প্রকাশ: শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪:০৫ PM আপডেট: ১৪.০৯.২০২৪ ৪:১১ PM
যার নাম শুনার সাথে সাথে পাঠক মনে সঞ্চার হয় স্পষ্টভাষীর এক অন্যরকম উদ্দীপনা, চোখের সামনে ভেসে ওঠে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করা একজন প্রকৃযশা বহুমাত্রিক লেখকের মুখ। বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে একটি উজ্জ্বল আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। বাঙালির শেকড়কে ভিন্ন ভাবে চিনিয়েছেন যিনি, তিনি আর কেউ নন- তিনি আমাদের হুমায়ুন আজাদ, বাঙালিদের প্রিয় হুমায়ুন আজাদ। বাংলা সাহিত্যে যেকজন কবি-সাহিত্যিকের লেখা সৌরভ ছড়ায় তাদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদ অন্যতম। তিনি কখনো ফুরিয়ে যাবার নয়। হুমায়ুন আজাদের কবিতা লেখার মধ্যে দিয়ে সাহিত্য কর্মের সূচনা হয়। নবম শ্রেণি পড়ুয়া অবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার কচিকাঁচার আসরে প্রকাশিত হয়েছিল তার লেখা ‘ঘড়ি বলে টিক টিক’ নামে একটি প্রবন্ধ। তারপর বহুবার তার কৈশোরেই প্রবন্ধ, কবিতা ও ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল।
হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমালোচক ও একজন দক্ষ শিক্ষক। যার বিশ্বাসে রয়েছে রেনেসাঁ, আলোকপর্ব, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ এবং উদার মানবিকতাবাদের ইউরোপীয় ভাবপুঞ্জ। অবলীলায় সত্য উচ্চারণের জন্য তিনি ক্ষমতাশালী, ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদীদের ছিলেন চক্ষুশূল। পর্দার আড়ালে থাকা জ্ঞানপাপিদের কারণে তার বই হয়েছে নিষিদ্ধ। স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে লেখায় ছিলেন পরাঙ্গম। খোলামেলা ও স্পষ্টভাষায় লেখা বিশ্বাস করতেন। হুমায়ুন আজাদ রাষ্ট্র এবং সমাজের অনেক প্রথা ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। একটি রাষ্ট্র তার কাছে সর্বময় ক্ষমতা বা বিশ্বাসের জায়গা ছিলো না। বরং রাষ্ট্রের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন একজন কবি, লেখক, বিজ্ঞানী ও দার্শনিককে। একবার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কবি রাজু আলাউদ্দিন ও ব্রাত্য রাইসু। সেই সাক্ষাৎকারে কবি ব্রাত্য রাইসু হুমায়ুন আজাদকে প্রশ্ন করেছিলেন- আপনার ‘নারী’ নিষিদ্ধ হয়েছে। এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন? হুমায়ুন আজাদের স্পষ্ট জবাব ছিলো- হ্যাঁ, বেশ অদ্ভুত হচ্ছে। তবে আমি বইটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে এটি মনে করছি না, বা মনেও হচ্ছে না। আসলে হয়েছেও তাই। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে একটি কণ্ঠস্বরের নাম হচ্ছে হুমায়ুন আজাদ। সাহিত্যের সমালোচকরা হচ্ছেন সাহিত্য সৃষ্টিযজ্ঞের পুরোহিত। তারা নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কারণে সাধারণত অনেকেরই প্রিয় হতে পারেন না। হুমায়ুন আজাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। হুমায়ুন আজাদকে বোঝতে হলে অবশ্যই তার লেখা অনুধাবন করতে হবে। যারা হীনমন্যতা নিয়ে আজাদের লেখা পড়ে তাদের দ্বারা কখনোই তিনি সঠিক মূল্যায়িত হবেন না। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক আধুনিক, বর্ণনাশৈলী, গতিশীল, এবং অপ্রিয় সত্য বলতে কখনো দ্বিধা করতেন না। তাই হুমায়ুন আজাদ সবার কাছে হয়তো প্রিয় হতে পারেননি।
তার লাল নীল দীপাবলিতে লিখেছেন- ‘যদি তুমি চোখ মেলো বাঙলা সাহিত্যের দিকে, তাহলে দেখবে জ¦লছে হাজার হাজার প্রদীপ; লাল নীল সবুজ, আবার কালোও। সাহিত্য হচ্ছে আলোর পৃথিবী, সেখানে যা আসে আলোকিত হয়ে আসে, কালো এসে এখানে নীল হয়ে যায়। অসুন্দর হয়ে যায় সুন্দর শিল্পকলা। বাঙলা সাহিত্যকে এমন সুন্দর করে রচনা করেছেন যুগ যুগ ধরে কতো কবি, কতো গল্পকার। তাঁদের অনেকের নাম আমরা মনে রেখেছি, ভুলে গেছি অনেকের নাম। সবাই সমান প্রতিভাবান নন, সময় সকলকে মনে রাখে না’। বাংলা কবিতা যাদের স্পর্শে যর্থাথ রূপ লাভ করলো নতুন দিগন্ত খুলে দিলো তাদের একজন হুমায়ুন আজাদ। তিনি বাংলা সর্বনামীয়করণ, বাক্যতত্ত্ব, বাংলা ভাষা গ্রন্থসমূহ রচনা করেন যা বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তার অন্যান্য রচনার মধ্যে আছে- লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী, কত নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল প্রভৃতি। তিনি তার অন্যান্য প্রবন্ধে মৌলবাদ ও ধর্মব্যবসায়িদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। হুমায়ুন আজাদ বাঙালি পাঠক সমাজে পাঠকদের হৃদয়মন্দিরে যুগযুগ ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবেন, বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় এই লেখক ২৮ এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে রাড়িখাল, বিক্রমপুর (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২ আগস্ট ২০০৪ সালে ৫৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।)
আজকালের খবর/আরইউ