একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সেনাবাহিনী। দেশের অখণ্ডতা রক্ষা ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশের সুরক্ষা করা সেনাবাহিনীর কাজ। বাংলাদেশেরও রয়েছে একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী। দেশমাতৃকা রক্ষায় অভাবনীয় ভূমিকা পালন করছে বাহিনীটি। এ ছাড়া মানবতার খাতিরে হেন কাজ নেই যা করছে না বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
সময়ে সময়ে দেশ ও দেশের মানুষের জরুরি প্রয়োজনে অকুতোভয় সংগ্রামীর মতো সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য ঝাপিয়ে পড়েছেন। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনে অস্থির দেশের হাল ধরেছে বাহিনীটি। মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় কোনো রক্তপাত ও গুলি ছাড়া দেশকে শান্ত করেছে সেনাবাহিনী। দেশের পরিস্থিতি ভালো করার জন্য ত্বরিত কাজ করেছে সেনাবাহিনী। এর জন্য রাস্তায় বা জনসমাজে একটি লাঠিপেটাও করতে হয়নি বাহিনীর কোনো সদস্যকে।
অতীতে নানা সময় এমন মহান দায়িত্ব পালন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ বাহিনীর সুনাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে। বিশ্বের অনেক দেশের সামাজিক সুরক্ষায় কাজ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বিশ্বের বুকে শান্তির প্রতীক হিসেবে প্রশংসিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের ভূমিকা সুনাম কুড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশ বর্তমানে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সর্বোচ্চ সংখ্যক সেনা প্রেরণকারী দেশ। ‘শান্তিতে সংগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’- স্লোগানের মর্ম কাজেই প্রতিফলিত।
বাংলাদেশের সৃষ্টিলগ্নের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা এক অনন্য ইতিহাস। পরে দেশের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের গর্ব বলা চলে সুগঠিত ও সুশৃঙ্খল এই বাহিনীটি। দেশ ও জাতির কল্যাণে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি ও বিতরণ, ভিজিডি কার্ড বিতরণ, টিআর-কাবিখার অর্থ সঠিক বণ্টন, পাহাড় ধস, দুর্যোগে কালভার্ট-সেতু-রাস্তা নির্মাণ, জলোচ্ছ্বাস-টর্নেডোর তাণ্ডব পরবর্তী সহায়তাসহ অনেক জরুরি প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া দেশ গড়ার কাজে সেনাবাহিনীর অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প যেমন- পদ্মাসেতু রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্প, মহিপাল ফ্লাইওভার, কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ, সীমান্ত সড়ক প্রকল্প, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে সেনাবাহিনী। কোভিড-১৯ মহামারির সময়েও মানুষের জন্য কাজ করেছে সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনী বরাবরই গণতন্ত্রের পক্ষে সাহসী ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের সেনাবাাহিনী অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে পেশাদার ও বিশ্বমানের। সেনাবাহিনীর প্রতিটি কাজ অর্থনৈতিক মূল্য রাখে। তা ছাড়া শান্তিরক্ষা মিশন থেকে অর্জিত আয় বাংলাদেশের তৃতীয় আয়ের খাত। তারপরও সেনাবাহিনী থেমে নেই। উদ্দাম এগিয়ে চলছে বাহিনীর প্রতিটি সদস্য নির্লোভ হয়ে। তাদের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার হয়। দেশকে ও দেশের মানুষকে বিপথে ঠেলে দেওয়ার নীল নকশা এসব। সেনাবাহিনী কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে কাজ করে না। দেশের প্রয়োজনে এবং কল্যাণে নির্ভীক সেনাবাহিনী। মনে রাখা প্রয়োজন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পাশাপাশি একটি সুশৃঙ্খল, পেশাদার এবং শক্তিশালী সামরিকবাহিনী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালে একটি প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। তারপর পেরিয়েছে অনেক সময়। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে দেশের সব শাখা উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
কিন্তু তারাপরও থেমে নেই প্রোপাগান্ডা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে নতুন করে গর্বিত বাহিনীটির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। গত ২৮ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশব্যাপী ক্রম অবনতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে গত ২০ জুলাই ভোর থেকে নিজ নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দ্রুত নৈরাজ্য প্রশমন করতে সাহায্য করে। এতে আরো বলা হয়, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য দেশে ও বিদেশে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা বলে অনুমিত। স্বার্থান্বেষী মহলের এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সংবাদে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করছে। জনগণের স্বার্থে ও রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সবসময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে। আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সংবিধান সমুন্নত রেখে প্রচলিত আইনের আওতায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, দেশবাসীর জানমালের নিরাপত্তা ও জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
আদতে হয়েছেও তাই। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রক্তাক্ত দেশকে খুব সহজেই শান্ত করেছে সেনাবাহিনী। জনগণের জান-মালের রক্ষা হয়েছে। গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন হয়েছে যেখানে জনসাধারণ স্বস্তি প্রকাশ করেছে সেনাবাহিনীর প্রতি। সব সময়ই দেশের সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীর কার্যকলাপে খুশি। কিন্তু কিছু নাশকতাকারী গোষ্ঠী সেনাবাহিনীর সার্বিক কর্মকাণ্ডে নাখোশ। তারা দেশ ও দেশের জনগণের শত্রু। তারাই সর্বশেষ অপপ্রচার চালিয়েছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তাদের ইচ্ছা ছিল কোটা আন্দোলনের কোমলমতি শিক্ষার্থীর আড়ালে দেশকে অস্থির করে তোলা। তাই করেছে তারা। অনেক অনিশ্চয়তা ও রক্তপাত হয়েছে। তাদের আরো ইচ্ছা ছিল একটি গণতান্ত্রিক সরকার পড়ে যাক। সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নিক। তাই হয়নি। খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে দেশপ্রেমের অনন্য নজির স্থাপন করে অতি অল্প সময়ে দেশ ও দেশের সম্পদ রক্ষা করে সেনাবাহিনী।
তারপরও থেমে নেই অপতৎপরতা। সেনাবাহিনীর ইমেজকে হেয় করতে সাইবার দুনিয়ায় নিত্য নতুন ফন্দি আঁটা হচ্ছে। দুর্বৃত্তরা ফেসবুক, টুইটার (এক্স), ইউটিউবের মতো মাধ্যম ব্যবহার করছে সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন করতে। এসব কার্মকাণ্ডকে সরকারবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা বলেই প্রতীয়মান হয়। এইসব দুর্বৃত্তরা স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্রের ঘনিষ্ট। তারা এখন বড়ই বেজার। কোনো অপপ্রচার কিংবা গুজবেই সেনাবাহিনীকে টলানো গেল না! আসলে সেনাবাহিনী কোনো ব্যাক্তি, গোষ্ঠী ও দলের নয়। তাই সেনাবাহিনীর ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বা দলের জন্য কাজ করার কথাও না। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য এদেশেরই নাগরিক। তারা জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশ রক্ষার মহান ব্রতে দীপ্ত। রাষ্ট্রের গর্বিত সন্তান।
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর স্থল শাখা হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এটি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্ববৃহৎ শাখা। প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে দেশের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষাসহ সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহায়তায় প্রয়োজনীয় শক্তি ও জনবল সরবরাহ করা। পাশাপাশি যে কোনো জাতীয় জরুরি অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এগিয়ে আসতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
লাল-সবুজ বাংলা গড়ার মহান ব্রত পালন করা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যেকোনো ষড়যন্ত্র দেশপ্রেমিক মাত্রই আঘাত করে। ওইসব ষড়যন্ত্র দেশপ্রেমিক জনতাকেই রুখতে হবে। বয়কট করতে হবে দেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীকে। এখনই সময় নতুন করে দেশপ্রেমে বলীয়ান হওয়ার। বাংলার মানুষ তাই হবে।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
আজকালের খবর/আরইউ