আভা
আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশ: শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪, ৩:৩৯ পিএম
সন্ধ্যা হয় হয়। বাইরে বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি। হাসান তার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসে গলা ছেড়ে গান ধরেছে-মন মোর মেঘের সঙ্গি...। ভেজানো দরজা ধুম করে খুলে গেল। সোবহান সাহেব ঘরে ঢুকলেন। হাসান তরাক করে দাঁড়িয়ে বলল-আব্বা, আপনে এখন বাসায়...?
-এই কুকুর-বিড়াল বৃষ্টির মধ্যে বাসায় থাকবো না তো কোথায় যাব? একটা কবিতার বই নিয়ে বসেছিলাম, তোর গানে বিরক্ত হয়ে...।
-বিরক্ত!
-হু, তোর গানের কণ্ঠ পরিষ্কার না। নিয়মিত আদা-চা পান করবি, যষ্ঠিমধু খাবি।
-জি আব্বা। আরও কিছু বলবেন? এই চেয়ারটায় বসেন।
সোবহান সাহেব বসলেন না। ঘরের চারপাশে বইয়ের আলমারি দেখতে লাগলেন।
আলমারি দেখা শেষ হলে বললেন-তুই মেডিকেলের ছাত্র, মেডিকেলের বইয়ের একটামাত্র আলমারি তাও তালাবন্ধ। আর সবগুলো আলমারি ভরা শিল্প-সাহিত্যের বই।
তারপর সোবহান সাহেব গেলেন ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা নরকঙ্কালটার কাছে। বললেন-এটায় তো ধুলো পড়ে আছে। কোনোদিন ছুঁয়ে দেখেছিস বলে মনে হয় না।   
হাসান কয়েকবার ঢোক গিলে বলল-আব্বা, এখনও মেডিকেলের পড়াশোনা শুরু করিনি।
-শুরু করিনি মানে? ফার্স্ট সেমিস্টারে তো ফেল মেরে যাবি।
-ইমপ্রুভমেন্ট দেওয়ার সুযোগ আছে।
-সবাই করে ভালো রেজাল্টের চিন্তা, আর তুই আছিস ইমপ্রুভমেন্ট দেওয়ার ধান্দায়। তুই তো মানুষ মারা ডাক্তার হবি দেখতেছি। মানুষের হাত-পায়ের হাড়ের সংখ্যা কত?
প্রশ্নটা যেন হাসানকে ধাক্কা দিল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-হাত-পায়ের হাড়ের সংখ্যা?
-হু।
-অপসন দেন আব্বা।
-১২০, ১৩০, ১৪০, ১৫০।
-আব্বা, দুইটা অপসন কমান।
-১২০, ১৩০।
-১৩০।
সোবহান সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন-গাধার বাচ্চা!
হাসান বলল-হয় নাই আব্বা?
সোবহান সাহেব চোখ উল্টিয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাসান বলল-আব্বা, একদিন আমি কঙ্কালটা নিয়ে মেডিকেল বিষয়ে পড়াশোনা করতে গেছিলাম কিন্তু পারি নাই।
-কেন?
-যেই ওর হাড়-গোড় দেখতে যাব অমনি ওর আত্মা এসে হাজির।
-আত্মা এসে হাজির!
-জি আব্বা।
-আত্মা এসে কী করল?
-বলল, ওর শরীর নিয়ে ডাক্তারি পড়াশোনা করা যাবে না। যদি করি তো ও আমার দুই চোখ উপড়ে ফেলবে, দুই হাত, দুই পা ভেঙে ফেলবে, ঘাড় মটকে দেবে। ওকে এই ঘর থেকে না সরালে ডাক্তারির পড়াশোনা সম্ভব হবে না।
-ও কি ছেলে না মেয়ে?
-মেয়ে। ভারি মিষ্টি কণ্ঠ! মনে হয় জীবনকালে গান-টান করতো।
-একটা মেয়ে মানুষ দেখে তুই ভয় পেয়ে গেলি?
-এখন তো সে আর মেয়ে মানুষ না, সে এখন মেয়ে মানুষের আত্মা-মানে ভূত।
-ওর কঙ্কাল নিয়ে পড়াশোনা করলে ওর ক্ষতি কী?
-ওর ইচ্ছে ছিল সাহিত্য নিয়ে পড়বে, কিন্তু বাপ ওকে জোর করে ঢুকিয়ে দেয় ডাক্তারি পড়ার মধ্যে। প্রচন্ড অনিচ্ছা নিয়ে ওকে সারা জীবন ডাক্তারির মধ্যে থাকতে হয়েছে সেই রাগে...।
-এখন মনে হচ্ছে তোকে সাহিত্যের মধ্যে দিলেই ভালো হতো, বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখতে পারতি। বড় গল্পকার হয়ে যেতি।
-আব্বা, আপনি তো জানেন হাসান কখনো মিথ্যা বলে না।
-তুই বলতে চাচ্ছিস সত্যি ওর আত্মা এসেছিল?
-জি আব্বা, সারারাত সে আমাকে গীতাঞ্জলির কবিতা পড়িয়েছে। আমি পড়েছি সে শুনেছে। এখনও মাঝে মাঝে আসে। এসে আমাকে দিয়ে সারারাত কবিতা পড়ায়। ওর সাথে একটু আলাপ-পরিচয় হয়েছে। ওর নাম আভা। ওর বাবার নাম...।
-আজ রাতে আমি তোর ঘরে থাকবো। তুই থাকবি বসার ঘরে। আমি দেখতে চাই আভা আসে কি না।
-আব্বা, আপনার হার্টে কিছুটা দুর্বল...। এই বয়সে...।
-আমার হার্ট নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।
পরদিন।
সকাল দশটায় সোবহান সাহেব ঘরের দরজা খুলে বের হলেন।
হাসান বলল-আব্বা, কোনো সমস্যা হয়েছিল?
-কীসের সমস্যা?
-কঙ্কালটার আত্মা আসে নাই?
-তুই আমার কাছে মিথ্যা গল্প বলেছিস। তোর খবর আছে।
-মিথ্যা! এই হাসান তো মিথ্যা বলে না আব্বা। আপনি কি সারারাত জেগে ছিলেন?
-সারারাত কঙ্কালের পাশে বসে ছিলাম।
-বসে বসে কী করেছেন?
-টাইম পাস করার জন্য জীবনানন্দের কবিতা পড়েছি।
-ও...এই তবে কথা! জীবনানন্দের কবিতা পড়লে আভার আত্মার অস্তিত্ব বুঝবেন কী করে?
-কেন?
-আপনি জীবনানন্দ পড়েছেন, সে-ও আপনার পাশে বসে জীবনানন্দ পড়েছে। আপনি তার হাড় গুনতে যেতেন দেখতেন আপনার হাড়-মাংস সব এক করে ফেলতো।
-তাই বলে এতটুকু টেরও পাবো না?
-টের পাবার মতো ব্যাপার ছিল, আপনি হয়তো খেয়াল করেননি। ঘরে কি কোনো পারফিউমের গন্ধ পেয়েছেন? বেলী আর রজনীগন্ধার মিশেল মিষ্টি একটা গন্ধ।
সোবহান সাহেব নাক কুঁচকালেন। বড় করে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বললেন-না, সেরকম কোনো গন্ধ পাইনি।
হয়তো আপনার সর্দির সমস্যা চলছে, নাক বন্ধ, অথবা জীবনান্দের কবিতার গভীরে ঢুকে...। আভা আসা মানেই ঘরটা বেলী আর রজনীগন্ধার মিশেল গন্ধে ঘর ভরে যাওয়া। ও এলেই আমার বমি আসার উপক্রম হয়।
-বেলী-রজনীগন্ধার গন্ধে বমি আসবে কেন?
-আমার তো পারফিউম ব্যবহারের অভ্যাস নেই। তারপর ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস টের পেয়েছেন?
সোবহান সাহেব ভুরু কুঁচকে হাসানের দিকে তাকালেন। তার চাহনীতে রাগ না বিরক্তি তা কিছু বোঝা গেল না। বললেন-আজ আমি আবার থাকব তোর ঘরে। আজ কোনো জীবনানন্দ পড়ব না, কোনো গান শুনব না, শুধু কঙ্কালের হাড় গুনব। দেখি ঘাড়ের কাছে কোনো গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পাই কিনা, কোনো পারফিউমের গন্ধ পাই কিনা। যদি না পাই তো...।
-আচ্ছা সহস থাকলে থাকেন। বিপদ হলে আমার দোষ দিতে পারবেন না।
তার পরের দিন।
সকাল দশটা বাজে। সোবহান সাহেবের ঘরের দরজা বন্ধ। এতবেলা পর্যন্ত তো তিনি কখনো ঘুমান না। তিনি একজন খাঁটি আর্লি রাইজার। রেহেনা বেগম রান্না ঘর থেকে বের হতেই হাসান বলল-মা, বাবা এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি?
-না। তোদের বাপ-ছেলের মধ্যে কীসব হচ্ছে তা জানিও না। তিনি কেন দুই দিন ধরে তোর ঘরে থাকছেন?
-কঙ্কাল নিয়ে পড়াশোনা করতে চান। কঙ্কালের হাঁড়-গোর গুনে দেখতে চান। সেগুলোর নাম জানতে চান।
-কঙ্কাল নিয়ে পড়াশোনা করার কথা তোর। তিনি এই বয়সে কঙ্কাল পাঠ করে কী করবেন?
-মা, সেসব পড়ে জানবে। আগে বাবাকে ডাকো। দেখো, কোনো সমস্যা হল কিনা।
সোবাহান সাহেবকে ডাকতে হল না। তখনই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে ঘরের দরজা খুলে গেল। দরজার সামনে সোবহান সাহেব দাঁড়িয়ে। তার চোখ দু’টি টকটকে লাল। নেশা নেশা ভাব, যেন তিনি কোনো ঘোরের মধ্যে আছেন। রেহানা বেগম উদ্বিগ্ন্ন হয়ে বললেন-কী হয়েছে তোমার? সমস্যা কী? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
-সব ঠিক আছে। চা দাও।
চায়ের টেবিলে বসে হাসান বলল-আব্বা, কঙ্কাল পাঠ করতে গিয়েছিলেন?
-হু।
-কিছু টের পেয়েছেন? মানে পারফিউমের গন্ধ, ঘাড়ের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস?
সোবহান সাহেব চায়ে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে হাসানের দিকে চেয়ে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন-হু।
-তাহলে তো আভা এসেছিল।
-তাই তো দেখছি। কিন্তু হিসাব মেলাতে পারছি না। মৃত্যুর পর কারও আত্মা এভাবে...।
-আপনি তো আত্মাতেই বিশ্বাস করেন না। এবার বোঝেন...। এই অবস্থায় ঐ ঘরে বসে আমি কেমন করে মেডিকেলের পড়াশোনা করতে পারি বলেন? ঐ কঙ্কাল সরাতে হবে।
সোবহান সাহেব মাথা দোলাতে লাগলেন। এমন সময় কাজের মেয়ে ফিরোজা হাসানের ঘর থেকে চিৎকার করে বলল-হাসান ভাই, খাটের নিচে পারফিউমের বোতল ভাইঙ্গা রাখছে কেডা? ইস! এমন দামি পারফিউমটা...!
সোবহান সাহেবের চোখ বড় হয়ে গেল। ঢুলুঢুলু ভাব কেটে গেল। তিনি ঘোরের ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। তখনই হাসানের ফোন রেহেনা বেগম এলেন। বললেন-হাসান, আভা নামের একটা মেয়ে ফোন করেছিল। তোকে চাইল। তুই তখন ওয়াশরুমে ছিলি। আজ বারোটার পরে তোর নাকি টিএসসিতে যাবার কথা। ও তোর জন্য অপেক্ষা করবে।
সোবহান সাহেব তড়াক করে দাঁড়িয়ে, গা ঝারা দিয়ে বললেন-আভা!
হাসান ছুটে ওয়াশ রুমে চলে গেল। গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে রইল।  

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
বন্ধ ৯ কারখানা খুলছে এস আলম গ্রুপ
মোহনগঞ্জে প্রেসক্লাব সাংবাদিকদের সাথে ইউএনও’র মতবিনিময়
দীর্ঘতম সৈকতে হাজারো মানুষ দেখলো বছরের শেষ সূর্যাস্ত
যেসব দাবি জানালেন চব্বিশের বিপ্লবীরা
দাম কমল ডিজেল-কেরোসিনের
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বাণিজ্য মেলায় ই–টিকেটিং সেবা চালু
শহীদ রুবেলের নবজাতক শিশু পুত্রকে দেখতে গেলেন ইউএনও
ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালেন তারেক রহমান
দুই সচিব ওএসডি
ইসকনের ২০২ অ্যাকাউন্টে ২৩৬ কোটি টাকা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft