রাইসা। ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনায় ওর বেশ মনোযোগ। রাইসার একটা ছোট ভাই আছে। সে বিশেষ শিশু। স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা করতে পারলে এখন ফাইভ/সিক্স-এ থাকত।
রাইসার বাবা-মা দুজনই চাকরি করেন। তাই রাইসাকে ভাইয়ের দেখাশোনায় সময় দিতে হয়। এতে মাঝে মাঝে কিছু সমস্যা তো হয়ই। হয়তো ওকে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যেতে হবে, কিন্তু ওর বাবা-মা তখনো ফেরেননি। এ কারণে প্রাইভেট টিউটরের কাছে, এমনকি স্কুলেও ওর মাঝে মাঝে লেট হয়। ওর নানী আর খালা ওর ভাইটাকে ঠিক বুঝতে পারে না। তারা বিরক্ত হয়। ছেলেটার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। তখন সে ক্ষেপে যায়। এটা-ওটা ভাঙচুর করে। অনেক সময় নানি আর খালা ছেলেটার গায়ে হাত তোলে। প্রতিবেশী এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনও ছেলেটাকে সহজভাবে নেয় না। কেউ কেউ হাসাহাসি করে, উপহাস করে। মূলত বাবা-মা আর রাইসা ছাড়া কেউ তাকে বুঝতে চায় না।
বাসায় প্রাইভেট টিচার রাখতে পারলে সুবিধা হয়। কিন্তু বাসায় টিচার এলে ওর ভাই পড়ার সময় কাছে যায়, এটা-ওটা ধরে, কথা বলে এতে টিচার বিরক্ত হয়। একবার এক টিচারের নাস্তায় হাত দিয়েছিল, তাকে দেওয়া গ্লাস থেকে পানি খেয়েছিল বলে রাইসা এবং ওর বাবা-মা খুব বিব্রত হয়েছিল। সেদিনের পর সেই টিচার আর পড়াতে আসেননি। সেই থেকে ওরাও আর বাসায় টিচার রাখেনি।
একদিন রাইসা নিতান্তই নিরুপায় হয়ে কাজল স্যারের কাছে পড়তে আসার সময় ওর ভাইটাকে সাথে করে নিয়ে এল। তবে ও খুব সংকুচিত আর চিন্তিত ছিল।
কাজল স্যার রাইসার ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদোর করলেন। কিছু চকলেট, বিস্কুট এবং খেলনা দিয়ে ওকে পেছনের একটা আসনে বসিয়ে দিলেন। আর দিলেন একটা বর্ণ পরিচয়ের বই, একটা খাতা ও পেন্সিল। ছেলেটা অনেক খুশি। আনন্দে আত্মহারা। চকলেট খেতে খেতে বর্ণমালা পড়তে লাগল। কাজল স্যার খাতায় কয়েকটা বর্ণ লিখে ছেলেটাকে লিখতে বললেন। সে একমনে চেষ্টা করতে লাগল। একেবারে শান্ত-সুবোধ ছেলে।
কাজল স্যারের সহানুভূতি দেখে আর সব ছেলেমেয়েরাও ওর প্রতি সহানুভূতি দেখালো। রাইসার সংকোচ দূর হল। ও খুব খুশি হল।
পড়া শেষ হলে কাজল স্যার বললেন-তুমি এখানে পড়তে আসার সময় ওকে সাথে নিয়ে আসবে। ওতো আমাদের কোনো সমস্যা করছে না। আসল কথা হল, ওকে বুঝতে হবে। ও আমাদের কাছে একটু আদর-ভালোবাসা চায়। এটি ওর অধিকার। ওকে এড়িয়ে চললে ও কষ্ট পায় মনে। ওর সাথে সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। বিশেষ শিশুরা কখনোই ঝামেলার না। ওরা আমাদের মতোই সবকিছু বুঝতে পারে। যারা ওদেরকে ঝামেলা মনে করে, বিরক্ত হয় তারা খুবই ভুল। তোমার বাবা-মা যেহেতু জব করেন, তুমি ক্লাশে লেটে না এসে ওকে বরং নিয়ে আসবে, তাতে আমি খুশি হব।
তারপর থেকে রাইসা কাজল স্যারের কাছে পড়তে আসার সময় ভাইটাকে সাথে করে নিয়ে আসে। কাজল স্যার ওর জন্য এটা-ওটা খাবার, খেলনা, বই, খাতা, রঙপেন্সিল এনে রাখেন। ও নিজের মতো পড়ে, লেখে, আঁকে। ক্লাশে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটায় না। ও কাজল স্যারকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। লেখাপড়াও কিছু শিখে ফেলেছে।
পরের মাসে রাইসার মা কাজল স্যারের বেতন দিতে এলেন। বেতন হাতে পেয়ে কাজল স্যার বিস্মিত কণ্ঠে বললেন- ডাবল বেতন কেন?
রাইসার মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন-ডাক্তার, ওষুধ-পত্রে যা হয়নি আপনি আমার ছেলেটাকে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করে দিয়েছেন স্যার। ছেলেটা এই এক মাসে অনেক চেঞ্জ হয়েছে! স্যার, আপনার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।
-ওর জন্য আমাকে বেতন দিতে হবে না। ও যে এখানে আসে এটি আমার জন্য খুব ভালো লাগার। আসলে ওর মতো যারা, তাদের কোনো সমস্যা নাই। সমস্যাটা আমাদের। ওদের মন থাকে অনেক নরম। ওরা আমাদের কাছে একটু বাড়তি আদর, ভালোবাসা, সহানুভূতি আশা করে। আমরা স্বার্থপর হয়ে যাই। ওদেরকে একটু বাড়তি সময়, একটু বাড়তি কিছু দিতে চাই না। আমরা বুঝতে চাই না, আমাদের সন্তান হিসেবে এটি ওর অধিকার।
-স্যার, আপনার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারব না।
-ঋণের কথা আসছে কেন? ও এই দেশের, এই পৃথিবীর সন্তান। দেশ ও পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে ওকে বুকে তুলে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলা করলে আমরাই অপরাধী হব।
রাইসার মা আঁচলে চোখ মুছতে লাগলেন। তার কণ্ঠ রুদ্ধ। তিনি মুখে কোনো কথা বলতে পারছিলেন না।
আজকালের খবর/আরইউ