প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪, ১২:৪২ PM
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৬ ও ১৮ জুলাই সংঘাত-সংঘর্ষের উত্তপ্ত ছিল রংপুর মহানগর জুড়ে। কিন্তু ১৯ জুলাই শুক্রবার সকাল থেকেই শান্ত ছিল পুরো নগরী। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ জুমার নামাজের পর বিকেল তিনটা থেকে মিছিল-স্লোগানে মুখরিত হয় রংপুর আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ দিন মিরাজুল ইসলামের বাড়িতে চলছিল মুরগি ও পোলাওয়ের চাল রান্নার প্রস্তুতি। কারণ ১৯ জুলাই ছিল মিরাজুল-নাজমীম দম্পতির বিবাহবার্ষিকী। নিজেদের মতো করে দিনটি উদযাপনে অনেক পরিকল্পনা ছিল দু’জনের। কিন্তু একটা গুলিই যেন তছনছ করে দিল মিরাজুল-নাজমীম দম্পতির সাজানো সংসার। বিবাহবার্ষিকীর দিনে নিথর লাশ হয়ে ফেরা স্বামীর কথা ভেবে এখনো অশ্রুসজল নাজমীম। শোকে স্তব্ধ অসহায় এ পরিবারের সদস্যরা এখন ভবিষ্যতের চিন্তায় দিশেহারা।
রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়া এলাকার মৃত সামছুল ইসলামের ছেলে মিরাজুল ইসলাম (৩৫)। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি নগরীর সিটি বাজার এলাকায় পাইকারি ফলের (কলা) দোকানের কর্মচারী ছিলেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আড়াই শতক জমির ওপর টিনের চালের বাড়িতে বসবাস করতেন তিনি। মেরাজুলের তিন বছরের ছেলে হানিফ হোসেন এখনো বুঝে উঠতে পারেনি চিরতরে সে বাবার স্নেহ হারিয়েছে। আরেক ছেলে মেহরাব হোসেন নাজিল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
অসময়ে স্বামীকে হারানো নাজমীম ইসলামের বিলাপ থামেনি এখনো। একজন নারীর কাছে বিবাহবার্ষিকীতে স্বামীর মৃত্যু কতটা কষ্ট ও বেদনার তা হয়তো নাজমীমের চেয়ে কেউ জানে না। তাই তো ওই দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইতেই কাঁদতে কাঁদতে নাজমীম ইসলাম বলেন, ‘অল্প আয়ের সংসার হলেও আমাদের মাঝে আনন্দের শেষ ছিল না। দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার। বড় ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু একটা গুলি আমার সাজানো সংসারটা তছনছ করে দিল। এখন আমি দুই সন্তান নিয়ে কোথায় যাব? কে চালাবে আমার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যদি স্বজন হারানোর বেদনা বুঝে থাকেন, তাহলে ১৩ দিনেও আমাদের খোঁজ নিলেন না কেন?’
গতকার বুধবার (৩১ জুলাই) বিকেলে নিহত মিরাজুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে স্তব্ধ পুরো বাড়ি সুনসান। তার স্ত্রী নাজমীম ইসলাম বাড়ির উঠানে চুপচাপ বসে আছেন। ছোট ভাই হানিফকে কোলে নিয়ে বড় ভাই নাজিল। নাজিলও বাবার জন্য কাঁদছে। একপর্যায়ে বড় ভাইয়ের চোখের পানি হাত নিয়ে মুছে দিতে দেখা যায় শিশু হানিফকে।
হাউমাউ করে কান্না করতে করতে নাজমীম ইসলাম বলেন, ‘ওনার (স্বামীর) মৃত্যুর আগের রাতে আমাদের বিবাহবার্ষিকী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। দুপুরে বাজার থেকে মুরগি, পোলাওয়ের চাল ও আলু নিয়ে বাসায় আসেন। বিকেলে মহাজনকে টাকা দিতে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বললথতুমি রান্না করো, আমি মহাজনকে দোকানে টাকাটা দিয়ে আসছি। রাতে একসঙ্গে খাবার খাব। কিন্তু তা আর হলো না। তিনি এলেন লাশ হয়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই সন্তান ও শাশুড়িসহ পাঁচজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মিরাজুল। বড় ছেলের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার কীভাবে চলবে তা ভেবে পাচ্ছি না। এখনো সরকারের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের খোঁজখবর নেয়নি। স্বামী হত্যার প্রতিবাদে ওইদিন থেকে আমি এক কাপড়েই দিনযাপন করছি। কেউ তো আমাদের খোঁজ করল না। কার কাছে বিচার চাইব, আমরা নিরাপরাধ স্বামীকে গুলি করে হত্যার বিচার কী হবে?’
প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মিরাজুল ইসলামসহ চারজন নিহত হন।
আজকালের খবর/ এম কে