জাতিসংঘের কর্মকর্তা হিসেবে আমি ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে কর্মরত ছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক পরিবর্তন ও উত্থান-পতন দেখেছি। কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে এখনো শিউরে তোলে, সেটা হচ্ছে ‘মব ট্রায়াল’। একটি মব ট্রায়ালের ঘটনা বিশেষভাবে মনে পড়ে।
আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ফারখুন্দা মালিকজাদা নামে ২৭ বছর বয়সী শিক্ষিত আফগান নারীকে ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছিল উত্তেজিত জনতা। তাদের অভিযোগÑ ফারখুন্দা কোরআন পুড়িয়েছেন। এ জন্য তাকে যত দ্রুত সম্ভব ‘জাহান্নামে পাঠাতে’ হবে।
ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ হয়েছিল। সে কারণেই সম্ভবত পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের এবং ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। বিচারকালে জানা যায়, কোরআন পোড়ানোর অভিযোগটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা। বাস্তবে স্থানীয় এক মোল্লার সঙ্গে অন্য বিষয়ে তর্ক হয়েছিল ফারখুন্দার। তাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য ওই মোল্লা ও তার অনুসারীদের পক্ষে ফারখুন্দার কোরআন পোড়ানোর মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়। সেটি শুনেই জনতা ফারখুন্দাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
ফারখুন্দা হত্যা মামলার রায়ে তিন আসামিকে ২০ বছর এবং আটজনকে ১৬ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আফগানিস্তানে এমন আরো অনেক ‘মব ট্রায়াল’ ঘটেছে, যেগুলোর বিচার দূরে থাক, মামলা পর্যন্ত হয়নি। আরো দুর্ভাগ্যজনক, যখন কোনো একটি এলাকায় মব ট্রায়াল ঘটেছে, পরপর আরো কয়েকটি ঘটেছে একই কায়দায়। অনেকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক শত্রুতার প্রতিশোধ নিয়েছে এভাবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি ‘মব ট্রায়াল’ ঘটেছে। অন্তত একজন জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। ঘটনার শিকার রাজশাহীর আব্দুল্লাহ আল মাসুদ একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। জানা যায়, ১০ বছর আগে ইসলামী ছাত্রশিবিরের হামলায় তিনি ডান পা হারান। তখন থেকে একটি কৃত্রিম পা নিয়ে চলতেন। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর কন্যাসন্তানের বাবাও হয়েছিলেন। ঘটনার দিন তিনি নবজাতকের জন্য ওষুধ কিনতে স্থানীয় বাজারে গেলে তাকে নির্মমভাবে মারধর করে প্রথমে মতিহার, পরে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে যায় কিছু জনতা। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সেনাবাহিনীর সহায়তায় রামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়; সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি বগুড়ার। আলোচিত ইউটিউবার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম একটি মামলা করতে গিয়েছিলেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। মামলা করার পর আদালত চত্বরেই উত্তেজিত জনতা তাকে বেধড়ক মারধর এবং কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য করেছে। অভিযোগ, তিনি বিএনপি নেতার নামে নাকি কটূক্তি করেছেন।
এর আগে খুলনায় উৎসব মণ্ডল নামে এক হিন্দুধর্মীয় কিশোরকে স্থানীয় লোকজন, যার অধিকাংশই মাদ্রাসার ছাত্র- মারধর করে গুরুতর আহত করে। অভিযোগ, ওই কিশোর হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে কটূক্তি করেছে। আহত অবস্থায় স্থানীয় থানায় আশ্রয় নিলে সেখানেও উত্তেজিত জনতা ঢুকে তাকে মারধর শুরু করে। তার কথিত মৃত্যুসংবাদ মাইকে প্রচার হওয়ার পরই কেবল জনতা সরে যায়। পরে জানা যায়, ছেলেটি মারা যায়নি।
উল্লিখিত ঘটনাগুলো ছাড়াও গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো মব ট্রায়ালের খবর পাওয়া গেছে। অনেক জায়গায় ছাত্রছাত্রী বহু শিক্ষককে অপমান-অপদস্থের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গলায় জুতার মালা পর্যন্ত পরানো হয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে; দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘মব ট্রায়াল আতঙ্ক’ বিরাজ করছে। নিরীহ অরাজনৈতিক মানুষ পর্যন্ত ঘর থেকে বেরোতে দু’বার চিন্তা করে- না জানি কখন গত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, এমন অভিযোগে মব ট্রায়ালের শিকার হতে হয়!
হতে পারে, কারো কারো অতীতের কোনো কোনো কর্মকাণ্ড বিতর্কিত ছিল কিংবা কেউ কেউ পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। তাই বলে তাদের ওপর চড়াও হওয়ার অধিকার রাষ্ট্র কাউকে দেয়নি এবং তার কোনো যৌক্তিকতাও নেই। দেশে আইন আছে, আদালত আছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যে কেউ আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। তা না করে বিচারের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিলে রাষ্ট্র কখনো সামনে এগোতে পারবে না।
এটি ঠিক, কোনো দেশে বিপ্লব বা অভ্যুত্থান সাধিত হলে প্রথম কিছুদিন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে থাকে। সেই ফরাসি বিপ্লবকালের ইউরোপ থেকে একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু একে বল্গাহীন ছেড়ে দেওয়া যায় না। যদি দেওয়া হয়, তা হবে আত্মঘাতী। এ ধরনের ‘মব ট্রায়াল’ কীভাবে একটি দেশের সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নাজুক করে তুলতে পারে, সেই চিত্র আমি আফগানিস্তানে স্বচক্ষে দেখেছি। আর বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তির ভয় পাচ্ছি।
মনে রাখতে হবে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নানা কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলে চিড় ধরে আছে, যা স্বাভাবিকতায় ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। এ অবস্থায় যদি সবাই আইন নিজের হাতে তুলে নিতে চায়, তাহলে যে স্বপ্ন নিয়ে মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। পরিণতিতে দেশ আপতিত হবে গভীরতর সংকটে, যা ধীরে ধীরে পরিণত হবে এক অকার্যকর রাষ্ট্রে। আফগানিস্তানে সেটিই ঘটেছিল।
মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বা গুজব ও ধারণার বশবর্তী হয়ে কারো ওপর আক্রমণ বিশ্বজনীন মানবাধিকারের পরিপন্থি। গণতন্ত্র ছাড়া যেমন মানবাধিকার বিকশিত হতে পারে না; মানবাধিকারকে পাশ কাটিয়ে তেমনি গণতন্ত্রকেও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। মব ট্রায়াল স্পষ্টতই মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অনেক সময়ই এর ভিত্তি যুক্তিহীন আবেগ, যা মানুষকে বিচারশক্তিহীন করে তোলে। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর ফল হয় ভয়াবহ। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে মব ট্রায়ালের মতো অস্থিরতা ও অসুস্থতা ভূরাজনৈতিক বিপদও ডেকে আনতে পারে।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম একটা আশাজাগানিয়া কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মব ট্রায়াল বিষয়ে সরকারের অবস্থান খুবই পরিষ্কার- এটি কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। যারা এর সঙ্গে জড়িতÑ বিভিন্নভাবে মাজারে হামলা, মন্দিরে হামলা ও আক্রোশের কারণে কোনো ব্যক্তির ওপর হামলা; সব হামলার ব্যাপারে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আমরা আশা করতে চাই, একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে মব ট্রায়ালের আর একটি অঘটনও ঘটবে না। কারণ এটি সংক্রামক ব্যাধির মতো দ্রুতই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে যায়। সরকার এটিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। আফগানিস্তানের পুনরাবৃত্তি এড়াতে হলে সময় থাকতেই মব ট্রায়াল বন্ধ করা উচিত।
লেখক : কলাম লেখক; সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা।
আজকালের খবর/আরইউ