কানাইলাল শীল-একাধারে দোতারাবাদক, গীতিকবি, সুরকার ও সংগ্রাহক। জন্ম ১৩০২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে [১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে] ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার শাকরাইল ইউনিয়নের লস্করপুর গ্রামে। গ্রামটি বর্তমানে কৈরাইল মতান্তরে কড়াইল নামে পরিচিত। কানাইয়ের পিতা আনন্দচন্দ্র শীল ছিলেন নৃত্যশিল্পী ও সঙ্গীতপ্রেমী। মাতা সৌদামনী শীল ছিলেন গৃহিণী। স্বভাবতই তার কোষকলায় প্রবহমান সঙ্গীতের উত্তরাধিকার। কিন্তু সংস্কৃতিমনা বাবার সান্নিধ্য বেশিদিন কপালে জোটেনি কানাইয়ের। মাত্র আড়াই বছর বয়সে পিতাকে হারান তিনি।
বিত্তহীন অমরচন্দ্রের সংসারে ছিল নিত্য টানাপড়েন। ফলে দারিদ্র্যের বলয়েই মা ও কাকিমার স্নেহে লালিত-পালিত হন কানাই। এ কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ হয়নি তার। দারিদ্র্যশাসিত শৈশবেই পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সখ্য গড়ে ওঠে সুরের সাথে। সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি বেহালার মাধ্যমে। মাত্র আট বছর বয়সে তৎকালীন প্রখ্যাত বেহালাবাদক নগরকান্দা গ্রামের বসন্তকুমার শীলের কাছে বেহালা শিখতে শুরু করেন তিনি। এরপর ১১ বছর বয়সে ওস্তাদ মতিলাল ধূপী নামের আরেক খ্যাতিমান বেহালাবাদকের কাছে বেহালায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন।
মতিলাল ধুপীর কাছে বেহালার পাঠ শেষ করে সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ কানাই বেরিয়ে পড়েন ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য। বেহালাবাদক হিসেবে যোগ দেন এক যাত্রাদলে। তবে ওই দলে বেশিদিন থাকেননি। যাত্রাদল ছেড়ে একই পেশায় যুক্ত হন ‘কীর্তনিয়া’ নামে গানের দলে। গানের দলটির সঙ্গে ঘুরে বেড়ান হাওর অঞ্চলে। গাজীর গানের সদস্যও ছিলেন তিনি। একসময় বিক্রমপুরের বইমহটির দরবেশ দাগু শাহের মাজারে জনৈকের দোতারা বাজানো শুনে মোহিত হন। বাড়ি ফিরে ওই সময়ের প্রখ্যাত দোতারাবাদক তারাচাঁদ সরকারের কাছে দোতারা শেখেন। তারাচাঁদও ছিলেন ফরিদপুরের বাসিন্দা। গুরুর শিক্ষা এবং স্বীয় অধ্যবসায়ে কানাইলাল দোতারায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। গুরুর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ পূর্ণ হলে তিনি যোগ দেন এক কৃষ্ণলীলা দলে। ওই দলের হয়ে ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্ন অঞ্চলে।
কৃষ্ণলীলা দলের সঙ্গে ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে এক যাত্রানুষ্ঠানে যোগ দিতে যান জনৈক রাধিকা মোহন সাহার বাড়িতে। কোনো এক কারণে সেসময় ওই বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন। সেদিন রাধিকা মোহনের বাড়িতে কানাইয়ের দোতারার সুরে মুগ্ধ হন কবি। তিনি কানাইকে বলেন, ‘সবাই তোমার দোতারা বাদ্যের প্রশংসা করছে। তাহলে আমাকে একদিন শোনাও।’ এ সুযোগ হাতছাড়া করেননি কানাই। যেমন প্রস্তাব তেমনি ছিল উত্তর। তৎক্ষণাৎ কবিকে তিনি জানান, আজ রাতেই যাত্রা শেষ হবে। আগামীকাল সন্ধ্যার পর তিনি গান ও দোতারা বাজিয়ে শোনাবেন।
