১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে অস্ত যাওয়া বাংলার স্বাধীনতা খুঁজতে দীর্ঘ ইংরেজবিরোধী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ, সশস্ত্র বিপ্লবী বিনয়-বাদল-দিনেশ-ক্ষুদিরামের-চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, গিরিশ্চন্দ্র ঘোষের সিরাজউদ্দৌলা, ডিএল রায়ের শাহজাহান, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, আসাম ও পূর্ব বাংলাকে নিয়ে এক সুবিশাল দেশের অভ্যুদয়, লাহোর প্রস্তাব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ৪৭-এর অসম দেশভাগ, পাকিস্তানী নিপীড়ন, ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ- বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক বিশাল ক্যানভাস। কিন্তু ততোদিনে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতরো আয়তনের এক ভূখণ্ড মাত্র।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অনেক অনেক বিষয় ও চিন্তার সাথে সামনে এসেছে জাতীয় সঙ্গীত বিতর্ক। ‘আমার সোনার বাংলা’ গান রচনার প্রেক্ষাপটের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশের চেতনা একেবারে যায় না বলে অনেকের অভিমত।
আরেকপক্ষ মনে করেন, ৮৫ ভাগ মুসলমানের দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সুর কেন বাউল সুরের হবে! অন্য একটি রেডিক্যাল গ্রুপ মনে করে, এই গানে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত হতাশা ও বেদনা প্রতিফলিত হয়েছে। দুই বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ায় কবির যে কষ্ট ও হাহাকার- সেটি প্রতিবিম্বিত হয়েছে এই গানে। সেই সাথে এর সুর ধার করা, কবি যাকে বলেছেন ‘ভাঙা গান’। অর্থাৎ প্রচলিত একটি গানের সুরে বাণী বসিয়ে রচিত গান ‘আমার সোনার বাংলা’। গগন হরকরার গাওয়া ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুরে বাণী বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অমর পালের কণ্ঠে এই গান অমরত্ব লাভ করেছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৬০-৬৫ বছর আগে রচিত এই গানে অখণ্ড বাংলার প্রাকৃতিক রূপ-রস-বিমূর্ত ঘ্রাণ যতোটা চিত্রিত হয়েছে, ঠিক ততোটাই অনুপস্থিত বাংলার মুক্তি সংগ্রাম।
একথা সত্য যে একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এই গান লিখিত হয়নি; এটি দেশভক্তিমূলক সঙ্গীত হিসেবে কবি লিখেছিলেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের গান ‘আমার সোনার বাংলা’। এই গানের কিছু অংশ বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে দেশে আসার পথে সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সাথে সাক্ষাৎকারে জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়টি উত্থাপিত হয়। ফ্রস্ট জানতে চান, তোমার স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে? মুজিব জানান, এটি নির্ধারিত আছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তিনি এর ইংরেজি করে বলেন, ‘o my golden bengal, i love you.’ (লন্ডনগামী বিমানে ওঠার আগে ভূট্টোর কাছে তিনি রেকর্ডে এই গানটি শুনতে চেয়েছিলেন। ভূট্টো কথা রেখেছিলেন। তবে কোন শিল্পীর রেকর্ড তিনি শুনেছিলেন সেই তথ্য আমার জানা নেই।) এর আগে জহির রায়হান তার অমর চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’তে গানটি ব্যবহার করেছিলেন। আনোয়ার হোসেন, আমজাদ হোসেন, শওকত আকবর, রাজ্জাক, রোজী এবং সুচন্দা ঠোঁট মিলিয়েছিলেন সেখানে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মহান কণ্ঠশিল্পী মান্না দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গান দুটি রেকর্ড করেন। সেই রেকর্ড যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো। কাছাকাছি সময়ে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা মিত্র দ্বৈতকণ্ঠেও এই গান রেকর্ড করেছেন। ফলে এই গান বাংলার ঘরে ঘরে সমাদৃত যুগ যুগ ধরে।
কিন্তু একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণের জন্য কোনো কমিশন গঠিত হয়েছিলো কি? কেউ কি তখন ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চেতনার সাথে এই গান চলে কিনা! বাংলা বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ব্যক্তিগত বেদনা ও হতাশা থেকে লিখিত একটি কীর্তনের সুরের গান কেমন করে রক্তস্নাত একটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করে! এসব প্রশ্ন তখন উঠেছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের সামনে কারো মৃদু অস্ফুট প্রতিবাদ আর ভাষা পায়নি।
তবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর মোশতাক সরকার, এরপর জিয়াউর রহমানের সরকার, ২০০১-এর জোট সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী নিজামী-মুজাহিদ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের পক্ষে নড়াচড়া করলেও তাদের উদ্যাগ সফল হয়নি। জিয়াউর রহমান নিজে শাহনাজ রহমতউল্লাহর গাওয়া মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা ‘প্রথম বাংলাদেশ’ গানটির ভক্ত ছিলেন। এটি পরে বিএনপির দলীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করেছিলো। এই গানে কবি লিখেছেন, ‘আমার আঙিনায় ছড়ানো বিছানো/সোনা সোনা ধুলিকণা/মাটির মমতায় ঘাস ফসলে/বুজের আল্পনা/আমার তাতেই হয়েছে/স্বপ্নের বীজবোনা।’তবে এই গানেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ অভিযাত্রা ও লাখো শহীদের আত্মত্যাগের কথা ব্যক্ত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের গান ভারতেরও জাতীয় সঙ্গীত। সম্রাট পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষ্যে তিনি একটি স্তুতিগান লিখেছিলেন ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’। সেখানে জর্জকে ভারতের ভাগ্যবিধাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া শান্তিনিকেতনে শ্রীলঙ্কার ছাত্র আনন্দ সুকুমারণের অনুরোধে তিনি শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতের রূপকল্প রচনা করেন ‘জয় শ্রীলঙ্কা মাতা’।
তবে যুগ যুগ ধরে ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গীত হচ্ছে বাংলাদেশে। ‘ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে’ গাইলেই চোখে ধরা দেয় বাংলার প্রাচুর্য। দেশকে মা হিসেবে কল্পনা করলে প্রশান্তি আসে। আর বাউল সুর সে তো বঙ্গেরই সুর। অনেক সমালোচক বলেন, এই মা মানে দুর্গা, উমা, কালী, পার্বতী, রুদ্রাণী। কিন্তু তারা বিস্মৃত হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ কোনো মূর্তিপূজারী ছিলেন না। তিনি নিরাকার ব্রহ্মার অর্চনা করতেন। ঠিক একই কারণে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়ার সময় তিনি নাকি ‘তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ অংশটুকু গাইতেন না।
লেখক: শিল্প সমলোচক, লেখক ও কলাম লেখক।