আত্মরক্ষার নাম করে ৩৬৫ দিন ধরে গাজায় গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়াখ্যাত দখলদার ইসরাইল। উপত্যকাটির বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন আর নিষ্পেষণের মাত্রা যেন সব মাপকাঠি ছাড়িয়ে গেছে। তেলআবিবের হামলায় শত শত অবুঝ শিশু মা-বাবাকে হারিয়েছে! একের পর এক নির্মম ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট আর বোমা হামলায় সন্তানহারা হয়েছেন অসংখ্য বাবা।
কতটা অমানবিক হলে মানুষ মসজিদে হামলা করতে পারে! হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিতে পারে! নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে গোটা একটি গ্রাম! তা ইসরাইলের আগ্রাসন না দেখলে বোঝা দায়।
গাজায় হামাস নিধনের নামে তথাকথিত সামরিক অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার। ঘরছাড়া হয়েছেন গাজার প্রায় সব মানুষ।
ইসরাইলের এ ন্যক্কারজনক হামলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিলিস্তিনপন্থি মানুষ। রাস্তায় নেমেছেন গাজায় হামলা বন্ধের দাবিতে। হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা আর মুখে মুক্তির স্লোগান। মুক্তি চায় ইসরাইলের শেকল থেকে।
দেশে দেশে এ আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরেছে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা।
ইন্দোনেশিয়ায় জেগে ওঠার আহ্বান
ইসরাইলে অস্ত্র পাঠানো বন্ধের দাবিতে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় মার্কিন দূতাবাসের বাইরে জড়ো হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারী।
এক বিক্ষোভকারী বলেন, আমরা বিশ্বের সব নেতাকে জেগে ওঠার এবং ইসরাইলের নিপীড়ন থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি। এই আগ্রাসন এখন আর ধর্মীয় ইস্যু নয়, সত্যিকার অর্থে একটি মানবিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘আমরা সবাই ফিলিস্তিনি’ স্লোগান
‘ইসরাইল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ এবং ‘আমরা সবাই ফিলিস্তিনি’ এমন স্লোগানে মুখরিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন। স্লোগান দিতে দিতে রোববার শত শত মানুষ পার্লামেন্টের দিকে হেঁটে যান।
আগামীকাল সোমবার জোহানেসবার্গ ও ডারবানেও গাজার সমর্থনে মিছিলের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ইতালিতে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ
ইতালির রাজধানী রোমে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করেছে। ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন, ফ্রি লেবানন’ স্লোগান দিয়ে কয়েক হাজার মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করেছেন শহরটিতে।
ফিলিস্তিনি পতাকা উড়িয়ে অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় হাতে ছিল নানা লেখা সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড।
নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও একটি ছোট দল সমাবেশটি শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করা পর্যন্ত সমাবেশটি শান্ত ছিল। কিছু বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েকজন কালো পোশাক পরে এবং মুখ ঢেকে পুলিশের দিকে পাথর, বোতল এবং কাগজ বোমা নিক্ষেপ করেন। এরপরই সহিংসতা বেড়ে যায়। টিয়ার গ্যাস এবং জলকামান দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় পুলিশ। অবশেষে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত ৩০ সদস্য ও তিন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন বলে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে।
লন্ডনে বিশাল সমাবেশ
গাজায় হামলা বন্ধে গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে লন্ডনে। প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারী সেন্ট্রাল লন্ডনে মিছিল করেছেন।
লন্ডনে বিক্ষোভকারী অ্যাগনেস কোরি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সদিচ্ছা সত্ত্বেও ইসরাইলি সরকার থামছে না। তারা গাজায় নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছে। এখন লেবানন, ইয়েমেন এবং সম্ভবত ইরানের দিকেও এগোবে তারা।
আর আমাদের সরকার, আমাদের ব্রিটিশ সরকার দুর্ভাগ্যজনকভাবে শুধু মুখের কথা বলছে এবং ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে ডাবলিনে কয়েকশ মানুষ রাস্তায় নেমে ফিলিস্তিনি পতাকা নেড়ে ‘এখনই যুদ্ধবিরতি’ বলে স্লোগান দিয়েছেন।
ফ্রান্সে আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কা প্রকাশ
ফ্রান্সের প্যারিস, লিয়ন, তুলুজ, বোর্দো ও স্ট্রাসবুর্গে হাজার হাজার মানুষ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে বড় মিছিল করেছেন।
লেবানিজ-ফরাসি বিক্ষোভকারী হুসাম হোসেইন প্যারিসে রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। কারণ এ মুহূর্তে ইরানের সঙ্গে এবং সম্ভবত ইরাক ও ইয়েমেনের সঙ্গেও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, আমাদের সত্যিই যুদ্ধ বন্ধ করা দরকার। কারণ এটি এখন অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
প্যারিসের রিপাবলিক প্লাজায় বিক্ষোভস্থল থেকে আল-জাজিরার সংবাদদাতা নাতাচা বাটলার বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলায় বিক্ষোভকারীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ভয়াবহতা থামাতে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়।
নাতাচা জানান, মানুষ ভাবছেন, ফ্রান্স বেসামরিক নাগরিক এবং সত্যিকার অর্থে দুর্ভোগে থাকা লোকদের রক্ষায় যথেষ্ট কাজ করছে না।
স্পেনে ইসরাইলকে বয়কটের ডাক
মাদ্রিদে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। এ সময় তারা ‘ইসরাইলকে বয়কট কর’ লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেন।
ইসরাইলকে অস্ত্র ও সহায়তা সরবরাহ বন্ধের দাবিতে শনিবার হোয়াইট হাউসের বাইরে এক হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারী বিক্ষোভ করেন।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি বিক্ষোভে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে পথচারীরা ও পুলিশ আগুন নিভিয়ে ফেলার আগে তার বাম হাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
জাতিসংঘে পিটিশন দায়ের ভেনেজুয়েলার
ভেনেজুয়েলার কারাকাসে শত শত ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারী জাতিসংঘের আঞ্চলিক সদর দপ্তরের বাইরে বিশাল ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। তারা ফিলিস্তিনিদের ‘গণহত্যা’ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে একটি পিটিশনও দায়ের করেছেন।
ফিলিপাইনে বিক্ষোভে বাধা
গাজায় হামলা বন্ধের দাবিতে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় বেশ কয়েক ডজন বামপন্থি কর্মী মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। তবে এ বিক্ষোভে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুলিশ।
সুইজারল্যান্ডে বিক্ষোভ ঘিরে কঠোর পাহারা
সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা কিস্টোন-এটিএস নিউজ এজেন্সি।
শত শত ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভকারী এথেন্সে ইসরাইলি দূতাবাসের দিকেও মিছিল করেছেন। তবে যেখানে পুলিশ কঠোরভাবে পাহারা দিচ্ছিল।
জার্মানিতে গণহত্যা বন্ধের স্লোগান
জার্মানির উত্তরাঞ্চলীয় শহর হামবুর্গে অন্তত ৯৫০ জন লোক ফিলিস্তিনি ও লেবাননের পতাকা উড়িয়ে ‘গণহত্যা বন্ধ কর’ বলে স্লোগান দেন।
ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে রোববার আরও সমাবেশ ও মোমবাতি মিছিলের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আজকালের খবর/ এমকে