কানাইয়ের প্রতিশ্রুতি মতো গানের আসর বসে পরদিন রাতে। পল্লীকবির উপস্থিতিতে দোতারা বাজিয়ে গান শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে গভীর হয় রাত। রাধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদ কাহিনী কণ্ঠে তুলে একপর্যায়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন কানাই। গান থামিয়ে শুধু দোতারা বাজান কিছুক্ষণ। গভীর রাতের নীরবতা ভেঙে সুর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সে সুর পল্লীকবির হৃদয় ছুঁয়ে যায় নিবিড়ভাবে।
এ প্রসঙ্গে কবি জসীমউদদীন লিখেছেনÑ ‘গান শুনিতে শুনিতে কোন সাত সাগরের কান্নায় বুক ভাসিয়া যায়। কোথা দিয়া যে রাত ভোর হইয়া গেল টের পাইলাম না।’
কানাইয়ের গান শুনে মুগ্ধ জসীমউদ্দীন তাকে পরিচয় করিয়ে দেন কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিনিধি হেমচন্দ্র এবং মেগাফোন কোম্পানির জিএন ঘোষের সঙ্গে। সেটি ছিল ১৯৩০ সাল। এ পরিচয়য়ের সুবাদেই কানাইলালের সঙ্গীতজীবনের মোড় ঘুরে যায়। তাই এ কথা অনস্বীকার্য যে, জসীমউদ্দীনই কানাইলালের সংগীত জীবনের পট পরিবর্তনের নায়ক।
পল্লীকবির মাধ্যমেই পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে পরিচিত হন কানাই। আর আব্বাসউদ্দীনের হাত ধরে তার পদার্পণ কলকাতার সংগীতভুবনে। আব্বাসউদ্দীন তাকে বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এতে দোতারা বাদক হিসেবে কাজ জুটে যায় তার। এ কাজের সুবাদেই কানাইলালের পরিচয় হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। একদিন দোতারা বাজাচ্ছিলের কানাই। ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত ছিলেন কাজী নজরুল। সে বাজনা কবিকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে কানাইকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নেন। যাকে বলে রতনে রতন চেনে। প্রায় পাঁচ বছর নজরুলের সঙ্গে থেকে দোতারা বাজান কানাই। একই সময় তিনি যুক্ত হন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রে। সেখানে দোতারা শিল্পী হিসেবে নিয়মিত কাজ করতে থাকেন।
অন্যদিকে গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করার সময় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সেতারশিল্পী ওস্তাদ এনায়েত খাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান কানাইলাল। এ সুযোগে এনায়েত খাঁর কাছে দোতারায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখেন তিনি। ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর কাছেও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নেন এবং তাকে ‘ধর্মপিতা’ হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কানাইলাল ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে নিজস্ব শিল্পী ও সুরকার হিসেবে যোগ দেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
শুরুতে দোতারাতেই মগ্ন থাকতেন কানাইলাল শীল। কিন্তু তার যে গীতিকবি ও সুরকার সত্তা রয়েছে, তা সুপ্তই থেকে যায়। এ সত্তাকে জাগিয়ে তোলে আব্বাসউদ্দীনের অনুপ্রেরণা। তিনি গান লেখার তাগাদা দিতেন কানাইকে। শিল্পীর তাগাদা থেকেই গান লেখা ও সুর বাঁধা শুরু করেন তিনি। তার গানেও রয়েছে এক মোহনীয় শক্তি। অল্পদিনেই প্রতিষ্ঠিত হন গীতিকার-সুরকার হিসেবে।
অনেক ছায়াছবির গানেও কানাইলালের অসাধারণ প্রতিভা দীপ্যমান। ১৯৬০ সালে ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আসিয়া’ চলচ্চিত্রে ‘আমার গলার হার খুলে নে ওগো ললিতে’ কিংবা ‘আমায় ঘর ছাড়া করিলি রে’, ‘সুখ বসন্ত সুখের কালে’-এমনি শ্রোতাপ্রিয় বহু গান লিখে সুর করেছেন তিনি। তার লেখা ও সুরে বহু গান রেকর্ড করে বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানি। গানগুলো বাংলা সঙ্গীতজগতের অতুলনীয় সম্পদ।
কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী আব্বাসউদ্দীন, শচীন দেব বর্মন, আবদুল আলীম, আবদুল লতিফের কাছে মর্যাদা পেয়েছে কানাইয়ের গান। তার গান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন আবদুল হালিম চৌধুরী, কুমুদিনী সাহা, অনন্ত বালা বৈষ্ণবী, বেদারউদ্দিন আহামেদ, ফেরদৌসী রহমান, নীনা হামিদ, কানন বালা সরকার, ফওজিয়া খান, ফরিদা ইয়াসমিন, সরদার আলাউদ্দিন, এম এ খালেকের মতো গুণী শিল্পীরা।
আব্বাসউদ্দীনের বেশির ভাগ গানে দোতারা সঙ্গত করেছেন কানাইলাল। আর তার দোতারার সুরে উপমাহীন হয়ে উঠেছে সেগুলো। তার গান একসময় আব্বাস উদ্দীনের দরদি কণ্ঠে জয় করে মানুষের মন। ‘মাঝি বাইয়া যাওরে’, ‘থাকতে পার ঘাটাতে তুমি পারের নাইয়া’, ‘ও ঢেউ খেলেরে, ঝিলমিল সায়রে ও ঢেউ খেলে’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’সহ অসংখ্য গানে কানাইলাল শীলের দোতরার বাজনা গ্রাম বাংলার মানুষকে মোহিত করে।
দোতারায় সুরের কুহক সৃষ্টি করে অখ্যাত-অবহেলিত এই লোকবাদ্যযন্ত্রকে স্বীয় প্রতিভাবলে বিখ্যাত করে তোলা কানাইলালের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। দোতারাকে দুই থেকে চার তারে উন্নীত করার কৃতিত্বও তার। তার জাদুকরী হাতের স্পর্শে এ বাদ্যযন্ত্র বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই তাকে আখ্যায়িত করা হয় দোতারার মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে। দোতরার জাদুকরও বলা হয় তাকে।
আব্বাসউদ্দীন কানাইলাল শীল সম্পর্কে বলেছেন- পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, মুর্শিদি ইত্যাদি গানের সংগ্রাহক আমার অনুজপ্রতিম শ্রীকানাইলাল শীলের কাছে আমি চিরঋণী। পূর্ববাংলার মাঠে-ঘাটে এই পল্লিগীতি ছড়িয়ে ছিল, লুকিয়ে ছিল, অনাদৃত হয়ে পড়ে ছিল। কানাইয়ের সহায়তায় সেই হারানো মানিক উদ্ধারের কাজে এগিয়ে এলাম। কানাইয়ের মতো দোতারাবাদক পাক-ভারত উপমহাদেশে বিরল। তার সাহায্য না পেলে সত্যিকারের লোকগীতি লোকসমাজে পরিবেশন করা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। [দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা. ১৪১-১৪৩, প্রথমা প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৯]
কানাইলাল শীল যখন ২৩ বছরের তরুণ তখন ফরিদপুরের মুন্সীচর গ্রামের মেয়ে কিশোরী বালার সঙ্গে গ্রন্থিবন্ধনযুক্ত হন। এ দম্পতির সাত ছেলেমেয়ে। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার তিন পুত্রও হয়ে হয়ে ওঠেন গুণী দোতারাবাদক।
সঙ্গীতক্ষেত্রে কানাইলালের অতুলনীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্র তাকে ১৯৮৭ সালে ‘একুশে পদক’ [মরণোত্তর] দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৭৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর লোকান্তরিত হন এ কীর্তিমান। দোতারার মুকুটহীন সম্রাটের ৪৯তম মৃত্যুদিনে তার প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণতি।
আজকালের খবর/আরইউ