বৃহস্পতিবার ১০ অক্টোবর ২০২৪
বিশ্বজুড়ে বাড়ছে প্রবীণ
অলোক আচার্য
প্রকাশ: সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৮:০৩ PM
বিশ্বজুড়েই বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে বিজ্ঞানের কল্যাণে রোগ-শোক জয় করেই মানুষ দীর্ঘজীবি হচ্ছে। এর ফলে বিশ্বে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে জাপানে। প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। প্রবীণ বা বয়স্করা হচ্ছেন সেই সকল অভিজ্ঞ ব্যক্তি যারা আমাদের পথ চলায় নির্দেশনা দেন, উপদেশ দেন। যারা হচ্ছেন একেকজন জীবনাদর্শে অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং যারা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের উপকৃত করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে প্রবীণ ব্যক্তি বা সিনিয়র সিটিজেন হলেন আমাদের পথ প্রদর্শক।

তারা সর্বদাই আমাদের মঙ্গল কামনা করেন। এ প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ীদের নির্বাচিত প্রবন্ধ গ্রন্থে রিগোবার্তা মেনচু তার বলেছেন, আমাদের বয়োজ্যষ্ঠ ব্যক্তিরা শুধু যে প্রাজ্ঞতা, আশা এবং সাংস্কৃতিক সমার্থক তাই নন, তারা আমাদের ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিতও করেন এবং অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকারীও হন। বৃষ্টি এবং ধরিত্রী যে পুত্রের জন্ম দিলেন সে শুরু করে দেয় একটা অভিজ্ঞতার তীর্থযাত্রা। বয়োজ্যেষ্ঠরা যেকোনো ব্যক্তির জীবনের প্রত্যেকটি পর্যায়কে, তার চরিত্রের সাধুতাকে শ্রদ্ধা করে চলেন। তারা যেকোনো ব্যক্তির ভুলভ্রান্তি ও আচার-আচরণের ধরন ও তাৎপর্য এবং তার নিয়তির সূত্রকে শনাক্ত করে থাকেন যতোদিন না ওই ব্যক্তি নিজেই বড় হয়ে উঠে এবং বয়োজ্যেষ্ঠতে পরিণত হয়। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরাই হলেন আমাদের বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞতা, তারা হলেন আমাদের ইতিহাসগ্রন্থ আমাদের গ্রন্থাগার যাদের কাছে আমরা পরামর্শ চাই এবং উপদেশ নেই এবং সর্বোপরি আমরা তাদের প্রতি গভীর আস্থা রাখি। বৃদ্ধ মানুষেরা হলেন গভীর ও বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী এবং তারা আমাদের মর্যাদা সুনিশ্চিত করেন।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, জাতিসংঘ একে ‘ইরিভারসিবল গ্লোবাল ট্রেন্ড’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এর অন্যতম কারণ হলো আয়ু বৃদ্ধি ও ছোট পরিবার। জাতিসংঘের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ৬৫ বছর ও তার অধিক বয়সের জনসংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ১৬০ কোটিতে দাঁড়াবে। জাপানে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি। কারণ একদিকে যেমন বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে খুব কম দম্পতিই সন্তান নিতে আগ্রহী। জুন মাসের শুরুর দিকে জানানো হয়, জাপানে ধারাবাহিকভাবে আট বছর জন্মহার কমেছে। ২০২৩ সালে রেকর্ড নিম্ন জন্মহার দেখে দেশটি। জন্ম হয় মাত্র সাত লাখ ২৭ হাজার ২৭৭ শিশুর। এশিয়ায় বয়স্ক জনসংখ্যার ক্ষেত্রে শুধু জাপানেই সমস্যা নয়, দক্ষিণ কোরিয়াও এক্ষেত্রে সংকটে রয়েছে। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে নারীর প্রতি শিশুর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৭২। সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি নতুন মন্ত্রণালয়ও চালু করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। জন্মহার কমেছে হংকং, চীন ও তাইওয়ানেও। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়ার অন্তত ছয়টি দেশ ৬৫ বা তার অধিক বছরের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে থাকবে। এ ক্ষেত্রে শীর্ষে থাকতে পারে হংকং। তা ছাড়া ২১০০ সালের মধ্যে আফ্রিকাই হতে পারে একমাত্র অঞ্চল যেখানে সিনিয়র সিটিজেনের সংখ্যা হতে পারে ১৫ শতাংশের কম। এ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে ইউরোপ, উত্তর আমেরিক, দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে।

