সেক্সের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত- যা নষ্টামি আর নোংরামিতে ভরপুর! শহরের প্রেমের গল্পগুলোর বাস্তবতা গল্পকার চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
তবে গল্পকার মেয়েটির প্রেমিককে মাঝেমধ্যেই হাজির করেছেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন এবং মেয়েটি একাকিত্বের মধ্যে পুরাতন শরীর গতর দেহ অবলীলায় সব বিলিয়ে দিয়েছেন! হায়রে আমার প্রেম! হায়রে আমার ভালোবাসা! এমন পিরিতের রঙ্গতার মৃত্যু হোক। বিষয়টি আমার কাছে উদ্ভুত কিমাকার মনে হয়েছে। গল্পটির মারপ্যাঁচ বোঝা বড়োই মুশকিল- মেয়েটি শেষমেশ তার প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যায় তাও আবার সাপের খামারে। কী অদ্ভূত! কী ভুতুড়ে! বাস্তবিকপক্ষে যা অবাস্তবিক- প্রেমিকাকে নিয়ে কেউ কী এমন করে? করতে পারে?
আশ্চর্য! সাপের খামারে প্রজাপতি- হরেকরকমের প্রজাপতি- মেয়েটিকে প্রথমত দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। মেয়েটি প্রেমিককে জড়িয়ে ধরে সামান্য শুঁয়োপোকা দেখে, অথচ সেটি ছিল সাপের খামার! বিষয়টি অবিশ্বাস্য! আমার চিন্তা প্রসারিত হলো এখানে যে ছেলেটি আর মেয়েটি পালিয়েছিল বটে- তারা বিয়ে করেনি, তারা অবৈধভাবে থেকেছে। গল্পকার গল্পটিতে বিস্তারিত না হলে কিছু সংযুক্তির আভাস দিতে পারতেন।
গল্পকার এখানে সমাজবাস্তবতার চালচিত্র বিচক্ষণতার সাথে ফুটিয়েছেন। উক্ত গল্পটিতে শুধু সাপের বাড়ির কেয়ারটেকার হাসানের নামটি এসেছে। গল্পের নায়ক-নায়িকাদে চরিত্রহীন, দুশ্চরিত্র আর লম্পট মনে হয়েছে। এটি মাথায় আসেনি প্রথমত যে প্রজাপতি শুধু প্রজাপতি নয়! এটি একটি রূপক, কাল্পনিক এবং পরাবাস্তব। মেয়েটি ও বালকটির মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার বহুধা বৈচিত্র্েযর কিছু পালাবদল। প্রজাপতির বুকের ভেতর নায়কের গ্রাস হওয়া বিষয়টি নায়িকাকে ঠকানোর।
আত্মহত্যার শহরে কাঠগোলাপ ফোটে- গল্পটিতে সমাজবাস্তবতার অসামান্য প্রতিচ্ছবির নাম সোমেল। প্রাত্যহিক জীবনে কারোর সাফল্যে নিজর উত্তরণ না ঘটার কারণে বিষন্নতার চোরা বালিতে ডুবে যেতে চায় অনেকেই সোমেলের মতো। তবে প্রিয়জনদের মুখের কথা ভেবে শত ব্যথা বুকে লুকিয়েও বেঁচে থাকার মহৎকর্ম এখানে পরিলক্ষিত হয়। বলা যায় অন্যরকম বাহানায় বাঁচার প্রচেষ্টা। অর্থসংকটের সংকোচনের বিষয়টা তীব্রভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় শহরে মহানগরে। আরেকটি বিষয় জীবনে কোনো কিছু হিসেব করে হয় না; জীবন জীবনের গতিতে এগিয়ে চলে- যা দারুণভাবে গল্পকার গল্পটিতে সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন। আসলেইতো জীবন একটি ম্যাজিকের মতো: কখন যে কী হয়, কী ঘটে তা আন্দাজ করে ওটাই কষ্টকর। বড়ই মুশকিল। গল্পটিতে গল্পকার সোমেল ও তিথির প্রেম ও প্রণয়ের খাপছাড়া বর্ণনা করেছেন। একারণেই যে একে অপরের পারস্পারিকতার দৃঢ়বন্ধনে অপ্রতুলতার মিথষ্ক্রিয়া সন্নিবেশিত করেছেন। সোমেল তিথিকে পছন্দ করতো তা গল্পকার স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেননি।
অবদমনের কালে গল্পটির শুরু থেকে শেষাবধি যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো- গভীর সমুদ্র উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে পড়লে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমনটিই। এখানে প্রিয়জনের একান্ত করে কাছে পাওয়ার অভিপ্রায় ঘটেছে। তবে যখন আপন করে একান্তে সময় কাটাতে পারিনি তখনই বড়ই আকর্ষণ কাজ করেছে। সোমেল আর তিথির সম্পর্কের চমৎকার একটি রসায়ন হতে পারতো; কিন্তু তিথির এগিয়ে না আসা, সোমেলের কিছুটা অবজ্ঞা করার বিষয় গল্পকার দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘মহানগরের ভ্রমণগুলো‘ গল্পের শুরুতে শহরের ছিনতাইয়ের ঘটনার বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়। যার ভুক্তভোগী মোতাহার হোসেন। তাকে শহরের কিছু অসভ্যলোক একা পেয়ে আক্রমণ করে। তবে মজার ব্যাপার হলো এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে জাদুকরের মতো কে বা কারা এসে তাকে উদ্ধার করে। গল্পকার এখানে একটা গভীর রহস্যের ছাপ ফেলেছেন; খোলাসা করে কিছুই বলেননি। মনে হয়েছে কোনো অলৌকিক, কোনো অবাস্তব ও রোমহর্ষক ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। জেনে-বুঝেই গল্পকার গল্পের পাঠকদেও চিন্তাভাবনার বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়েছেন।
এই গল্পে মোতাহার সম্ভবত ফুডপাণ্ডার ডেলিভারি বয়। ডেলিভারি দিতে গিয়ে কোনো কোনো বাড়ির সুন্দরী রমণীদের দৃষ্টিতে আটকে ফেলেছেন। শহরে মহানগরে যেটি নিত্যদিনের ঘটনা। নির্দিষ্টভাবে বলা যাবে ঘটনাটি হলো এমন যে, সুন্দরের আগুনে ফাগুনে পোড়া বা পোড়ানো মানুষের ন্যাচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গল্পকার নীতি ভ্রষ্ট মহানগরের চিত্রটা সুনিপুণভাবে এই গল্পে তুলে এনেছেন।
দোলা যে রাতে সেলিমের ফ্ল্যাটে যায়- গল্পটি শুরুর শুরুতেই অন্যরকম ভালো লাগার কাজ করে। ধীরে ধীরে পড়ার মাত্রায় যতই এগোচ্ছিলাম ততই মুগ্ধতার টের পাচ্ছিলাম। গল্পটিতে বিচ্ছেদের পাশাপাশি রোমান্টিক পরিবেশের একটা অভাবনীয় জগৎ তৈরি হয়েছে। সেলিম গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। গল্পলেখক এখানে বিচ্ছেদের দীর্ঘদিন পর সেলিমের সঙ্গে দোলার সাক্ষাৎ করিয়েছেন এবং একরাতে তাদের মধ্যকার সুন্দর সুন্দর সময় অতিবাহিত করার পূর্বেই দোলার তার পূর্বের স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স দেওয়ার বিষয়টি পরিস্কার করেছেন। চিরকালীন পুরুষ ও নারীর যৌনসংসর্গের আবহাওয়ার পরিবেশ গল্পকার সুন্দরভাবে সুনিপুণ দক্ষতায় তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। রাতের শহরে এতো জায়গা থাকতেও গল্পকার সেলিমের মধ্যস্থতায় নায়িকাকে ফ্ল্যাটে নিয়েছেন। যৌনতার পূর্বেই যৌনতার অপব্যবহার করেছেন তবে কাম চরমে পৌঁছে যাবার মুহূর্তে কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটিয়েছেন গল্পকার। সেটি হলো নায়িকার লিঙ্গের একটা অকল্পনীয় বর্ণনার আলোকপাত করেছেন। বস্তুত মনে হয়েছে ট্রান্সজেন্ডারের ছায়াপথ ও ঘনঘটার কিছু একটা। যা অপ্রাসঙ্গিক এং অপ্রত্যাশিত কিন্তু এটাই সত্য। আমাদের দেশের লিঙ্গ রূপান্তরের বিষয়টি গল্পকার চমকপ্রদ করে তুলেছেন- যা শহরে ও মহানগরের প্রতিনিয়ত ঘটছে।
মাহফুল, মিলন ও রত্না গল্পে মাহফুলের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনার বর্ণনা গল্পকার এ গল্পের শুরুতে আরম্ভ করেছেন অর্থাৎ আরম্ভের পূর্বেই আরম্ভ করেছেন। পরবর্তীতে সেটি আরো ভয়ানকরূপ দিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি রকমের করে তুলেছেন। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়ভাবে দৃষ্টিগোচর হয়েছে সেটি কোনো এক নারীর দৃশ্যে যা মাহফুলের নিত্যকার কাজকর্মের ব্যস্ততায় টনক নড়িয়েছেন। অপ্রীতিকর ঘটনাটি মাহফুলের ইজ্জতভ্রষ্টতার। স্মার্টযুগ বলে কথা। সোশ্যালমিডিয়ার দুনিয়ায় ভাইরালের কেচ্ছা-গিবত। ভাইরাল শব্দটি সমাজব্যবস্থায় একটি ভয়ানক রূপ। সত্যমিথ্যা যাচাই-বাছাই এর আগেই মানসম্মান ধূলিসাৎ। মাহফুলের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবন চরমভাবে বিষিয়ে তুলেছে কয়েক সেকেন্ডের ছোট্ট একটি ভিডিও। ভাইরাল সমাজের ব্যাধি। ভালো হলে অন্যকিছু। তবে নষ্টামিটাই বেশি। খারাপটাই বেশি। তবে মাহফুলের বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই খতম। যারা এর সম্মুখীন হয়নি তারা কোনোভাবেই এটি বুঝবে না। বেঁচে থেকেও ‘জীবিত ও মৃত‘ গল্পের মতো মনে হয়েছে- মাহফুলের জীবনটা। সে যন্ত্রণার নারকসাগরে সাঁতার না জানা এক অনভিজ্ঞ সাঁতারু। পানি নেই তবু প্রতিশোধপরায়ণা সাগরে হাবুডুবু খেয়েছে অসম্ভব রকমের। যা গল্পকার তার এই গল্পে অভিনবত্বের দাগ কেটেছেন।
বোবা গ্রামে ভালোবাসার গল্প-গল্পটির নামই আমাকে দোলাচালে ফেলে দিয়েছে। গ্রাম আবার বোবা হয় না-কি। গল্পটির শুরুর লাইনটি এমন- ‘গ্রামটি বোবা হয়ে গেল।‘ কীভাবে বোবা হলো, কীজন্যই বা বোবা হলো, কী কারণে হলো- গল্পকার শুরুতেই প্রচণ্ডতায় অস্পষ্টতার ছাপ ফেলেছেন তবে পরবর্তীতে সেটা দূর করেছেন। গ্রামটির নাম যশমাধব। নামটি দারুণ। গল্পকারের ভাষ্য অনুযায়ী শহর থেকে গ্রামটি খুবই কাছেই ছিল মাত্র তিরিশ মিনিটের পথ অথচ গল্পের কাহিনী নাক বেড় দিয়ে কান ধরার মতো অবস্থা। গল্পকার সে চরিত্রের মধ্য দিয়ে বোবা গ্রামে ভালোবাসার গল্প মোড় ঘুরিয়েছেন সেই চরিত্রটির নাম ‘সোহেল‘। সোহেলকে দিয়েই বলানো হয়েছে গ্রামটি বোবা ছিল না হঠাৎ করেই বোবা হয়ে গেছে। গ্রামটিতে একমাত্র পুষ্পই ছিল যে কথা বলতে পারে। গফুর মণ্ডলের মেয়ে। তবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যাপার হলো- সোহেল ও পুষ্পের মধ্যে প্রেম। তাদের দুজনের জানাশোনা। একসঙ্গে কিছু মধুর সময় অতিবাহিত করা। কিন্তু এখানে গল্পকার বাস্তবতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। সমাজের সর্বকালের ঘটনাকে নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের নায়িকা পুষ্প চাইলে তার বাড়ির ঠিকানা, ফোন নাম্বার যথাযথভাবে এমনকি সঠিকভাবেই দিতে পারতো ; তা না করে গল্পের গল্পের নায়ককে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন। লক্ষণীয়, তাদের মধ্য কোনোরকম প্রতিশ্রুতির বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছিঁটেফোঁটা ছিল না। এটিও জানা গেছে- চাকরি ও সংসার দুটোতেই একসঙ্গে জড়াবেন।
চিরাচরিত নিয়মকে গল্পকার এমনভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন যে, সোহেল ও পুষ্পের মধ্যকার একটা জটিল রসায়ন। কখনো যোগাযোগ হয় আবার কখনো কখনো যোগাযোগের ভাঁটা পড়ে নায়ক নায়িকার মধ্যে। কাউকে ভালোবাসলে কতটা কামনা বাসনা অথবা স্বপ্নের দুয়ার খুলে গল্পটা পড়লে উপলব্ধি করা যায় এবং বিচ্ছেদের কী জ্বালা তাও বোঝা যায়।
তবে সর্বসাকুল্যে এটা প্রতীয়মাণ হয়- বোবা গ্রামের মানুষগুলো মুখ্যত স্বার্থের প্রয়োজনেই বোবা হয়েছিল। গল্পটিতে প্রতারণা, অবিশ্বাস এবং ধোকা দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। সংবাদমাধ্যমও তার আওতাধীন। নায়ক নায়িকা কে কোথায় চলে গেছে, কীভাবে আছে গল্পটার সেটার পরিসমাপ্তি ঘটাননি। আনন্দের ব্যাপার গল্পকার চমৎকার, সাবলীল, সহজ-সরল ভাষায় গল্পটি রচনা করেছেন- কোনোপ্রকার আড়ষ্টতা মনে হয়নি।
শহরে মহানগর গল্পগ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ফাল্গুন ১৪৩০ বাংলা ও ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ আগামী প্রকাশনী থেকে। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। দাম রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। উৎসর্গ করা হয়েছে কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরকে।
আজকালের খবর/আরইউ