মঙ্গলবার ২২ এপ্রিল ২০২৫
মহা মিলনের বন্ধনে দুর্গাপূজা
রূপম চক্রবর্ত্তী
প্রকাশ: সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৪, ৮:১৮ PM
লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,  কিশোর কুমার, মান্না দের আধুনিক গানগুলো শুনে পূজার সকাল শুরু হত। পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করতাম। বন্ধুরা অনেকেই নতুন নতুন জামা জুতো কিনে দেখাত। আমিও বন্ধুদের আমার নতুন জামা দেখাতাম। বাবা পূজার সময় নতুন কাপড় কিনেছে কিনা আমার জানা নেই। ছেলে-মেয়েদের দিতে পারলেই তিনি আনন্দ অনুভব করতেন। সন্তানের প্রতি একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের  বাবার যে দরদ এই পূজার কেনাকাটার মাধ্যমে তা অনেকটা অনুমান করা যায়। মা দুর্গা  কখনো জগৎকে চালান ও প্রতিপালন করেন জগদ্ধাত্রী রূপে, আবার কখনো প্রলয়কালে তিনিই হয়ে উঠেন প্রলয়ংকারী দেবী কালিকা। বহু শক্তির সম্মিলনে মা আসেন প্রতি বছর এই পৃথিবীতে। মায়ের চারদিকে থাকালে সে চিত্র ফুটে ওঠে। মা দুর্গার ডান দিকে তার জ্যেষ্ঠ কন্যা লক্ষ্মী ও জ্যেষ্ঠ পুত্র গণেশ। বাম দিকে কনিষ্ঠ পুত্র কার্তিক ও কনিষ্ঠ কন্যা সরস্বতী এবং ওপরের চালচিত্রে স্বামী শিব। 

অষ্টমী তিথিতে মায়ের সাথে চৌষট্টি যোগিনীরও পূজা হয়। চিন্ময়ী দুর্গার নানা মূর্তিও ভেতরই এই যোগিনীদের আত্মপ্রকাশ। দুর্গাঘটের নিম্নে যে অষ্টদল পদ্ম অঙ্কিত হয় তার প্রতি দলে আটটি করে মোট চৌষট্টি যোগিনী পূজার বিধান আছে।  চৌষট্টি  যোগিনীর বিভিন্ন নাম, যথা- ১. ব্রহ্মাণী, ২. চণ্ডিকা, ৩. রৌদ্রী, ৪. গৌরী, ৫. ইন্দ্রাণী, ৬. কৌমারী, ৭. ভৈরবী, ৮. দুর্গা, ৯. ইারসিংহী, ১০. কালিকা, ১১. চামুণ্ডা, ১২. শিবদুতী, ১৩. ঊারাহী, ১৪. কৌশিকী, ১৫. মাহেশ্বরী, ১৬. শঙ্করী, ১৭. জয়ন্তী, ১৮. সর্বমঙ্গলা, ১৯. কালী, ২০. করালিনী, ২১. মেধা, ২২. শিবা, ২৩. শাকস্তুরী, ২৪. ঋীমা, ২৫. শাস্তা, ২৬. ভ্রামরী, ২৭. রুদ্রাণী ২৮. অম্বিকা, ২৯. ক্ষমা, ৩০. ধাত্রী, ৩১. স্বাহা, ৩২. স্বধা, ৩৩. অপর্ণা, ৩৪. মহােদরী, ৩৫. ঘোররুপা, ৩৬. মহাকালী, ৩৭. ভদ্রকালী, ৩৮. কপালিনী, ৩৯. ক্ষেমঙ্করী, ৪০. উগ্রচণ্ডা, ৪১. চন্ডা, ৪২. চণ্ডনায়িকা, ৪৩. চামুণ্ডা, ৪৪. চণ্ডবতী, ৪৫. চণ্ডী, ৪৬. মহামোহা, ৪৭. প্রিয়ঙ্করী, ৪৮. বলবিকরিণী, ৪৯. বলপ্রমথিনী, ৫০. মদমোন্মথিনী, ৫১. সর্বভূতদমনী, ৫২. উমা, ৫৩. তারা, ৫৪. মহানিদ্রা, ৫৫. বিজয়া, ৫৬. জয়া, ৫৭. শৈলপুত্রী, ৫৮. চণ্ডিকা, ৫৯. চন্দ্রঘণ্টা, ৬০. কুষ্মাণ্ডা, ৬১. স্কন্দমাতা, ৬২. কাত্যায়নী, ৬৩. কালরাত্রি ও ৬৪. মহাগৌরী।

মাতৃ পূজায় আবার মহিষাসুরের পূজাও হয়ে থাকে। এই এক অনুপম বার্তা যেখানে মা দুর্গা তার ভালো খারাপ সব সন্তানের প্রতি মমতার সাগর। যেখানে প্রেমহীন নির্দয় শূন্যমরুভূমিতে অশুভ অহংকারী শক্তির প্রেত নৃত্য চলছে, সম্পদ মারণাস্ত্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। যেখানে মানুষের প্রচেষ্টা প্রেমার্দ্র দুঃখ মোচনী প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়ায় বিনিযুক্ত হচ্ছে না সেখানে ছড়িয়ে দিতে হবে মায়ের গুণকীর্তন। মায়ের আগমনী বার্তা আমাদের শুভ শক্তি জাগ্রত করার প্রেরণা যোগায়।  সুর অসুরের দ্বন্ধ চিরকাল দেখা যায়।  দেবতাগণ অসুরের নিকট পরাজিত হয়ে রাজ্যহারা হন। স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে দেবতারা যখন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা সুর শক্তির আগমনের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। দেবতাদের থেকে আমরা মহামিলনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। সামাজিক ঐক্য স্থাপনের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। ঐক্য স্থাপনের জন্য প্রয়োজন সকল সুর শক্তির ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নতুবা অশুভ শক্তির পাদুর্ভাব ঘটবে।

