প্রকাশ: শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪, ৪:১৮ PM
রত্ন-প্রসবিনী একটি গ্রাম কালিকচ্ছ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার অন্তর্গত পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা, সবুজ শ্যামল গ্রামটি। বিগত প্রায় তিন শতাব্দী সময়ব্যাপী একটি গ্রামে এতগুলো গুণীলোকের জন্মগ্রহণ বিশ্বের বিস্ময়। কালিকচ্ছের মতো গৌরবময় আরেকটি গ্রাম উপমহাদেশে আমরা আজও খুঁজে পাইনি। এ গ্রামে খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে দেওয়ান রামদুলাল নন্দীর মতো ভারতখ্যাত গীতিকার যেমন জন্মগ্রহণ করেছেন তেমনি তৎপুত্র আনন্দ নন্দী সর্বধর্ম সমন্বয় নামক একটি আধুনিক ধর্মীয় মতবাদের স্রষ্টা। তৎপুত্র মহেন্দ্র নন্দী স্বদেশি আন্দোলনের একজন নেতাই ছিলেন না উপমহাদেশে তিনিই প্রথম খদ্দরের কাপড় তৈরি করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন একাধারে স্বদেশি বিপ্লবী, চিকিৎসক এবং প্রকৌশলী। তৎপুত্র বিপ্লবী অশোক নন্দী ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বহুলালোচিত আলীপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বিচারাধীন অবস্থায় কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে মৃত্যুবরণ করেন।
একই গ্রামে কৈলাস সিংহের মতো ইতিহাসকার ও পুরাতত্ত্ববিদও যেমন জন্মেছেন তেমনি জন্মেছেন দ্বিজদাস দত্তের মতো শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। উল্লাসকর দত্তের মতো প্রতিভাবান বিপ্লবী যেমন জন্মেছেন তেমনি জন্মেছেন আধুনিক ব্যাংকিং জগতের প্রাণপুরুষ নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী এ গ্রামেরই সন্তান। এখানে না জন্মেও মামা বাড়ি কালিকচ্ছ বলে অহংকার করেছেন বিশ্ববিশ্রুত লেখক ও পণ্ডিত নীরদচন্দ্র চৌধুরী।
কালিকচ্ছের গৌরবগাথা লিখতে গেলে বইয়ের পর বই হবে। আমার বর্তমান প্রয়াস এ গ্রামে জন্মগ্রহণকারী শুধুমাত্র একজন কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিত তুলে ধরা। আমৃত্যু নিজস্ব যাপিত জীবনের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত সুধীর দাস ১৯৪৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অর্ন্তগত সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সুরেন্দ্র দাস ও মাতার নাম উজ্জ্বলা দাস। কবি জীবনভর তার সেই কালিকচ্ছ তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অর্থাৎ শেকড়ের প্রতি এক গভীর মমত্ববোধের সুতোয় আবদ্ধ ছিলেন। অন্তরের টান ছিল অনুভবের ভেতর। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গদপী গরিয়সীর মতোই তার জন্মগ্রাম কালিকচ্ছে যে শেকড়, সে শেকড়ের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল, আস্থাভাজন ও হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ও অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও প্রেক্ষাপট বিধৃত হয়েছে কবির অনেক কবিতায়।
কবির সামগ্রিক সাহিত্য ভাণ্ডার বিশাল। অসংখ্য কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তিনি তৈরি করে গেছেন। গ্রন্থাকারে সেগুলি প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যের কাব্য ভাণ্ডার আরো সমৃদ্ধ হতো। তারপরও কবির যে ক‘টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলি হলো-‘রোদ বাদলের অনুবাদ’, ‘শঙ্খে সমুদ্রের সুর’, ‘কবিতার সাথে ঘর গেরস্থালি’, ‘রম্যতায় রবীন্দ্রনাথ’, ও ‘সুন্দরকে ভালোবাসা দাও‘। তার প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কাব্য ভাণ্ডারের মধু-রস আস্বাদন করা সময় সাপেক্ষ বিষয়। এখানে স্থানাভাবের বিষয়টির দিকেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেছি। তা ছাড়া কবির সামগ্রিক রচনা পাঠেরও স্বল্পতা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও সুধীর দাসকে যতটুকু জেনেছি তাতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ওই সবের অর্ন্তগত গূঢ়তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়াসে আমার আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো-তার অসংখ্য কবিতা সত্যিকার অর্থেই পাঠের বিষয় বলে কবিতা বোদ্ধাদের কাছে প্রতীয়মান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কবিতার সাথে ঘর গেরস্থালির কবি সুধীর দাস ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার সল্টলেকে দেহত্যাগ করেন। সেখানকার রাজঘাট শ্মশানে তার মরদেহ দাহ করা হয়েছিল।
আজকালের খবর/আরইউ