মানুষ জন্ম নেওয়ার পর থেকে ক্রমেই বেড়ে ওঠে। সমাজের নানা ঘাত প্রতিঘাত, সুখ, দুঃখের নানা পথ পাড়ি দিয়ে কিশোর ও যৌবন পার দিয়ে জীবনের ক্রান্তি লগ্নে পৌঁছে। একসময় শরীরে বার্ধক্য আসে। কমে আসে কার্যক্ষমতা। সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিটি মানুষের জীবনেই এই চক্র আবর্তিত হয়। আজ আমাদের মা বাবা প্রবীণ ব্যক্তি। আগামীকাল আমার জন্য এই সময়টি অপেক্ষা করছে। তারপর আমার সন্তানরা। প্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদেও ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে বাইরের কাজে। সেই একসঙ্গে দুপুরে বা রাতে মা, বাবা, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার সময়টুকুও আজ যেন অতীত হয়ে গেছে। আগেকার একান্নবর্তী পরিবাওে দেখা যেত পরিবারে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ তাদের নির্দেশক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো এবং সবাই তা মেনে চলতো। কিন্তু আজ সে একান্নবর্তী পরিবার নেই। নেই সেই পাবিারিক বন্ধন। মা বাবার সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে ছেলেমেয়ের। অনেক পরিবারেই তাদের বোঝা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। কর্মক্ষমতা হারিয়ে একসময় পরিবারের কাছেই নিজেকে বড় অযাচিত মনে করেন তারা। অথচ এই তারাই কিন্তু একসময় নিজেদের সবটুকু উজাড় করে আমাদের বড় করেছেন। পারিবারিক বন্ধন যত আলগা হচ্ছে বৃদ্ধ হওয়ার এই সময়টি বর্তমান সমাজে ক্রমেই একাকিত্ব ও একঘেয়েমীপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাদের অনেকেই অবাঞ্চিত ও অবহেলিত চোখে দেখে। সাময়িক যৌবনের অহংকারে অবহেলা করতে শুরু করি এক অমোঘ সত্যকে। আমরা মেনে নিতে পারি না একসময় আমাদের এই সময় আসবে। হয়তো বা যৌবনের অহংকার আমাদের সাময়িক অন্ধ করে দেয়। আমরা অস্বিকার করি যে তারাও জ্ঞান ও বিজ্ঞানের এক শ্রেষ্ঠ সমন্বয়। শুধু টাকা দিয়েই তাদের মূল্যায়ন করা যায় না। তাদের সারা জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আমাদের আগামী জীবনের পথ প্রদর্শক।

আজকাল আধুনিক সমাজে আমরা যতটা এগিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের প্রসন্ন দরজাগুলো মনে হয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বৃদ্ধাশ্রম নামে একটি শব্দ এখন আমাদের আজ অপরিচিত নয়। আমরা জানি সেখানে বৃদ্ধদের (অসহায়) রেখে আসা হয়। কিন্তু যাদের ছেলেমেয়ে বর্তমান আছে তাদেরও কি আমরা অসহায় বলতে পারি। আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন তো তারা আমাদের শিশু নিবাসে রেখে আসেনি। তারা তো আমাদের বোঝা মনে করে না। কিন্তু আমরা সেই কাজটি করি। আমাদের দেশে আজ অনেক বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। জনপ্রিয় গায়ক নচিকেতার কণ্ঠের সেই- ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার, শিরোনামে যে গানটি আমাদের মনে দাগ কেটে যায় তা তো এই হতভাগ্য প্রবীণদের উদ্দেশ্যেই লেখা। যারা তাদের সারাটি জীবন নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে বড় করেছেন, অফিসার করে গাড়ি বাড়ি চড়ার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন তাদেরই শেষ জীবনের ঠিকানা হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে। প্রতি বছর অনেক সন্তান তাদের বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি বছরে একবার দুবার পোষাক বা খাবার পাঠিয়ে অথবা একবার দেখা করেই দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে। ধিক এসব সন্তানকে। জানি না শেষ জীবনে এদের ভাগ্যে কী ঘটবে। এরা তো এটিও জানে না যে মা বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে বোঝা মনে করে এই একাকী জীবনে ফেলে দিয়ে গেছে সেই মা বাবাই দিন রাত ওই বদ্ধ ঘরে বসে সেই সন্তানের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে যেন তার সন্তান শেষ জীবনে এই পরিণতি বরণ না করে। 

প্রবীণ ব্যক্তিরা সর্বদা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ব্যক্তি। সর্বদা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করাই আমাদের কাজ। আমাদের উচিত তাদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে। যাতে সেই শিক্ষা নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করে নিজেদের ভালো করতে পারি। বয়স হলেও তার আর করার কিছুই নেই একথা ভেবে তাকে ছোট করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং তার শেষ জীবনটি আনন্দের করে তুলতে পারাই আমাদের কাজ হবে। আমাদের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে সেই শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। যা সহবতের অংশ। আগে দেখেছি রাস্তাঘাটে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ দেখলে তাদের দেখে ছোটরা সম্মান জানাতো। প্রবীণরা যেখানে থাকতো সেখানে অল্পবয়স্করা থাকতো না। আজকাল আর সেসব খুব একটা দেখা যায় না। পরিবার থেকেই ছোটবেলা থেকেই এসব শিক্ষা দিতে হয়। এসব ভুলতে বসেছি বলেই আমাদের আজ এই অবস্থা। আমাদের সর্বদা মাথায় রাখতে হবে আজ আমরা যে আচরণ শেখাবো ভবিষ্যতে আমরা বড় হলে সেই আচরণ ফেরত পাব।  

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

আজকালের খবর/আরইউ








http://www.ajkalerkhobor.net/ad/1724840661.gif
সর্বশেষ সংবাদ
অবসরে আইন সচিব গোলাম রব্বানী
গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪২ হাজার ছাড়াল
দুর্গাপূজায় বিএসএফকে মিষ্টি দিলো বিজিবি সদস্যরা
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা আজ
আজ মহাসপ্তমী
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
৪ দফা দাবিতে সচেতন নাগরিক সমাজ নেতৃবৃন্দের সমাবেশ
বেরোবিতে চাকরি পেলেন আবু সাঈদের বোন
টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা মারা গেছেন
অজ্ঞাত স্থান থেকে হারুন, ‘আমাকে ভুল বোঝার অবকাশ নেই’
এইচএসসির ফল জানতে পারবেন যেভাবে
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft