প্রকাশ: শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪, ৪:০৬ PM
প্রথার বিরুদ্ধে সবাই যেতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে চলা সামাজিক রীতি-নীতি উপেক্ষা করে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থার প্রবর্তণ করা কঠিন কাজ। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে এ উদাহরণ অনেক রয়েছে। ইতিহাসে এ রকমই একটি নাম রাজা রামমোহন রায়। রাজা থাকলেও তিনি সেই ধরনের ভোগ বিলাসী রাজা নন। তবে তিনি প্রকৃতই রাজা। একজন রাজার যা করা উচিত তিনি সেসব কাজই তার স্থান থেকে করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এটি তার উপাধি। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। উপাধি দিয়েই তাকে বিলেত পাঠানো হয়েছিল। তিনি একজন সংস্কারক হিসেবেই সুপরিচিত। শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সবক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিবর্তন করেছেন কুসংস্কারের। এই যে আমাদের এখনকার সমাজ, এখানেও তো এখনো কুসংস্কার রয়েছে। অল্প দু-চারজন আছেন যারা মূলত এসব পরিবর্তনে কাজ করেন নিঃস্বার্থভাবে। রাজা রামমোহন রায় চাইলেই এসব বাদ দিয়ে তার ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ হতে পারতেন।
কারণ তিনি ছিলে একজন মহাজ্ঞানী মানুষ। সেসব না করে তিনি উল্টো ব্রাহ্মণদের এবং সমাজপতিদের তৈরি করা আইন কানুনের বিরুদ্ধে গেলেন। ফলে অবশ্য তাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে বারবারই। তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃৎ। তার সঙ্গে ছিলেন আরো কিছু সমমনা প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও লেখক। হিন্দু সমাজের একটি কু-প্রথা সতীদাহ; যা এই সভ্য পৃথিবীতেই ঘটতো। তিনি গোঁড়া সমাজে একটি আধুনিক ধারণার জন্ম দিতে চেয়েছিলেন বা তার অনেকটাই সফলও করেছিলেন। এ কারণেই রামমোহন রায়কে ‘ভারতীয় রেনেসাঁর জনক’ বলেও অভিহিত করেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। ২০০৪ সালে, বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির জরিপে রামমোহন ১০ম স্থানে ছিলেন। রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতা রামকান্ত ছিলেন একজন বৈষ্ণব, তার মা ফুলঠাকুরানী দেবী ছিলেন শৈব পরিবার থেকে। তিনি সংস্কৃত, ফার্সি এবং ইংরেজি ভাষার একজন মহান পণ্ডিত ছিলেন এবং আরবি, ল্যাটিন এবং গ্রিক ভাষাও জানতেন। ঠিক এই স্থান থেকে কেউ বাইরে গিয়ে বর্ণ বৈষম্যের কাঁটা উপড়ে ফেলে নিজে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কারণ এই ধর্মের বাড়াবাড়ি তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি ছিলেন বহু ভাষায় পারদর্শী। এক কথায় বহু ভাষাবিদ। কিশোর বয়স পার হতেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন। নেপালের নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের কাছে সংস্কৃত ভাষা শিখেন। তারপর পাটনা থেকে আয়ত্ব করেন আরবি ও ফারসি ভাষা। ক্রমান্বয়ে তিনি রপ্ত করেন গ্রিক, হিব্রু এবং ইংরেজি ভাষা।
এ কারণেই তিনি একজন সুপন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। মূলত পরিপূর্ণ জ্ঞান ছাড়া কোনো ধারণাকে বিসর্জন দেওয়া বা গ্রহণ করা যায় না। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। কলকাতায় প্রায়ই আসতেন এবং কোম্পানির নবাগত অসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। এই সুযোগে ভালো করে ইংরেজি শিখে নেন। রামমোহন হিন্দু সংস্কারের এক মহান যুগের সূত্রপাত করেন। তার সংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেকালের সবচেয়ে অমানবিক প্রথা সতীদাহ প্রথা। স্বামী মারা গেলে তার সঙ্গে স্ত্রীকেও জোরপূর্বক চিতার উপর তুলে দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হতো। এই প্রথার বিরুদ্ধে ছিল না কোনো আইন। কারণ তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজ এটিকে জোর সমর্থন করতেন। তিনি সতীদাহের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হন; যা ১৮২৯ সালে বিশেষ আইনের মাধ্যমে বন্ধ করতে সরকারকে প্রভাবিত করে।
আইন করেও এ প্রথা বহুদিন রোধ করা যায়নি। এজন্য তিনি এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার করে তোলেন। ধীরে ধীরে সমাজ থেকে হারিয়ে যায় সতীদাহ প্রথা। রাম মোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিমা পূজাকেও দৃঢ়ভাবে বর্জন করেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে হিন্দুধর্ম এক সর্বজনীন ঈশ্বরের পূজা করতে নির্দেশ দেন। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা তুহফাতুল মুহাহহিদিন বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয় বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। এসব করতে গিয়ে সেসময়কার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের কাছে তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারান এবং প্রতি পদক্ষেপে বাধার সম্মুখীন হন। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি এক আত্মীয় সভার ডাক দেন। এখান থেকেই সেই সময়ের জনপ্রিয় ব্রাহ্মসমাজ তৈরি হয়।
এক্ষেত্রে তিনি সহযোগিতা পান জমিদার প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং আরো কিছু প্রভাবশালী মানুষের যারা সেই সময়ে একটি সংস্কারের চিন্তা করছিলেন। এরপর তিনি অন্য যে সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন সেটি হলো সমাজে প্রচলিত বহুবিবাহ এবং বাল্য বিবাহ রোধ করা। ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের গুরুত্ব তিনিই উপলদ্ধি করেছিলেন। কারণ তার চিন্তা-চেতনা ছিল আধুনিক মনস্ক। ১৮১৭ সালে, ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় তিনি কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। ১৮৩০ সালে, তিনি রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফকে সাধারণ পরিষদের ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন। সংবাদ কৌমুদী ছিল তৎকালীন সময়ে তার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা। এই পত্রিকা সেই সময় জাগরণে বা রেঁনেসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজা রামমোহন রায় তার সমগ্র জীবনে সমাজের কুৎসিত দিকগুলো দূর করতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছেন। ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এই মহান শিক্ষানুরাগী, সমাজ সংস্কারক এবং বিদ্বান ব্যক্তি পরপারে পাড়ি জমান।
আজকালের খবর/আরইউ