এই অশুভ শক্তির প্রতীক মহিষাসুর নারীরূপী মহাশক্তি দুর্গার মোহে মোহিত হয়ে মা দুর্গাকে উগ্রভাবে কামনা করেছিল। এই পাশবিক ভোগেচ্ছা মহিষাসুরকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে নিধন করে। দুর্গা শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যেÑ দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ/উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত/রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।

অর্থাৎ, দ- দৈত্য বিনাশ করে, উ-কার- বিঘ্ন নাশ করে, রেফ- রোগ নাশ করে, গ- পাপ নাশ করে এবং অ-কার- শত্রু নাশ করে। এর পরিপূর্ণ অর্থ হলো যেÑ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম বলেছে, দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা। যিনি দুর্গ নামক অসুরকে বধ করেছিলেন, তিনি সব সময় দুর্গা নামে পরিচিত। শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যেম্ অনুসারে যে দেবী- নিঃশেষ দেবগণ শক্তি সমূহ মূর্ত্যাঃ সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি, তিনিই দুর্গা।

বর্তমান সমাজে ভোগবাদী মানুষের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা পরনারী লোলুপ।  তাদের হাতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা জানেনা নারীকে জোরপূর্বক অপহরণ করে ভোগ করলে পরিনামে অনেক দুর্দশা ভোগ করতে হয়। কারণ নির্যাতিত মানুষগুলো যখন সম্মিলিতভাবে মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করবে তখন  ভোগবাদী আসুরিক শক্তির মানুষ পরাজয় হবে। দুর্গাপূজার কাঠামো বিন্যাস করলে এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার একটা চিত্র চোখে পড়বে। মা দুর্গার পাশে দেখা যায় জ্ঞানদাত্রী স্বরসতী, ধনদাত্রী লক্ষ্মী, প্রশাসনের প্রতীক দেবসেনা কার্তিক, সিদ্ধিদাতা গণেশ, মঙ্গলের প্রতীক শিব, কৃষি ও শিল্পের প্রতীক কলাবৌ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, বীর্য দেহো ক্ষুদ্র জনে/না করিতে হীনজ্ঞান, বলের চরণে/না লুটিতে। বীর্য দেহো চিত্তেরে একাকী/প্রত্যহের তুচ্ছতার ঊর্ধ্বে দিতে রাখি/বীর্য দেহো তোমার চরণে পাতি শির/ অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।

সকল পূজার্থী ভাই বোনদের মধ্যে যারা তরুণ প্রজন্ম আছেন তাদের প্রতি অনুরোধ মা দুর্গাকে শ্রদ্ধা ভক্তির পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় খেয়াল রেখে চলার চেষ্টা কর। আমাদের ধর্ম মা বাবাকে সম্মান করতে বলেছেন। ধর্ম আরো বলেছেন মা বাবার প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করার জন্য। প্রেম বা ভালবাসা নামক দুটি শব্দের নাম দিয়ে আমরা যেন মা বাবাকে ভুলে না যাই। যে মা বাবা পরম স্নেহ মমতায় নিজের সন্তানদের গড়ে তুলেন সে সন্তান বড় হওয়ার পর যদি  মা বাবাকে ত্যাগ করে  অপরের হাত ধরে চলে যায় তাহলে আমার মনে হয় সন্তানটি মা বাবার সাথে বড় প্রতারনা করেছেন। আমাদের প্রত্যেক সন্তানদের জানতে হবে আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন মা বাবা খুব কষ্ট করে আমাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। নিজের সন্তানের মংগল কামনার জন্য অনেক মা বাবা দিনের পর দিন কষ্ট করে দিনাতিপাত করেন। সামান্য চাহিদা মিটানোর জন্য নিজের মা বাবাকে কষ্ট দেওয়া মোটে ও কাম্য নয়। 

কিছুকিছু  ছেলেমেয়ে অথবা ছাত্রছাত্রীদের দেখা যায় সাময়িক উত্তেজনাবশত তারা মা বাবাকে না চেনার মতো  সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ উচিত নয় বলে আমি মনে করি। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে। সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করা কাম্য নয়। ইদানিং কালের অসংখ্য মোবাইল প্রেম দেখেছি যেখানে দেখা গেছে অনেক মেয়েকে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয়েছে। পালিয়ে যাওয়ার পর মেয়েটির উপর অকথ্য নির্যাতন করে মানসিক ক্ষমতা নষ্ট করার কথাও শোনা যায়। অনেক ছেলেরাও বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। তাই আমি বলব নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক রাখতে হবে। নিজের মা বাবার উপর শ্রদ্ধা রাখতে হবে। নিজের ভবিষ্যতকে অবশ্যই উজ্জ্বল করতে হবে। চলুন মায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়েই এগিয়ে চলি।
 
লেখক : সনাতন ধর্মীয় বক্তা, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

আজকালের খবর/আরইউ 








সর্বশেষ সংবাদ
শেখ হাসিনা ও টিউলিপকে দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু: দুদক কমিশনার
ঢাবিতে ১ বছরে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ
স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সংবাদ সম্মেলন
২ দফা দাবি নিয়ে প্রশাসন ভবনে তালা ইবি শিক্ষার্থীদের
হাসনাতের কড়া হুঁশিয়ারি, দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের দখল ছাড়লো বিএনপি
সরিয়ে দেওয়া হলো দুই উপদেষ্টার দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে
বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের ১১৬ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার
বরিশালে র‌্যাবের ওপর হামলা, গুলিতে মাদক ব্যবসায়ী নিহত
মেজর সিনহা হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু আগামীকাল
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft