সোমবার ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
জীবন নদীর বাঁকে
ফারজানা ইয়াসমিন
প্রকাশ: শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০২৪, ৪:০০ PM
মুক্তাকে দেখে তার সহকর্মীরা খুব অবাক হয়। চাকরি করে বাচ্চাসহ সংসার কীভাবে এত সুন্দর করে সামলায়! মাঝে মাঝে রূপা জিজ্ঞেস করে মুক্তাকে- এত কাজ করে কীভাবে মাথা এতো ঠাণ্ডা রাখো?
মুক্তা হেসে বলেÑ রাখতে হয় বন্ধু। তা ছাড়া উপায় কী বলো? ছোট ভাইটি একা বাবা-মায়ের খরচ দিতে পারে না। আমি কিছুটা সাহায্য করলে ওর জন্য সুবিধা হয়। তা ছাড়া বাবা মা তো আমারও।
রূপা খুব পছন্দ করে মুক্তাকে। নিজের যত সমস্যা সব মুক্তাকে বলে। মুক্তার বুদ্ধি অনেক ভালো। সংসার কীভাবে চালাতে হয় তা মুক্তা খুব ভালো বুঝে। কিন্তু মুক্তার মনেও অনেক কষ্ট। তা সে কাউকে বলতে পারে না। সবাই ওর হাসিখুশি মুখটা দেখতে পছন্দ করে। তা ছাড়া কাউকে কিছু বললে কী লাভ?
অনেক কিছু সামাল দিয়ে মুক্তাকে চাকরি করতে হয়। চাকরি করেও তাকে একদম পরিপাটি করে সংসার করতে হয়। ঠিক সময় মতো স্বামী জাকিরের খাবার থেকে শুরু করে পোশাক সামনে হাজির রাখা; শ্বশুর-শাশুড়ির খাবার, ওষুধ সময়মতো সামনে দেওয়া; ছেলে আবিরকে নাস্তা করিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করা; সকালের খাবার তৈরি করা সহ দুপুরের খাবার রান্না করে রেখে যেতে হয়। জাকির মুক্তাকে চাকরি করতে দিতে রাজি হয়েছে এই শর্তে, যে মুক্তা কাউকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিবে না। যদিও কাজ করতে গেলে ভুল হয়। জাকির বা মুক্তার শ্বশুর অভিযোগ করে বসে। মুক্তার শাশুড়ি তা সামলে নেয়। কিন্তু শাশুড়ি সামনে না থাকলে মুক্তা বিপদে পড়ে যায়। শ^শুর কড়া করে কথা বলে। আর জাকির ভয়ংকর রেগে যায়। এতটুকু বুঝতে চায় না মুক্তা এক হাতে এতো কাজ একা করে। তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। ছুটা কাজের বুয়া এসে শুধু ঘর মুছে আর থালা-বাসন ধুয়ে যায়। কাপড় মুক্তা ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে নেয়। তাতেও তো সমায় লাগে। জাকির কোনোদিনই মুক্তাকে সাহায্য করে না। মুক্তার কষ্ট বুঝতেও চায় না।
মুক্তাকে অফিস থেকে ফিরে এসে আবিরের স্কুলের পড়াশোনা দেখতে হয়। ঠিকমতো হাউজ টিউটর পড়ালো কিনা তাও দেখতে হয়। বিকালের নাস্তা বানিয়ে আবার রাতের রান্না করতে হয়। নিজের দম নেওয়ার সময় পায় না মুক্তা। বিকালে এক কাপ চা খাবে, তাও ঠাণ্ডা হয়ে যায় খেতে খেতে। শুক্রবার ছুটি থাকে। কিন্তু হাজারো কাজ জমে থাকে। বাবা-মাকে দেখতে যেতে পারে না। দুই তিন মাস পর ছুটি নিয়ে দেখতে যায়।
জাকির একটু রাগী স্বাভাবের। কোনোকিছু একটু এদিক-সেদিক হলেই রেগে যায়। মুক্তা কখনো খুব রেগে গিয়ে জবাব দিলে জাকির গায়ে হাত তুলে মুক্তার। এর আগেও এমন করেছে। মুক্তা রাগ করে বাবার বাসায় চলে যায়। জাকিরের মা জাকিরকে বকাবকি করে জাকিরকে পাঠায় মুক্তাকে আনতে। মুক্তা আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরে আসে। এই সংসারে মুক্তা আর কারো ভালোবাসা না পেলেও শাশুড়ির মায়া ও ভালোবাসা ঠিক পায়। সাপোর্ট একমাত্র শাশুড়ি মা দেয় মুক্তাকে। তার নিজের মেয়ে নাই বলে মুক্তাকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। একমাত্র ছেলের বউ বলে মুক্তা তার কাছে খুব আদর পায়। মুক্তার কাজেও সাহায্য করে সে।
অফিসের এক পিকনিকে যাওয়ার জন্য জাকির মুক্তাকে ছুটি নিতে বলে। কিন্তু অফিস থেকে ছুটি পায় না মুক্তা। জাকির খুব রেগে যায়। ছুটি না পেলে মুক্তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। মুক্তা জাকিরকে বলেÑ এই চাকরি আমার খুব দরকার। তা তুমি জানো। বাবা মায়ের খরচ দেই এই চাকরির বেতন থেকে। আর আজ আমাকে প্রয়োজন তাদের। আমি আজ তাদের দায়িত্ব পালন করতে না পারলে। কাল আমার সন্তান আমার দায়িত্ব পালন করবে না। মেয়ে বলে কি আমার কোন দায়িত্ব নেই? 
জাকির প্রচণ্ড রাগে আবিরের সামনেই মুক্তাকে চড় মারে। আবির ভয়ে দাদি বলে চিৎকার করে দাদির ঘরে দৌড়ে যায়। দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলে- দাদি, বাবা মাকে চড় মেরেছে। বাবা একদম ভালো না। তুমি বাবাকে বকা দেও।
আবিরকে ওর দাদি-দাদার কাছে দিয়ে জাকিরকে এসে কষে একটা চড় মারে। জাকিরের চেয়ে বেশি অবাক হয় মুক্তা। কারণ সে শুনে এসেছে জাকিরকে তার মা কোনোদিনই মারে নাই। একমাত্র সন্তান বলে অনেক আদরে মানুষ করেছে। জাকির গালে হাত রেখে বলেÑ তুমি আমাকে কেন মারলে মা? দোষ তো আমার না মা। মুক্তা আমার সাথে তর্ক করছে। আমি যা বলবো ওকে তাই করতে হবে। আমার ইচ্ছামতো ওর চলা উচিত। ও আমার কথা না শুনে মুখের উপর কথা বলেই যাচ্ছে। তুমি ওর দোষ কখনোই ধরো না।
জাকিরের মা বললÑ আমার আজ সত্যি লজ্জা হচ্ছে যে তুমি তোমার ছেলের সামনে তার মায়ের গায়ে হাত তুলেছো। তাও তার কোনো দোষ না থাকার পরেও তার সাথে খারাপ আচরণ করলে। আমি জানতাম আমি তোমাকে তোমার বাবার মতো হতে দেইনি। আমার মতো করে বড় করতে চেয়েছি। তোমার বাবা আমার সাথে যে আচরণ করেছে তুমি সেই আচরণ তোমার স্ত্রীর সাথে করছো। তোমার বাবা তোমার সামনে যে খারাপ আচরণ করেছে, তুমি সেই আচরণ তোমার ছেলের সামনে করছো। তাকে একই শিক্ষা দিচ্ছো। আমার আজ খুব কষ্ট হচ্ছে জাকির। আজ নিজেকে একজন ব্যর্থ মা মনে হচ্ছে। মুক্তা তার বাবা মায়ের জন্য কিছু করতে চাচ্ছে। এতে তোমার সাপোর্ট দেওয়া উচিত ছিল। তুমি তা না করে তাকে চাকরি ছাড়তে বলছো। তোমার নানা-নানির যখন আমাকে প্রয়োজন ছিল-আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারি নাই। এই কষ্ট আমি কোনোদিনই ভুলতে পারি নাই। আমি আজও জায়নামাজে বসে তাদের কাছে ক্ষমা চাই। এতো বড় পাপের ক্ষমা পাবো না জানি। আমি ঠিকই আমার শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আমার যে মায়ের পায়ের নিচে আমার বেহেস্ত তাদের জন্য কিছু করতে পারি নাই। আমি সারাজীবন আমার সংসারের দায়িত্ব পালন করেছি ঠিকই; কিন্তু সন্তুষ্টি পাইনি কোনদিনই। আমি চাই না মুক্তা আমাকে ঘৃণা করুক। আমি চাই সে তার সংসার সন্তুষ্টি নিয়ে করুক। আমি মুক্তার অগোচরে তোমাকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু রক্ত তো এক তোমার বাবার আর তোমার। তোমার দাদাও এমনই ছিল। আমি মুক্তাকে মেয়ে মনে করলেও তোমার বাবা তাকে ছেলের বউ মনে করে। তাই আপন করতে পারেনি। সত্যি আমি আমার জীবনে কী করলাম জাকির? একটা ছেলেকে মানুষ করতে পারি নাই। 
মুক্তার শাশুড়ি কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। জাকির হতবুদ্ধি হয়ে বিছানায় বসে থাকলো। মায়ের এই রূপ তার একেবারে অচেনা। মা কতটা কষ্ট পেয়েছে তা মায়ের চোখের পানি বলে গেল। জাকির কিছু বলতে যাচ্ছিল মুক্তাকে। কিন্তু মুক্তা তা না শুনে শাশুড়ি মা‘কে খুঁজতে ঘর থেকে বের হয়েই শ্বশুর আব্বাকে দরজার সামনে দেখতে পেল। তিনি মুক্তাকে বললেন- তোমার শাশুড়ি বারান্দায় বসে কাঁদছে। তাকে শান্ত করো। আর আমাকে ক্ষমা করতে বলো। যাও দেখো তোমার শাশুড়িকে।
মুক্তা বারান্দায় গিয়ে দেখে তার শাশুড়ি কাঁদছে। মুক্তা তার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলেÑ আমি জানি এ বাড়িতে আমার একটা মা আছে। যে আমাকে অনেক ভালোবাসে। এতোটা ভালোবাসে জানতাম না। আমি আপনার মতো মা হতে চাই। আমার সন্তান যেন আপনার মতো হয়। তার জন্য আপনার শিক্ষা লাগবে আম্মা। আব্বা আজ তার ভুল বুঝতে পেয়েছে। আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। সত্যি আমার ভাগ্য অনেক ভালো যে আপনার মতো মা পেয়েছি আমি।
মুক্তার শাশুড়ি চোখ মুছে বলে- হয়েছে হয়েছে এতো ফুলাতে হবে না আমাকে। আমার ছেলেকে বেশি জ্বালাবে না। তাহলে তোমাকেও শাসন করতে পারি আমি জানো তো? আজ বাপ ছেলের দুইজনেরই শিক্ষা হলো কি বলো?
বউ শাশুড়ি দুইজনই মুচকি হাসি দিল। তারা দুইজনই জানে এক সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা আর মায়ার অন্য রকম একটা সম্পর্কে তারা জড়িয়ে আছে। একটা সংসারে এমন সম্পর্কের আবদ্ধ থেকে নতুন করে বাঁচতে হবে সবাইকে। এরপর জাকির অবশ্যই তার সন্তানের কথা মাথায় রাখবে। তার মায়ের কথাগুলো তাকে নতুন করে ভাবতে শিক্ষাবে। সুন্দর শিক্ষা পরিবার থেকেই পাওয়া সম্ভব। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসব শিক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।

আজকালের খবর/আরইউ








http://www.ajkalerkhobor.net/ad/1724840661.gif
সর্বশেষ সংবাদ
রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহী জেলেনস্কি: ট্রাম্প
জুলাই-আগস্টের ঘটনায় অনেক বাদী মামলা বাণিজ্য করছেন: ডিএমপি কমিশনার
বাশার আল আসাদের বাসভবনে লুটপাট চালাল জনতা
এক দিনে তিনবার হার, ভারতের দুঃস্বপ্নের মতো দিন
বিক্রম মিশ্রির সফরে বরফ গলতে পারে ঢাকা-দিল্লির
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ইবিতে মারামারি
বৃদ্ধকে বিয়ে, ফুলশয্যার আগে দেনমোহর নিয়ে উধাও যুব মহিলা লীগ নেত্রী!
চিন্ময়সহ ১৬৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা
হঠাৎ এফডিসিতে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা
গভীর রাতে যুবলীগ নেতার বাড়িতে আগুন, মা ও চাচি নিহত
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft