রবিবার ৬ অক্টোবর ২০২৪
সুশাসন-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিই পারে নতুন বাংলাদেশ গড়তে
রুনা সাহা
প্রকাশ: রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:২৪ PM
করোনা মহামারির সময় থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি, লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তা পুনরুদ্ধার ব্যাহত হচ্ছে।

করোনা মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার তিন দশমিক আট শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের এক হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন হয়েছে দুই হাজার ৭৬৫ ডলারে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, তার পরিবর্তে জটিল আকার ধারণ করছে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাঁচ দশমিক আট শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও সাম্প্রতিক সময়ে আকস্মিক বন্যার কারণে অর্থনীতি স্থিতিশীল অবস্থায় নেই।

ব্যবসায়ীরা এখন কঠিন সময় পার করছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা, সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যবসায়িক কার্যক্রম এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও ২০২৩ সালের এই সময়ে লাভে থাকলেও এবার লোকসানে পড়েছে। কোম্পানিগুলোর দাবি, মুনাফা কমার জন্য কেবল বিক্রি নয়, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসার পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধিও দায়ী।

মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কারণ, তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়। এতে তারা নিজেদের সঞ্চয় ভাঙাতে বাধ্য হয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি। মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় বাজেট পুনর্বিবেচনা করে, বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত বাজেট তৈরির উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় শুধুমাত্র সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন যথেষ্ট নয়। বাজার স্থিতিশীল করতে দরকার পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা। সরবরাহ ব্যবস্থা ও চাহিদার দিক নিয়ে কাজ করা, অর্থাৎ কীভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় সরবরাহের মাধ্যমে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করা। বাজারে সিন্ডিকেট কমিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। তাই  দ্রুত আইনশৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমে আট শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপির তুলনায় কর সংগ্রহ বাড়িয়ে ১৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ছয়-সাত বছরে এই অনুপাত উল্টো ১১ শতাংশ থেকে কমে আট শতাংশে নেমেছে।

কর-জিডিপির অনুপাত হ্রাস হতে থাকায় বাজেটের ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারি ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। দেশে করের মূল বোঝা সাধারণ জনগণ বহন করে চলেছে। কর দিন দিন কমে যাওয়ার কারণগুলো হলো, কর আদায় যথাযথভাবে না হওয়া, কর ফাঁকি ও কর ছাড় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে করের সঙ্গে বিদ্যমান নানা ধরনের প্যারা-ট্যারিফ। আর্থিক সংস্কারের মধ্যে কর, ভ্যাট ও কাস্টমসসহ রাজস্ব খাতের সংস্কার জরুরি।

অন্যদিকে দুই বছর আগে শুরু হওয়া ডলারের সংকট কাটেনি। গত বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত প্রায় এক হাজার কোটি ডলারের মতো কমেছে। রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ সহায়তা আওয়ামী লীগ সরকার নিলেও রিজার্ভ বাড়েনি।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আগস্ট শেষে প্রবাসী আয় বার্ষিক প্রায় ৩৯ শতাংশ বেড়ে দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা কিছুটা হলেও রিজার্ভের ওপর চাপ কমিয়েছে।

বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে রাশিয়া এবং চীন থেকে প্রাপ্ত ঋণের সুদের হার কমানো এবং ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। রাজস্ব আয় বাড়লে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে বেশি ব্যয় করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডলার-সংকটের এই সময়ে দেশে গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়, তার আগের বছরের তুলনায় পাঁচ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম। বিদায়ী অর্থবছরে নিট পোশাক, ওভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো বকেয়া বেতনসহ অন্যান্য দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ, তার ওপর জ্বালানি সংকটের কারণে বেশিরভাগ কারখানা এখন ৩০ শতাংশ সক্ষমতা নিয়ে চলছে। ডিজেল, সিএনজি ও পেট্রোলিয়াম গ্যাস দিয়ে বস্ত্র কারখানা চালানো হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বস্ত্র কারখানার গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নতির দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া না হলে পোশাক শিল্প বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে যা রপ্তানি বাস্কেটকে আরো সংকুচিত করবে।

দুঃখের সাথে বলতে হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংক ঋণ বিদেশে পাচার-এ চার প্রধান অর্থ পাচারের প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে।

এ ছাড়া ব্যাংকিংখাত খেলাপি ঋণে জর্জরিত। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে মোট ঋণের আট দশমিক দুই শতাংশ খেলাপি ছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় নয় শতাংশে। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করা, বারবার ঋণখেলাপিদের সুবিধা ও দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ।

যদিও এজন্য বর্তমানে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজে লাগিয়ে টাকা পাচার বন্ধ করা এবং ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজার খাতের জন্য দ্রুত টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। সরকারের উচিত ডলারের বাজার স্থিতিশীল করা, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং চেক করা, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম দ্রুত করতে হলে গুণগতমানের বিনিয়োগের সাথে দক্ষতার উন্নয়ন ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে। বিনিয়োগের খরচ কমানোর সাথে সাথে বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন পাওয়ার সময়ও কমাতে হবে। তাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় প্রকল্পগুলোর গুণগত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।

সুশাসন, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিই পারে নতুন বাংলাদেশের রূপ প্রকাশ করতে। প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের সততা, রাজনীতিবিদদের পরমতসহিষ্ণুতা, দেশপ্রেমই এগিয়ে নেবে দেশকে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

আজকালের খবর/আরইউ








http://www.ajkalerkhobor.net/ad/1724840661.gif
সর্বশেষ সংবাদ
পুরোনো সিন্ডিকেট বদলে নতুন সিন্ডিকেট হচ্ছে
ডিম-মুরগির দাম বাড়িয়ে ২৮০ কোটি টাকা লোপাট
ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের টাইমলাইন : প্রেস সচিব
বৃষ্টি নিয়ে নতুন বার্তা দিলো আবহাওয়া অধিদপ্তর
গণহত্যায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে: মাহফুজ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
দুর্গাপূজায় সারাদেশে দুই লাখের বেশি আনসার মোতায়েন হচ্ছে
সাংবাদিক হিসেবে কারো বিরুদ্ধে মামলা হোক আমরা তা চাইনা: শ্যামল
পূজামণ্ডপের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী তৎপর থাকবে: সেনাপ্রধান
সব বিভাগে ভারী বৃষ্টির আভাস, চট্টগ্রামে ভূমিধসের শঙ্কা
অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতার কারণেই কি দেশে ফিরবেন শেখ হাসিনা?
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft