স্বাধীনতার ৫৩ বছরের প্রিয় বাংলাদেশ আজ সঙ্কটে। ছাত্র-জনতার একটি জাগরণী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের পট-পরিবর্তন হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে আমরা সব পাল্টানোর পক্ষে মত দিচ্ছি। আমরা একসঙ্গে রাতারাতি সব পাল্টিয়ে ফেলব- তা কি সম্ভব! তা কি ধারণ করতে পারবো আমরা! এই আমরাই তো নিয়ম মানি না। আইন মেনে চলি না। নিজেদের অভ্যাস বদলাই না। আমরা সব বদলাতে চাই, কিন্তু নিজেকে বদলাতে চাই না। মাঝে মাঝে মনে হয়, বড় দুর্ভাগা এই দেশ। এই দেশে সাধারণ জনতা নেই। আমরা হয় আওয়ামী লীগ, নয় বিএনপি, না হয় জাতীয় পার্টি, তা না হলে জামায়াত, তাও যদি না হয় হেফাজত অথবা আরো আরো কত দলের অনুসারী যে আমরা তা বুঝা মুশকিল। এখন কথা বললে অথবা ফেসবুকে লিখলে নিক্তি দিয়ে মাপা হয়- কে কোন দলের পক্ষে!
অথচ আমরা বাংলাদেশি- এটি আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হওয়া উচিত। বড় অদ্ভুত জাতি আমরা। হুজুগে বাঙালির খেতাব আমরা এমনি এমনি পাইনি! আমরা কখনো কাউকে সম্মানে মাথায় তুলি আবার কখনো সেই তাকেই পদদলিত করতে ছাড় দিইনা! আমরা যা দেখি বা যা শুনি তা দেখে বা শুনে হুঙ্কার দিয়ে উঠি। ভালো-মন্দ যাচাই করি না। বোধ-বুদ্ধি-বিবেক খাটাই না! একে অপরকে গালমন্দ-তিরস্কার করতে পছন্দ করি। আনন্দ পাই। একটি বিরাট বড় ঘটনার মাধ্যমে দেশটি সঙ্কটকালে রয়েছে। প্রতিক্রিয়া প্রকাশে সহিষ্ণুতা নেই আমাদের। দেশ নিয়ে ভাবনা নেই আমাদের। দেশপ্রেম নেই আমাদের!
ভাবুন- বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই দেশ। ভু-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের পরাশক্তির কাছে। পরাশক্তির কেবল আগ্রহ আছে তা নয়, এই সম্পদ-সম্ভাবনা প্রতি শকুন দৃষ্টি, ষড়যন্ত্র আছে, থাকবেই। আমাদের সজাগ থাকা উচিত। দেশের সম্পদ-সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো অমিত সম্ভাবনার পথে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমরা জাতীয় ঐক্যতে পৌঁছাতে পারিনি। জাতীয় বিষয়গুলো ঠিক করতে পারিনি। অভ্যন্তরীন জটিলতার কারণে, দলাদলি আর মতভেদের কারণে পরাশক্তি আমাদের সবক দেয়! বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে কী কী ঘটছে, কেন ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে!
আমরা সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে আখ্যা দিচ্ছি! বলছি দেশ স্বাধীন হয়েছে! তাহলে এরশাদ বিরোধী সংগ্রামও তো স্বাধীনতার সংগ্রাম- তাই না! একটি দেশ কয়বার স্বাধীন হয়! ফেসবুক দেখলে মনে হয় আমরা সবাই কমবেশি বুদ্ধিজীবি! এত প্রতিক্রিয়া, এত গুজব- এই বাঙালি সমাজে! তাহলে তো সে কথাই সত্যি- রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।
দেশটি আমাদের। আমরা সবাই বাংলাদেশি। দলমত থাকুক। আমরা পরমত সহিষ্ণুতা দেখাতে চাই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকুক। আমাদের জাতীয় আদর্শগুলো নিরূপণ করা হোক। রাজনীতি হোক আদর্শের ভিত্তিতে। হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতির অবসান হোক। দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন অব্যাহত থাকুক। দেশের জন্য রাজনীতি লাগবে, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা লাগবে। মেধার বাস্তবায়ন লাগবে। দেশপ্রেম লাগবে। সর্বজনতায় এই আদর্শ চাই- ‘সবার আগে দেশ’।
আমাদের পুলিশ লাগবে, সেনাবাহিনী লাগবে, নৌ-বিমানসহ সকল প্রতিরক্ষা বাহিনী লাগবে। এই বাহিনীগুলোকে আরো জনবল বাড়িয়ে, প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা বাড়িয়ে শক্তিশালী করতে হবে। বাহিনী সবাই আমাদের ভাই-বোন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে আমরা সবাই পরস্পরের আত্মীয়-স্বজন। তাহলে দুর্নীতিবাজ কারা! এই যে আমাদের ছাত্র জনতা আন্দোলন করে একটি পরিবর্তন আনলো, এই আন্দোলনটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে হলে দেখা যাবে কত দুর্নীতিবাজ তাদের পারিবারিক বা আত্মীয় পরিমন্ডলে রয়েছে! সত্যি বলছি, এই তরুণ প্রজন্ম দুর্দান্ত সাহসী। কিন্তু এরা কি নিজে দুর্নীতিবাজ (যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) পিতা-মাতা-ভাই-বোন বা আত্মীয়ের প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে কি রাজপথে প্রকাশ্যে দাঁড়াবে? এরপর কি পরিবারে তাদের ঠাঁই হবে? এই সন্তানেরা তাদের পিতা-মাতা-ভাই-বোন বা আত্মীয়ের কাছে প্রশ্ন তুলবে কি- ‘আপনার আয়ের উৎস কি?’ এই সত্যের মুখোমুখি যেদিন হতে পারবে সেদিন মূল্যবোধের জাগরণ ঘটবে। সত্যিকারের স্বাধীনতার প্রতিফলন দৃশ্যমান হবে বাংলাদেশে।
সমাজ ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিকতায় রূপ নিচ্ছে। মানুষের ভেতর সহমর্মিতা, ভালোবাসা, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা স্নেহ অনেক কমে গেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সহানুভুতির জায়গাগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। অসহিষ্ণুতার মনোভাব প্রকট হয়ে উঠছে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদে। আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা না থাকা এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর আস্থার সংকট এই পরিস্থিতিকে উস্কে দিচ্ছে। পরিত্রাণের জন্য দরকার সরকারের নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ছোট অপরাধের জন্য বড় শাস্তির ব্যবস্থা কার্যকর হলে সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা ৭৫ ভাগ কমে আসবে। যেমন আইন মানতে বাধ্য করা, অপরাধ প্রমাণিত হওয়া মাত্র শাস্তি দেওয়া, ভেজাল-ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-দায়িত্বে অবহেলা-প্রতারণা-দখল-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ইত্যাদির ক্ষেত্রে অপরাধ যত ছোট পর্যায়ের হোক না কেন শাস্তি আর জরিমানা বেশি হলে এমন প্রবণতা কমতে পারে। যেমন- খাদ্যে ভেজাল, খাদ্য মজুদ, ট্রাফিক আইন না মানা, পথচারির ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার না করা এমনসব অপরাধের জন্য জেল এবং জরিমানা উভয়দণ্ড কার্যকর হওয়া উচিত। এমনসব অপরাধের শাস্তির খবরও ফলাও প্রচার করা দরকার। উন্নত বিশ্বে সরকারের নিয়ম অমান্য করলেই অপরাধ বিবেচনা করে তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়া হয় বলে সেসব দেশে রাস্তায় কেউ কলার ছোলা বা চিপসের প্যাকেট ফেলার কথা ভাবতেও পারে না। বাংলাদেশে সময় লাগলেও এমন আইন মান্যতার প্রবণতা সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। তবে এজন্য জনসংখ্যার অনুপাতে- পুলিশ বাহিনীর বিভাগ ও কলেবর বাড়ানো দরকার আছে।
বাঙালিরা নিয়ম মানতে যেন নারাজ। নিয়মের কথা বললেই তাদের মাথায় পড়ে বাজ। যত্রতত্র নিয়ম ভাঙ্গাই যেন তাদের কাজ। ড্রাইভার নিয়ম মেনে গাড়ি চালায় না। পথচারি নিয়ম মেনে পথ চলে না। সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা নিয়ম মেনে কাজ করেন না। তাই ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় নিয়ম মানেন না। শিক্ষকের মাঝে নিয়মানুবর্তিতার প্রবণতা নেই, তাই শিক্ষার্থীদের নিয়মের প্রতি শিষ্ঠাচার নেই। যারা নিয়ম বা আইনের প্রণেতা এমপি বা মন্ত্রী তারা এবং নিয়ম যারা কার্যকর বা বাস্তবায়ন করবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী- তারাই নিয়ম মানে না। একারণে জনগণেরও মাঝেও এমন একটা ভাব যেন- নিয়ম আবার মানার কী জিনিস!
মনে রাখতে হবে, আইন না মানাও এক ধরনের প্রবণতা। একটি উদাহরণ দিয়েই বলি। জাপান সরকার তাদের জনগণের জন্য মাঝে মাঝে কিছু নির্দেশনা দেয়। যেমন, পাওয়ার সেভ করার জন্য সোম আর বৃহষ্পতিবার দেশের জনগণ লিফট ব্যবহার করবে না। দেখা গেছে জাপানিরা সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত ঠিকই সোম ও বৃহষ্পতিবারে লিফট ব্যবহার করছে না। তারা সবাই সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করছে। আবার সরকার যখন বলবে অফিস কিংবা বাসায় এয়ারকুলারের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে স্থির রাখতে হবে। জাপানের জনগণ ঠিক তাই করবে। নিয়মানুবর্তিতা বা সরকারের নির্দেশনা মানার এমন প্রবণতা দেখে সে দেশে অবস্থানকারি এক বাঙালি শিক্ষার্থী এক জাপানি শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলো- ‘আচ্ছা তোমরা নিয়ম ভাঙ্গো না কেন?’ তার প্রশ্ন শুনে জাপানি শিক্ষার্থী বিস্ময়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো- ‘কী বলছ, কিছু বুঝতে পারছি না। নিয়ম ভাঙ্গবো কেন? নিয়ম তো তৈরিই হয় মানার জন্য।’ এই হলো বাঙালি আর জাপানিদের প্রবণতার ব্যবধান।
আমরা বাঙালিরা নিয়ম ভাঙ্গতেই বেশি পছন্দ করি। তাই বিশ-পঞ্চাশ ফিট দূরত্বের মধ্যে একটি ফুটওভারব্রিজ আর একটি আন্ডারপাস থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা দৌড় দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়। আমরাই আইনের কথা বলি- কিন্তু নিজেরা আইন মানি না। আইনের কঠোর শাসনের কথা বলি। দেখা গেছে করোনাকালে পাবলিক অযথা ঘর থেকে বের হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দুয়েকজনকে কান ধরে উঠবস করিয়েছে বা লাঠিপেটা করেছে। আর তাই নিয়ে ফেসবুকে তুলকালাম, প্রতিবাদে সোচ্চার নিয়ম ভঙ্গকারি বাঙালিরা!
আইন না মানার প্রবণতা থেকে সমাজের মানুষকে বের করে আনতে হবে। একটি সমাজে তখনই আইন না মানা বা আইন ভাঙার প্রবণতা তৈরি হয় যখন দেশে আইনের শাসনে ঘাটতি থাকে। একই কথা ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ব্যবসায়ীরা নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন কিনা সেটি নিয়মিত তদারকি করা হলে পুকুর চুরি, টাকা পাচার, বিভিন্ন কাজে দুর্নীতি, অনিয়ম এমন পর্যায়ে যেত না । সরকারকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এই বার্তাটি পৌঁছাতে হবে যে, ‘আইন মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য।’ আর এজন্য সরকারকে কঠোরভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন সবার জন্য সমান- এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষ- ৩৬ কোটি হাত। পাঁচ কোটি তরুণের ১০ কোটি যৌবনতীপ্ত প্রত্যয়ী হাত। মেধার সাগর দেশে। আমরা যদি দলমতের উর্ধ্বে থাকি- আমাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য কাজ করি- কেউ ঠেকাতে পারবে না আমাদেরকে। পৃথিবীর কোনো পরাশক্তির কাছে হার মানবো না আমরা। আমরা গর্বিত বীর বাংলাদেশি। ভালোবাসি বাংলাদেশ- ভালোবাসায় বাংলাদেশ।
লেখক : সমাজ ও কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক।
আজকালের খবর/আরইউ