বউয়ের সাথে জিসানের কম্পিটিশন এতোটাই বেড়ে গেছে যে, সে একটা কথা বললে বউ সোনিয়া দশটা শুনিয়ে দেয়।
আজ বহুদিন পর তারা একটা চাইনিজে গেছে ডিনার করতে। আজকে তাদের বিয়েবার্ষিকী। এই উপলক্ষে দু’জনেই দু’জনের মাথা ছুঁয়ে বাসা থেকে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, আজকের পর থেকে যা কিছুই ঘটুক, কেউ কারও ওপর কখনো বিরক্ত হবে না। ভুল খুঁজে বের করবে না। নেভার এভার।
এখন থেকে শুধুই ভালোবাসাবাসির দিন শুরু হলো।
সোনিয়া এবং জিসান আজকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। যাক, অবশেষে দু’জনের সন্ধি হলো তাহলে!
অর্ডার করা হয়েছে, এখন শুধু খাবার আসার অপেক্ষা। ওয়েটার প্লেট চামচ এটাসেটা টুকটাক দিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ জিসান বলল, আচ্ছা এই যে ডিনার করতে আসলাম, এই যে ডিনার সেট দেখছো, এগুলো দিয়ে কি লাঞ্চ করা যাবে? নাকি এগুলো দিয়ে শুধুই ডিনার করতে হয়?
এই কথা শুনেই সোনিয়ার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। সে জামাইকে এমনভাবে তিরস্কার করা শুরু করলো, যেন তিরস্কার নয় কবিতা পাঠ করছে।
জিসান কী এমন অপরাধ করছে বুঝতে পারলো না। সোনিয়া তার একমাত্র নিজস্ব বউ, অজানাকে জানতে বউকে প্রশ্ন করা যাবে না?
এই দেশটা নাকি স্বাধীন হয়েছে মায়ের ভাষার জন্য, জিসান বেচারা মায়ের ভাষায় কথা বলবে কী, সারাক্ষণ বউয়ের ভাষায় কথা বলেও মন জোগাতে পারছে না। সে ভাবে, এই দেশে নব্বই পারসেন্ট স্বামী-স্ত্রী মিল নাই, তবু জনসংখ্যা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে, মিল হলে কী হতো আল্লাহ মালুম।
আফসোস! বিরাট আফসোস!!
বউয়ের গালি খেয়ে বেচারা চুপচাপ ফেসবুক স্ক্রোল করছিল, এখনো খাবার আসে নাই, সোনিয়া পাশ থেকে বিরক্ত গলায় বলল, এতো মোবাইল ঘাটাঘাটি কইরো না, চোখ তো নষ্ট হয়ে যাবে।
জিসান অবাক হয়ে বলল, এতো মোবাইল পাইলা কই, আমি তো সারাদিন একটা মাত্র মোবাইলই ঘাটাঘাটি করি, এটাও তোমার সহ্য হয় না। আমি তোমাকে এতো লাইক করি, তারপরও এমন খোঁচাখুঁচি কর কেন?
সোনিয়া আরো বিরক্ত হয়ে বলল, আমিও তো তোমাকে ফেসবুকে কমেন্ট করি, তো তাতে কী হইছে? যেভাবে মোবাইল ঘাটাঘাটি কর, এভাবে ধর্মকর্ম করলে তো মরার আগেই বেহেশত কনফার্ম হয়ে যেতো।
জিসান মনে মনে বলল, লে হালুয়া! আমি বলি কী, সারিন্দা বাজায় কী!
সোনিয়া হাত নেড়ে নেড়ে বলল, এই যে সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পড়ে আছো খারাপ লাগে না।
আমার খারাপ নিয়ে আমি কখনোই চিন্তা করি না, ওটা করার জন্য তো তুমিই যথেষ্ট। আমি জানি, আমি যথেষ্ট ভদ্রলোক একজন মানুষ।
সোনিয়া তাচ্ছিল্য করে বলল, তুমি ভদ্রলোক! একথা কে বলেছে? মানুষ নিজের প্রশংসা নিজে কীভাবে করে বুঝি না! আমি যে অতি ভদ্র, সভ্য, নম্র, লক্ষী টাইপ একটা মেয়ে, এই কথাটা কখনো তোমাকে বলেছি?
জিসান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, জীবনেও না, কখনোই বল নাই।
তাহলে? এরপর সোনিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, সাধারণ জ্ঞানটাও দেখছি তোমার নাই। ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে সুন্দর একটা ঘর বাঁধবো, কিন্তু...
সুন্দর ঘর তো বেঁধেছো, সাথে দক্ষিণের বারান্দাও আছে। তারপরও তোমার মন পাইলাম না! বিরাট আফসোস!
মন পাইবা কীভাবে? আমি এই সংসারে একটু শান্তি পাই? রাতে শুতে গিয়েও শান্তি নাই, ঘুমের ঘোরে যেভাবে নাক ডাকা শুরু করো, মনে হয় আসমান ভেঙে আমার মাথার উপর পড়বে। সারারাত আমি ঘুমাতে পারি না।
ওভাবে বইলো না বউ। চিন্তা করে দেখ, পৃথিবীতে তুমিই হচ্ছো একমাত্র অতি ভদ্র এবং অতি সুন্দরী নারী, যার পাশে তার স্বামী নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। এমন ভাগ্য কয়টা মেয়ের হয় বল তো?
পাম পট্টি ভালোই তো শিখছো, একটা সত্যি কথা বল তো, আমাকে তুমি বিয়ে করছিলা কেন? একদম সত্যি কথা বলবা।
সত্যি কথা বলবো? দাঁড়াও ভেবে বলছি। পেয়েছি, আসলে জীবনে চোখ মোছার জন্য অনেকেই পাশে ছিল কিন্তু নাক মোছার জন্য কাউকে পাই নাই তো, তাই বাধ্য হয়ে...
ও মাই লর্ড! চোখ মোছার মানুষ ছিল মানে কী? বিয়ের আগে তুমি প্রেম করতা?
জিসান লজ্জিত গলায় বলল, করেছিলাম ছোটখাটো একটা... অভিজ্ঞতার দরকার আছে না!
তারপর? তোমাদের ব্রেকআপ হইছিল?
হা।
বল কী! কেন?
মেয়েটা হলুদ রং পছন্দ করতো। এইজন্য ওকে খুশি করার জন্য আমি কয়েকদিন দাঁত মাজি নাই তো তাই...
সোনিয়া অবাক হয়ে জিসানের দিকে তাকিয়ে রইল। জিসান আরো লজ্জিত হয়ে বলল, প্রেমে ছ্যাঁকা খাইছি সমস্যা নাই, অংশগ্রহণ করতে পারছি এটাই বড় কথা।
সোনিয়া অবিশ্বাস নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। এই গাধা যে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়তে পারে তা তার মোটেই বিশ্বাস হলো না। সে বলল, তুমি মেয়ে পটাতে জানতে? কই আমাকে তো কখনো পটানোর চেষ্টা কর নাই।
জিসান বলল, এভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে লাভ নাই, অব্যবহৃত, ইনটেক, অনভিজ্ঞ জামাই বিয়ে করছো, বিয়ের আগে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জামাই খুঁজলে এই বিপদে পড়তা না। বিয়ের আগে একটা গার্লফ্রেন্ডও পটাইতে পারি নাই, বিয়ের পর তোমাকে কীভাবে পটাবো।
এরপর আর কারো সাথে সম্পর্ক হয় নাই?
হইছিল তো, একটা মেয়ে আমার জন্য কেঁদেছিল পর্যন্ত!
ও মাই লর্ড! তুমি আবার মেয়েদের কাঁদাতেও পারো! মেয়েটা কাঁদছিল কেন? ছ্যাঁকা দিসো?
আরে নাহ! চেয়ার সরাতে গিয়ে ভুল করে চেয়ারের একটা কোনা তার পায়ের পাতার উপর রেখেছিলাম। এতেই মেয়েটা কেঁদে দিল। আচ্ছা, তুমি এসব কথা জিজ্ঞেস কর কেন? হিংসা হচ্ছে?
আরে নাহ!
মনে হচ্ছে ভিতরে ভিতরে তুমি রেগে গেছো। আগে কেউ রেগে গেলে অভিশাপ দিতো, এখন ফেসবুকে ব্লক দেয়। তুমি আবার আমাকে ব্লক দিও না। আচ্ছা, শুনেছি মেয়েরা তার স্বামীর পাশে কোলবালিশও পছন্দ করে না, কথাটা কি সত্যি?
জানি না। হঠাৎ সোনিয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তোমাকে যে চকলেট আনতে বললাম, আনছিলা?
আনছি তো...
কই, দেও খাই।
জিসান কাঁচুমাচু মুখে বলল, ইয়ে বউ, লোভ সামলাতে পারি নাই তো, তাই খেয়ে ফেলছি।
সোনিয়া রেগে বলল, তোমাকে বিয়ে করা যে আমার ভুল হইছে এটা বুঝতে পারছো?
জিসান আবারো মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, জি বুঝেছি। তুমি তো জীবনেও কোনো ভুল স্বীকার কর নাই, এই একটা ভুল স্বীকার করলা। মন খারাপ করে লাভ নাই।
সোনিয়া থমথমে গলায় বলল, আমি মন খারাপ করছি না।
এই তো মন খারাপ করে বসে আছো।
সোনিয়া বিরক্ত গলায় বলল, তাহলে কি আমি মন খারাপ করে শুয়ে থাকবো?
এমন করে না লক্ষীটি, আজকে স্পেশাল একটা দিন। প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যাও কেন? বল তুমি আজকে স্পেশাল কী খাবে, যা খেতে চাইবে সব খাওয়াবো।
তাই? আমি এখন স্পেশালি গড়াগড়ি খাবো। চেয়ার টেবিল সরাও আমি গড়াগড়ি খাই।
জিসান অদ্ভুত দৃষ্টিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সোনিয়া বিরক্ত গলায় বলল, এভাবে তাকিয়ে থাকবে না, অসহ্য লাগছে।
জিসানও রাগী গলায় বলল, আমারও।
কিছুক্ষণ পর চাইনিজের লোকজন অবাক হয়ে দেখলো, এক দম্পতি কোনো খাবার না খেয়েও বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে!