কৃষিনির্ভর বাংলাদেশকে পরিকল্পিতভাবে তীব্র খাদ্য সংকটে ফেলার জন্য গত ১৫ বছর কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদশে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজসে আমলানিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট এখনো নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বাংলাদেশে ধান, গম, আলু, ভুট্টা, সরিষা, ছোলা এবং নানা ধরনের সবজিসহ খাদ্যের বেশিরভাগ চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছেন কৃষকরা। গ্রাম বাংলার সহজ সরলমনা নিরীহ কৃষকদেরকে সময়মতো মানসম্পন্ন সার ও বীজ সরবরাহ করার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিএডিসি কর্মকর্তাদের। এই সুযোগে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছর ওই সিন্ডিকেট সরকারি গোডাউনে ধারণক্ষমতার ও চাহিদার অতিরিক্ত সার বিদেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। ওই সিন্ডিকেট বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার এবং কৃষি উপদেষ্টাকে বেকায়দায় ফেলার পাশাপাশি কৃষকদের সর্বনাশ করার জন্য নতুন করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ১৫ বছর কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসির কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজসে সিন্ডিকেট অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারি গোডাউনে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি, হাজার কোটি টাকার সার আমদানি করেছে। যার অধিকাংশই খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সার আমদানিতে দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিএডিসির সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেছেন বিএডিসির বৈষম্য ও দুর্নীতি বিরোধী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সময় গড়ে ওঠা বিএডিসির ওই সার সিন্ডিকেটের ব্যবসায়িক ফাঁদে সরকারের আমদানি করা কয়েক হাজার কোটি টাকার সার নষ্ট হচ্ছে। মুন্সিগঞ্জের মোক্তারপুর ঘাটে খোলা আকাশের নিচে আমদানি করা কয়েক লাখ বস্তা সার জমাট বাধা অবস্থায় পড়ে আছে। ব্যবসায়িক সার্থ রক্ষায় ওইসব জমাট বাধা সার মেশিনে ভেঙে আবার নতুন সারের সঙ্গে মিশিয়ে কৃষকের কাছে বিক্রি করার অপচেষ্টা চলছে। এতে করে সারের কার্যকারিতা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির ক্ষতি হওয়ার শঙ্কাও জেগেছে তাতে করে।
অভিযোগ উঠেছে, মুন্সিগঞ্জের মোক্তারপুর ঘাটে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ বস্তা পঁচা-গলা সার পড়ে রয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার গুদাম রক্ষকদের সঙ্গে দফা-রফা করে ওই সার পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে থাকলেও তার রেখে যাওয়া সিন্ডিকেট আরো শক্তিশালী হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. মো. আব্দুল আজিজের স্বাক্ষরে চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি জারি করা এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি ২০২৪ সালে বিএডিসি মেড্ড ও দাউদকান্দি গোডাউন থেকে বরাদ্দকৃত ডিএপি সার সরবরাহ করা হয়। ওই জমাটবদ্ধ হওয়া সারে কৃষকরা আপত্তি জানিয়েছেন, বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এরপর গত ১ অক্টোবর তারিখে বিএডিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদ্দুল্লাহ সাজ্জাদকে ওএসডি করা হয়। বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. নূরুন্নাহার চৌধুরী গত ১৪ অক্টোবর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদে বদলদি করা হয়। কিন্তু তিনি বদলিকৃত ওই দপ্তরে যোগদান করনেনি।
সম্প্রতি মোখলেছুর রহমান নামে বিএডিসির কর্মচারীর দুদকে দাখিল করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুর্নীতি অব্যাহত থাকায় হাজার কোটি টাকা সরকারের লোপাট হয়েছে এবং সাধারণ কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। সারা বছর খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়েছে বিএডিসির আমদানিকৃত লাখ লাখ বস্তা নন-ইউরিয়া সার। আসন্ন বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে পঁচা সার শুকিয়ে ক্রসিং করে নতুন বস্তায় ভরে বিএডিসি গুদামে পাঠাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদাররা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসিনতার কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দুদকের দায়ের করা অভিযোগে আরো বলা হয়, সারা দেশের বিএডিসির গুদামগুলোর ধারণক্ষমতা দুই লাখ ৪০ হাজার থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন সারের। অথচ প্রতিবছর বিএডিসি আমদানী করে ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন সার। ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত সার আমদানি করার কারণে সময়মতো সার পৌঁছে গেলেও গুদামে জায়গার অভাবে বিএডিসি সংশ্লিষ্টরা পুরো সার বুঝে নিতে ব্যর্থ হন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বিএডিসির সিন্ডিকেটের যোগসাজসে কিছু ঠিকাদার পরিবহনের কাজ নিয়ে আমদানি করা ওই সার দীর্ঘদিন ধরে কালো বাজারে বিক্রি করে আসছেন। গত বছরের থাকা প্রায় ২০ লাখ বস্তা ডিএডিসির সার ভিজে নষ্ট হয়েছে। ওই পঁচা সার রোদে শুকিয়ে ভালো সারের সঙ্গে মিশিয়ে বিএডিসির গুদামে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত সরকারের সময় গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, বিএডিসির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুলাহ সাজ্জাদ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সার ও বীজ আমদানী মজুত এবং টেন্ডার পাইয়ে দিতেন। চক্রের অন্যতম হোতা ড. নূরুন্নাহার চৌধুরী এবং তার স্বামী সাবেক জনপ্রশাসন ও বর্তমান সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ে ডেপুটেশনে থাকা অতিরিক্ত সচিব জিয়াউল হক। ড. নূরুন্নাহার চৌধুরী বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। তিনি বিএডিসির ভেতরকার সব ম্যানেজ করেন। আর সরকারের উপর পর্যায় দেখেন তার স্বামী জিয়াউল হক।
অবশ্য সারের সিন্ডিকেট করার অভিযোগ অস্বীকার করেন ড. নূরুন্নাহার চৌধুরী। তিনি বলেন, মুন্সিগঞ্জের মুক্তাপুরে আকাশের নিচে সার আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে অভিযোগ আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব, বিষয়টির খোঁজ নিব। তিনি বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে অনিয়মের কোনো অভিযোগ পাইনি। মূলত আমদানির করার পর সার ঠিকাদারদের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। সারাদেশে ডিলারদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। অনিয়মের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর ঘাটে সার পড়ে থাকা এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া সার নতুন সারের সঙ্গে মেশানোর বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মুন্সীগঞ্জের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা জাকির হোসেন সরকার বলেন, সার সাধারণ চট্টগ্রাম থেকে লাইটার জাহাজে আসে। অনেক সময় সেগুলো জাহাজে থাকতেই বস্তাবন্দি করা হয়। এখানে সারা দেশের জন্যই সার আসে। আমরা শুধু মুন্সীগঞ্জের জন্য আসার সারের বিষয়ে সামগ্রিক সবকিছু দেখতে পারি। সব জেলার বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারে নেই। আমরা দেখতে চাইলেও সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকরা মন্ত্রণালয় কিংবা উপর মহলের প্রসঙ্গ টানেন। তাই আমাদের খুব বেশি করার থাকে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মুন্সীগঞ্জের উপ পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, সার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের। তারপরও আমি বিষয়টি খোঁজ-খবর নিচ্ছি। পরে বিস্তারিত বলতে পারব।
আজকালের খবর/এসআই/আরইউ