অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে চিৎকার করে ওঠে দ্বিতীয় বর্ষের বিজ্ঞান ক্লাসের মেধাবী ছাত্রী রুবামা। তার চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে গেলেও বাবার মতিন মৃধার ঘুম ছুটেনি। তিনি ঘুমের কড়া ডোজের বড়ি সেবন করেন। রাত দুপুরে এমন চিৎকারের কারণ জানতে রুবামার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাসার সবাই একই প্রশ্ন সবার মুখে। স্বপ্ন দেখে যতটা না ভয় পেয়েছে সে এখন এত প্রশ্নের সম্মুখে ভয় দ্বিগুন রূপ নিলো। কী উত্তর করবে সে কীভাবে করবে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে যেন সব।
রুবামার মা মিনতি বেগম প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। কুমিল্লা শহরের ঢুলীপাড়া এলাকায় স্কুল। তার জনপ্রিয়তার কারণ চমৎকার করে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখায় গাইড করতেন। নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। কিন্তু সমাজে অল্প কিছু মানুষ যুগে যুগে বিদ্যমান যারা কারো সাফল্যতায় ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। ঘটলো তাই মিনতি বেগমের নামে কুৎসা রটিয়ে দিলেন সর্বত্র। মিনতি বেগম নাকি প্রিয়ান নামের এক ছাত্রের পিতার সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে ছিলেন। রাগে ক্ষোভে তার মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়। চলে যায় স্কুলের চাকরি। অনেক চিকিৎসার শেষে এখন সুস্থ হয়েছেন। ভুলে গেছেন নোংরা ঘটনার স্মৃতি। প্রথমে মিনতি বেগমই রগত স্বরে বলে ওঠলেন-
-কী হয়েছে তোর বলছিস না ক্যানো।
তার ছোট খালামনি নার্গিস আহলাদ মাখানো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন-
-কী স্বপ্ন দেখেছিস মামনি।
নার্গিস খালামনির দু’দুবার বিয়ে ভেঙে যায়। কারণ হিসাব করা আছে তিনি নাকি মানুষ খুন করেছিলেন। যদিও ব্যাপারটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। পাড়ার গলির মোড়ে এক সন্ধ্যায় এক বখাটে ছেলে ছুরিকাহত অবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল নার্গিস তার দেহ থেকে ছুরিটা বের করতে যেয়ে এলাকাবাসির নজরে পড়লে তারা তাকে দোষী সন্দেহে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে দেয়। পরে মৃত্যুপথযাত্রী সেই বখাটে যুবকের তৎক্ষণিক বয়ানে নার্গিসের গৌরবময় মুক্তি ঘটলেও এলাকায় কানা-ঘোষা বন্ধ হয়নি দীর্ঘদিন। কারণ সেই বখাটে যুবক রনি নার্গিসকেও নাকি উত্যক্ত করতো। তবে নার্গিস সেটি বরাবরই অস্বীকার করেছে। এই যে বহুল নির্মিত কোনো বাংলা সিনেমার অংশ। মুক্তি পাবার দিন থেকে নার্গিস খালা রুবামাদের বাসায় চলে আসে। রুবামাদের বাড়ি কয়েকটি গলির পরই নার্গিস খালামনিদের বাড়ি অর্থাৎ নানার বাড়ি।
বড় ভাই নাজমুল ক্ষীণ কণ্ঠে বলল- সারাদিন মোবাইলে নানা কিছু দেখে দেখে স্বপ্নে তাই-ই অন্যরূপে দেখছিস। মধ্যরাতে বাড়ির সবাইকে নাজেহাল করছিস। বলে দিলেতো পারিস কী স্বপ্ন দেখেছিস।
নাজমুল রুবামাদের সবার বড়। গতবার বিসিএস পরীক্ষায় ভাইবাতে আউট হয়ে যায়। এবার আবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নাজমুল বরাবরই তুখোড় ছাত্র ছিলো কোনো পরীক্ষায় প্রথম বৈ দ্বিতীয় হয়নি। তা ছাড়া তিনবার ব্যাডমিন্টনে ডিস্ট্রিক চ্যাম্পিয়ান। পাড়ায় সবাই সমীহ করে। পড়শীরা পৌর কমিশনারের ভোটে প্রার্থী করার জন্য দৌড়ঝাপ করেছে কিন্তু অবস্থাতে নাজমুল রাজি হয়নি। এ ব্যাপারে মায়ের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাবার ক্ষীণ সায় ছিলো।
রুবামার পিঠেপিঠে বোন সুবামা ক্ষেপে গিয়ে বলতে শুরু করল কাল থেকে তোর সঙ্গে আর শোবো না। গেস্ট রুমে গিয়ে শোব। সুবামা এবার ফাস্ট ইয়ারে অধ্যয়ন করছে। ভীষণ ছটফটে এই মেয়ে দুর্দান্ত সাহসী। একবার বাড়িতে একদল উচ্ছনে যাওয়া পাড়ার পোলাপান পিকনিকের চাঁদা চাইতে এসেছিলো। সুবামার সঙ্গে তাদের তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায় সুবামা একাই তিনজনকে ধরাশায়ী করে ফেলে। পরে লোকজন এসে নিস্পত্তি করে। যদিও ছেলেগুলো আর সুবামার ওপর কোনো অ্যাকশনে যায়নি।
এসএসসি পরীক্ষার পর সুবামা তার মামাতো ভাই জাহাঙগীরের নিকট ক্যারাটে শিখেছিলো দক্ষতার সঙ্গে। কাজের বুয়া ফিরোজা হাই তুলতে তুলতে জানতে চাইলো কী হয়েছে আপা। স্বপ্নে কারো দেখছেন। নাফিস ভাইকে নাতো?
ফিরোজা বুয়া তাদের বাড়িতে রুবামার মায়ের বিয়ের পর পর কাজে ঢুকে দীর্ঘবছরে মাত্র একবার দেশের বাড়ি ফেনীতে গিয়েছিলো। বিয়ের পারপাসে। বিয়ে হয়েও ছিলো। একটি মৃত কন্যা সন্তান প্রসব করার অজুহাতে স্বামী তাকে ত্যাগ করে। পিতৃমাতৃহীন ফিরোজা দারিদ্র মামার কাছে না গিয়ে আবার চলে আসে রুবামাদের কাছে। রুবামাদের সঙ্গে ফিরোজার সম্পর্ক আপনের চেয়ে বেশি। বাড়ির সবাই তাকে তাদের মতো একজন সদস্য মনে করে। ফিরোজাকে তারা সব ব্যাপারে অংশীদার করে। অত্যন্ত সানন্দে তার যাপিত জীবন। কোনো অভিযোগ বা নালিশ নেই।
নাফিস রুবামার ফুফাতো ভাই সুইডেনে এলএলবি পড়ছে। রুবামার সঙ্গে প্রেম না থাকলেও দু’জন দুজনকে ভীষণ পছন্দ করে। ফুফু শাকিলা বেগম তার বাবাকে বলেই রেখেছ নাফিস ব্যারস্টারি কমপ্লিট করে এলে সে রুবামাকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে যাবে।
এদিকে ভোর হয়ে আসছে। গলির মাথা একটি মসজিদে আজান পড়ে গেছে। অথচ এখনও রুবামা মুখ খুলছে না। তাকে সবাই বার বার তাগিদ উত্তরের অপেক্ষায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অবশেষে দীর্ঘ হাই তুলে রুবামা বলে ওঠলো আমাকে এক গ্লাস পানি দাও ফিরোজা বুয়া।