স্বাধীনতা একবারই এসেছিল ১৯৭১ সালে। হ্যাঁ, সত্যি যে আমাদের সব স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি, তবে ‘ওগো যা পেয়েছি সেই টুকুতেই খুশি আমার মন’ বললে বোধ করি খুব একটা অন্যায় হবে না। প্রথমে দেখা যাক বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের তুলনা। পাকিস্তান আমলে বিচ্যুতি ছিল অগ্রগতিতে-পশ্চিম এগিয়ে ছিল আর পূর্ব অনেক পিছিয়ে।
এর ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ। এখনো বিচ্যুতি লক্ষণীয়, বস্তুত বাড়ন্ত বিচ্যুতি, তবে এবার উল্টো দিকে অর্থাৎ পাকিস্তানের চেয়ে নানা নির্দেশকে বাংলাদেশ অগ্রগামী। স্বাধীনতার সময় প্রায় সব আর্থ-সামাজিক নির্দেশকে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে ছিল; এখন অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে টপকে গেছে।
বাংলাদেশ বনাম ভারতের তুলনাটা এ রকম: কিছু ক্ষেত্রে ছুঁই ছুঁই, অন্য ক্ষেত্রে এগিয়ে।
যেমন জিডিপিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার, নগরায়ণের হার ইত্যাদিতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য নির্দেশকে দ্রুত ধাবমান সেই দেশটির সমান হতে।
ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ক্রমবর্ধমান অবদান নিয়ে আগুয়ানের বিপরীতে ভারত ও পাকিস্তানে ওঠানামা নিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান বাংলাদেশের অর্ধেকের মতো। এটি ব্যাখ্যা করে কী করে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক নির্দেশকে আঞ্চলিক সহগামীর নাগাল ধরল। আর ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের সফলতা প্রতিফলিত হতে দেখা যায় নগরায়ণের সফলতায়।
নব্বইয়ের দশকে সবচেয়ে কম নগরায়ণ থেকে আঞ্চলিক অংশীদারদের ছাপিয়ে যাওয়া কম কৃতিত্বের কথা নয় (অপরিকল্পিত যদিও এবং অন্যান্য সমস্যা থাকা সত্ত্বেও)। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের তুলনায় নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের সংগতিপূর্ণ হার বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে জ্বালানি জুগিয়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের সফলতা-তুলনীয় সময়ে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ থেকে ৩৬ শতাংশ, ভারতে ৩০ থেকে ২১ এবং পাকিস্তানে ১৪ থেকে ২৩ শতাংশ।
সামাজিক নির্দেশকে সার্বিক পর্যবেক্ষণ অমর্ত্য সেনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। বেশির ভাগ সামাজিক নির্দেশকে পাকিস্তানের আগে অবস্থান বাংলাদেশের-শিশুমৃত্যুর হার, মোট প্রজনন হার, প্রত্যাশিত আয়ু, বয়স্ক সাক্ষরতা (মোট এবং মহিলা) এবং মেয়েদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক অন্তর্ভুক্তি প্রভৃতি। বস্তুত যখন জ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন মনে করেন, এসব নির্দেশকের ক্ষেত্রে ভারতসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাংলাদেশ পথপ্রদর্শক, তখন গর্বে বাংলাদেশির বুক ভরে ওঠে বৈকি।
দুই.
এবার সামাজিক নির্দেশকের তুলনামূলক আলোচনায় একটু নিবিষ্ট হওয়া যাক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভারতের তুলনায় শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশে বেশি থাকা সত্ত্বেও ২০০০-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের নিচে শিশুমৃত্যুর হার নামাতে পেরেছে (বাংলাদেশ প্রতি হাজারে ১০০ থেকে ২৬, ভারত ৯৯ থেকে ২৮ এবং পাকিস্তান ১০৭ থেকে ৫৫)। পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে একই প্রবণতা লক্ষণীয় যেমনটি মোট প্রজননের ক্ষেত্রেও, নব্বইয়ের শুরুতে প্রতিবেশী দুই দেশের তুলনায় বেশি থেকেও ইদানীং সবচেয়ে কম। খর্বকায় অনুপাত নব্বইয়ের দশকে প্রতিবেশী দেশ দুটি থেকে বেশি নিয়ে যাত্রা শুরু, কিন্তু ইদানীং বাংলাদেশের অগ্রগতি অন্যদের চেয়ে ভালো। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রত্যাশিত আয়ু সবচেয়ে কম ছিল বাংলাদেশে, ৫৮ বছর; এখন প্রায় ৭৩ বছর। আর সেই সময় পাকিস্তানে ছিল সবচেয়ে বেশি, ৬০ বছর; এখন ৬৭ বছর। ভারত ৫৭ থেকে সত্তরে তুলতে পেরেছে। অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ বেশিদিন বাঁচে এখন। অন্যদিকে মোট এবং নারী বয়স্ক সাক্ষরতায় ভারতের পেছনে থেকেও এখন ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ যেমনি করে মেয়েদের প্রাথমিক স্কুলে অন্তর্ভুক্তিতে। তবে মাধ্যমিকে মধ্যখানে পা পিছলালেও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
গেল তিন দশকে চিত্তাকর্ষক চিত্র দারিদ্র্য হ্রাসের বেলায় চরম দারিদ্র্য প্রকোপ ভারতের চেয়ে কম এই বাংলাদেশে। স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যি যে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কম কৃতিত্ব নিয়েও পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার চার থেকে আট শতাংশ, যা গবেষকদের ভাবায়।
তিন.
সব আশাব্যঞ্জক গল্পের একটা অন্ধকার দিক থাকে। আশা এবং নিরাশার দোলাচলে আমরা প্রতিনিয়ত দোল খাই। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা তেমনি এক আলো-আঁধারির খেলা হিসেবে দেখা হলে বোধ করি ভুল হবে না। একদিকে উন্নয়নের ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে, অথচ অন্যদিকে ধনী-গরিব বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ হারসম্যান ও রথচাইল্ড বলেছেন টানেল প্রভাবের কথা: বিদ্যমান কাঠামোতে আয়বৈষম্যের প্রতি যদি সহনশীলতা কম থাকে, তাহলে ‘আগে বাড়া, পরে বিতরণ’ এমন তত্ত্ব বিপজ্জনক হতে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যমান বৈষম্য-সহগ (গিনি সহগ) বিপৎসীমার কাছাকাছি। বৈষম্য বেশি হলে দারিদ্র্য নিরসনে প্রবৃদ্ধির প্রভাব খাটো থাকে অর্থাৎ একই প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে কম বৈষম্যের সমাজে দারিদ্র্য হ্রাসের হার বেশি হবে বেশি বৈষম্যের সমাজের চেয়ে। তা ছাড়া এই তীব্র বৈষম্য একটা অভ্যুত্থান-বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে, যেমন জুলাই-আগস্ট মাসের ঘটনাপ্রবাহ।
আশা ছিল কুজনেটসের চুইয়ে পড়া প্রভাব তত্ত্ব (বা ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট থিওরি) কাজ দেবে, কিন্তু সে আশায় যেন গুড়ে বালি। ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট বলতে চায়, প্রবৃদ্ধির প্রারম্ভিক স্তরে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে চুইয়ে পড়া সুফলে বৈষম্য হ্রাস পায়। সেটা খুব একটা কাজ করছে বলে মনে হয় না কিংবা ভবিষ্যতে করবে এমন ইঙ্গিত আপাতত নেই বলে মনে হয়। আর যদি ঘটেও থাকে, তা যে খুবই দুর্বল সে কথা বলা বাহুল্য। এদিকে আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে ঠিকই, কিন্তু তা কাম্য স্তরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না; ব্যক্তি বিনিয়োগ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়।
গেল চার দশকের বেশি সময় ধরে ‘অবিশ্বাস্য’ তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধাঁধার আড়ালে-আবডালে অভাবনীয় উত্থান ঘটেছে কালো এক অর্থনীতির (আন্ডার গ্রাউন্ড ইকোনমি)। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে ‘অর্থনৈতিক শয়তানের’ অভাবনীয় আবির্ভাব ঘটেছে। অন্ধকারে থাকা এই অর্থনীতি সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত রাখছে, রাজনীতিকে কলুষিত করছে, বিকৃত ভোগবাদী সমাজ সৃষ্টিতে জ্বালানি জোগাচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য এখন দুই হাতে টাকা কামাই করা। মোটাদাগে, এটা একটা টেকসই উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।
ক্ষেত্রবিশেষে এর ভেতরে অথবা পাশাপাশি অবস্থান নিয়েছে সর্বব্যাপী চরম দুর্নীতি; যদিও এ দেশে দুর্নীতির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, তার পরও বিগত দশকগুলোতে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে পুঁজিবাদ প্রসারণে উত্থান ঘটেছে এক শ্রেণির দাপুটে, ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজের। বলা যায়, সমাজের অভিভাবক এখন তারাই। দুর্নীতি প্রতিবছর জিডিপির দুই শতাংশের মতো গিলে খায়। তা ছাড়া প্রতিবছর দেশ থেকে অবৈধ পথে পাচার হয় গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলার; ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নাকি ছয় হাজার কোটি ডলার পাচার হয়েছে বলা হচ্ছে।
‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা!’ এমনকি রক্ষণশীল হিসাবেও ঋণখেলাপির পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকা। তাদের একটা অংশ বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকরে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। শেয়ারবাজার লুট করে উত্থান ঘটেছে এক শ্রেণির ধনী মানুষের। দিনে-দুপুরে ব্যাংক ডাকাতির কথা আপাতত না হয় থাক। তবে বলতেই হবে যে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী কিংবা ব্যাংক ডাকাতদের বেশির ভাগ দেশে অথবা বিদেশে দাপটে ও সুখে আছে। অবৈধ অর্থ আর সম্পদের জোরে তারা কিনে নিয়েছে রাজনৈতিক নেতা, এমনকি মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের।
অথচ নিয়তির নির্মম পরিহাস এই যে তাদের কেউ এই ১০ থেকে ২০ বছর আগেও হিমশিম খেত সংসার চালাতে; কেউ ছিল পিয়ন, কেউ দিনমজুর। আনুক্রমিক সরকারগুলোর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় তারা হয়ে উঠেছে দানব; সমাজটাকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে তারা আজ আলোকিত, আলোচিত, এমনকি মাঠে-ময়দানে অভিভাবক হিসেবে অভিভূত করে অভিভাষণে। অর্থনীতির গ্রেসামস ল অনুযায়ী, মন্দ টাকা ভালো টাকাকে বাজারছাড়া করে, তেমনি আজ এই সমাজে মন্দ লোক ভালো লোককে কোণঠাসা করে রাখছে। রাজনীতি কলুষিত হয়েছে কালো টাকায়; তাদের অস্ত্রের ভাষা কেড়ে নিয়েছে আমজনতার ভাষার অস্ত্র। মানুষ বুঝে গেছে অর্থই সব সুখের মূল—মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকা দুর্বলের ধর্ম।
সুতরাং ব্যাপক সংস্কারের বিকল্প নেই। আবার বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে অর্থাৎ সার্বিক সংস্কার কে করবে তারও সুরাহা হওয়া জরুরি। কেননা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে বড় বাধা। আমাদের অস্থিরতার সুযোগে ভারত ও পাকিস্তান যেন অর্জিত সাফল্য ছিনিয়ে নিতে না পারে সেই কামনা সবার।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
আজকালের খবর/আরইউ