সোমবার ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
একত্রে দাঁড়াও দেখি সবে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪, ৪:১৬ PM
মাসিদের যে দরদ থাকতে নেই তা নয়। দরদ তাদের থাকে, তারা এমনকি কান্নাকাটিও করেন। তবে মায়ের মতো না; মায়ের কান্নাকাটিটাই খাঁটি বস্তু। মা কিন্তু অনেক সময় কাঁদতেও পারেন না; শোক অল্প হলে কাতর থাকেন, বেশি হলে পাথর বনে যান।

ওই জ্ঞান থেকেই, মাসিরা বেশি কান্নাকাটি করলে মায়েদের মনে সন্দেহ দেখা দেয় যে মাসিরা হয়তো ভান করছেন। মতলব আছে লোক ঠকানোর। ব্যাপারটি সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি সবখানেই ঘটে। রাষ্ট্রের যারা কর্তা, যাদেরকে আমরা সরকার বলে চিনি, সমালোচনা শুনলেই তারা চটে লাল হন, ভাবেন নিজেরা তারা রাষ্ট্রকে কত কষ্টে যত্ন-আত্তি করছেন, মায়া করছেন, রাষ্ট্রের ভালো-মন্দ তাদের মতো আর কে বোঝে? সেখানে অতিরিক্ত উৎপাত কেন? মাসিদের কেন আনাগোনা? মাসিদের ব্যাপারে মায়েদের এই ব্যবহার পুরনো ব্যাপার।

হালে দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টসের মালিকরাও ওই রকমই করছেন। গার্মেন্টস শ্রমিকরা যে মজুরি পায় তা যে যৎসামান্য এবং তাদের শ্রমের ওপরই যে ওই শিল্পের বিশ্ববাজার টিকে রয়েছে সে সত্যটা সাধারণত প্রকাশ পায় না। শ্রমিকরা দাবি করেছে তাদের ন্যূনতম মজুরি হওয়া চাই মাসে ১৬ হাজার টাকা। এটা কোনো মামাবাড়ির আবদার নয়।

ভারতে শ্রমিকদের দাবি মজুরি দিতে হবে মাসে ১৮ হাজার রুপি; বাংলাদেশের হিসাবে সেটি দাঁড়ায় ২৬ হাজার টাকা। বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক গবেষকরাও হিসাব করে দেখিয়েছেন যে শ্রমিকদের মানবোচিত জীবনধারণে কমপক্ষে ২৬ হাজারই দরকার, তার কমে চলে না। বাংলাদেশের শ্রমিকরা ২৬ হাজার চায়নি, চেয়েছে ১৬ হাজার। তাদের দাবির সমর্থনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠনগুলো একটি কনভেনশন করেছিল, তাতে সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজেরও কেউ কেউ উপস্থিত ছিলেন। কনভেনশনের খবর তেমন একটি প্রচার পায়নি।

প্রচার না-পাওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ গার্মেন্টসশিল্পের মালিক, মিডিয়ার মালিক এবং রাষ্ট্রের মালিক সবাই এক ও অভিন্ন পক্ষ; তারা মালিকপক্ষ। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়; একে অপরের মাসতুতো ভাই-ই, যথার্থরূপে।

মালিকপক্ষের দাবি যে শিল্পটিকে তারা সন্তানের মতো লালন-পালন করে থাকেন সেখানে বাগড়া দেয় শ্রমিকরা, আবার তার সঙ্গে এসে জুটেছে তথাকথিত মাসিরা। এই মাসিদের নিশ্চয়ই মতলব আছে, হয়তো শিল্পের ধ্বংসই তারা চায়। বিদেশিদের এজেন্ট হওয়া বিচিত্র নয়। ‘মাসি’ কথাটি আমাদের বানানো নয়; ওই কনভেনশনের দুদিন পর মালিকপক্ষ একটি পাল্টা সভা করেছিল এবং সেখানে তারা বলেছিল যে তাদের অতিযত্নে প্রতিষ্ঠিত, আদরে লালিত-পালিত, প্রাণের চেয়েও প্রিয় শিল্প সম্পর্কে যারা কোনো জ্ঞানই রাখে না সেই মাসিরা এখন দরদ দেখাচ্ছে। হ্যাঁ, এটি তো ঠিকই যে সাধারণ নাগরিকরা এবং শ্রমিকরাও, ওই শিল্পের আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে অজ্ঞ; কিন্তু এটি তো সবাই জানে যে ওই শিল্প থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় সেটিই দেশের উন্নতির প্রধান ভরসা; এবং বাংলাদেশের জামাকাপড়ের যে বিদেশি বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে তার কারণ বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের ভালোবাসা নয়। কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের সস্তা শ্রম। এত সস্তায় এমন শ্রম দুনিয়ার অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। আর এই শ্রমিকদের অধিকাংশই হচ্ছে নিরুপায় নারী, যারা কারখানায় আসে বেঁচে থাকার অন্য কোনো উপায় নেই বলেই। আর এই মেয়েরা যে শুধু দেশের কারখানাতেই যায় তা নয়, সৌদি আরবে পর্যন্ত চলে যায়, এমনই তারা দুঃসাহসী ও কর্মঠ। সৌদি আরবে তারা পবিত্র হজের জন্য যায় না, জীবিকার খোঁজে যায়। সেখানে গিয়ে কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় তার বিবরণ তারা দিতে পারে না; ভাষার অভাবে এবং স্বাভাবিক লজ্জায়। সৌদি মালিকরা তো বটেই, বাংলাদেশের দূতাবাসের লোকেরাও এই মেয়েদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে কার্পণ্য করে না।

অসহায় শ্রমিকদের পক্ষে বললে মালিকরা যে রেগে যাবে সেটি তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কই রাষ্ট্রও তো শ্রমিকদের পক্ষে বলে না। বিদেশি ক্রেতাদের সমিতি তবু মাঝেমধ্যে চক্ষু লজ্জায় পড়ে, তারা বলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা দাও, কাজের পরিবেশ কিছুটা উন্নত করো; জিজ্ঞেস করে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার আছে কিনা। রাষ্ট্র নির্বিকার। অথচ বাংলাদেশে যে একটি সরকার গঠিত হয়েছে সে তো সাধারণ মানুষের প্রাণদানের বিনিময়েই, যাদের ভেতর ছিল ছাত্র-জনতা। এরাই শহীদ হয়েছে, এরাই আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। সেই মেহনতি মানুষ যখন তাদের বাঁচার অধিকারের কথা বলে তখন রাষ্ট্র ও মালিক সবাই তাদের ওপর খেপে যায়, সবাই একত্র হয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেন চরম শত্রুর মোকাবেলা করছে। মা বলে যারা নিজেদের দাবি করেন তাদেরকে তখন মা তো নয়ই, মাসি বলেও মনে হয় না। বর্তমান সরকারের শাসনামলেই আশুলিয়ায় শ্রমিকদের বকেয়া মজুরির দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনকালে ঘটেছে শ্রমিক হত্যা, নির্যাতন, শতাধিক আহত ও গ্রেপ্তার। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সিদ্ধান্ত যখন সরকার নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন ওই সিদ্ধান্ত আসছে রাস্তায় থাকা সমন্বয়কদের কাছ থেকে। অন্যদিকে শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবিতে রাস্তায় বিক্ষোভ করলে তাদের পড়তে হচ্ছে নৃশংস নির্যাতনের মুখে। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালিত হচ্ছে রাস্তা থেকে দেওয়া সিদ্ধান্তে। চমৎকার বৈপরীত্য।
রাষ্ট্রীয় কর্তাদের শাসনে দেশের মানুষ যে ভালো নেই তা বলার অপেক্ষা আগেও রাখত না, বর্তমানে আরো বেশি পরিমাণে রাখে না। মেহনতি মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানার মালিকদের আয়ের যেকোনো রকমের তুলনাই জানিয়ে দেবে মেহনতিদের দশাটা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে; ধরিয়ে দেবে বিজ্ঞাপিত উন্নতির আসল রহস্যটা। অনুৎপাদক খাতের লোকদের আয়ের সঙ্গে উৎপাদক খাতের মেহনতিদের তুলনাটাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সামরিক ও অসামরিক আমলাতন্ত্র এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে মেহনতি মানুষের আয়-ব্যয়ের তুলনা করুন, পরিষ্কার ধরা পড়বে রাষ্ট্রের পক্ষপাত কোন দিকে এবং কেন। ধরা পড়বে উন্নতি কোন দিকে ঘটছে এবং কীভাবে ঘটছে।

ঢাকা শহর এখন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরে পরিণত হয়েছে। ঢাকার নিচে আছে আর একটি মাত্র শহর সেটি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে, তাই দামেস্কের ওই দশা। কিন্তু বাংলাদেশে তো কোনো যুদ্ধ নেই, তাহলে বাংলাদেশের রাজধানীর কেন এই দুর্দশা? হ্যাঁ, যুদ্ধ একটি অবশ্যই আছে, যুদ্ধ চলছে এই বাংলাদেশেও; সেটি দরিদ্রের সঙ্গে ধনীর যুদ্ধ। তার নাম শ্রেণিযুদ্ধ। আমরা ওই যুদ্ধের খবর রাখি না, খবর রাখতে চাইও না, রাখলে বুঝতাম ঢাকা কেন এতটা নিচে নেমে গেল। উন্নতি? হ্যাঁ, হচ্ছে, অবশ্যই উন্নতি হচ্ছে। উন্নতির দৃশ্য ও গল্প তো কোনো নতুন ব্যাপার নয়। উন্নতি ব্রিটিশ শাসনে হয়েছে, পাকিস্তান আমলেও কম হয়নি। ব্রিটিশরা তো বলতেই পারে যে তারা আমাদের জন্য রেলের গাড়ি, টেলিগ্রাফের সংযোগ, স্টিমারে যাতায়াতÑ এসবের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, শিল্প-কারখানা তৈরি করেছে, ইংরেজি ভাষা শিখিয়েছে, এবং চা কীভাবে খেতে হয় সেটি পর্যন্ত হাতে ধরে দেখিয়ে দিয়েছে; আর আইয়ুব খান তো ১০ বছর ধরে মনের সুখে উন্নতির গান গাইতে গাইতে রাজত্ব করে গিয়েছেন, উন্নয়নের দশক পালন শেষে সবচেয়ে সুন্দর গানটি গাইবার সময়েই তার পতন ঘটল। কিন্তু ওই সব উন্নতি নিয়ে আমরা তো সন্তুষ্ট ছিলাম না; উন্নতির ওই দাতাদের আমরা মেরে ধরে বিদায় করেছি। কারণ? কারণ হলো উন্নতিটা ছিল পুঁজিবাদী ধরনের, তাতে উন্নতির সঙ্গে সমানতালে বাড়ছিল বৈষম্য ও বঞ্চনা, দেশের সম্পদ চলে যাচ্ছিল বিদেশে। এখনকার উন্নতিরও তো ওই একই দশা। উন্নতি অল্প কিছু মানুষের, যারা চেপে বসে আছে বাদবাকিদের ঘাড়ের ওপর, আর উন্নতির সব রসদ জোগাচ্ছে ওই বাদবাকিরাই। এই উন্নতরা উন্নতি করেছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে।

সাম্রাজ্যবাদীরা এখন মহাব্যস্ত দেশের সম্পদ লুণ্ঠনে ও পাচারে। সম্পদ মোগলরা নিয়ে যেত দিল্লিতে, ইংরেজরা নিয়ে গেছে লন্ডনে, পাকিস্তানিরা নিত রাওয়ালপিন্ডিতে; সাম্রাজ্যবাদের কুশীলবরা সুযোগের অপেক্ষায় বসে নেই। যথা সময়ে সেটি পরিষ্কার হবে। কেননা এদের জবাবদিহির সামান্যতম দায় নেই। কার কাছে দায় থাকবে? রাষ্ট্র তো এদেরই করতলগত।

উন্নতি কাদের শ্রমে ও ঘামে সম্ভব হচ্ছে তাও আমরা জানি। কাজী নজরুল ইসলাম তার ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিলেন ‘কুলি-মজুর’ নামে। ওই কবিতায় পুঁজিবাদী উন্নতির ভেতরকার খবরটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়ে গেছেন তিনি। ওটি লেখা হয়েছিল আজ থেকে ১০৭ বছর আগে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন রাজপথের মোটর, সাগরের জাহাজ, রেললাইনের রেলগাড়ি, জমিতে অট্টালিকা, এসব কাদের দান, এগুলো কার খুনে রাঙা? জবাবটা তার ওই প্রশ্নের ভেতরেই বসে আছে। সব উন্নতিই শ্রমিকের শ্রম দিয়ে দিয়ে তৈরি, উন্নতি মাত্রই শ্রমিকের খুনে রাঙা। বিনিময়ে শ্রমিক কি পেয়েছে? বেতন? কত টাকা? নজরুলের ভাষায়, ‘বেতন দিয়েছ? চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল/কত পাই দিয়ে কুলিরে তুই কত ক্রোর পেলি বল।’ কত দিলেন আর কত পেলেন, এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের গার্মেন্টসশিল্পের মালিকরা কী বলবেন? কত দিচ্ছেন? বিনিময়ে কত আদায় করে নিচ্ছেন?

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

আজকালের খবর/আরইউ








http://www.ajkalerkhobor.net/ad/1724840661.gif
সর্বশেষ সংবাদ
রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহী জেলেনস্কি: ট্রাম্প
জুলাই-আগস্টের ঘটনায় অনেক বাদী মামলা বাণিজ্য করছেন: ডিএমপি কমিশনার
বাশার আল আসাদের বাসভবনে লুটপাট চালাল জনতা
এক দিনে তিনবার হার, ভারতের দুঃস্বপ্নের মতো দিন
বিক্রম মিশ্রির সফরে বরফ গলতে পারে ঢাকা-দিল্লির
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ইবিতে মারামারি
বৃদ্ধকে বিয়ে, ফুলশয্যার আগে দেনমোহর নিয়ে উধাও যুব মহিলা লীগ নেত্রী!
চিন্ময়সহ ১৬৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা
হঠাৎ এফডিসিতে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা
গভীর রাতে যুবলীগ নেতার বাড়িতে আগুন, মা ও চাচি নিহত
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft