শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ফেক নিউজ সহিংসতা উসকে দেয়
ড. মিজানুর রহমান
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই, ২০২৪, ৭:২৮ PM
বর্তমানে ফেক নিউজ বা গুজব ছড়ানোর সব থেকে জনপ্রিয় মাধ্যম ডিজিটাল বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স ইত্যাদি জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করলে আজকাল দেখা মেলে সোর্সবিহীন হাজারো তথ্যের যার আদতে কোনো ভিত্তি নেই। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করলেও এসব প্ল্যাটফর্মের তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে অক্ষমতা এবং ব্যবহারকারীদের বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার ভুল তথ্যের একটি সমারোহ তৈরি করেছে। তেমনি বিভিন্ন সময়ে জাতীয় কোনো ক্রান্তিকালে আন্দোলন এবং সহিংসতা উসকে দিতেও দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রামু কিংবা নাসিরনগরের ঘটনা কিংবা বর্তমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে নাশকতা।

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, বিশেষ করে ফেসবুক, এমন একটি স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তথ্যের দ্রুত বিস্তার হয়। দুর্ভাগ্যবশত, ভুয়া তথ্যও সমানতালে ছড়িয়ে পড়ে, যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত এবং উত্তেজিত করে তোলে। বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, যেখানে ফেক নিউজের প্রভাবে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। একটি সাধারণ ছাত্র আন্দোলনকে কিছু কুচক্রী মহল রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করেছে। আর তার ফলস্বরূপ আমরা দেখলাম কিছু নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং নাশকতা। আর এই সহিংসতা পরিচালনার জন্য তারা যে পন্থাটি অবলম্বন করেছে, তা হলো ফেসবুকে ফেক নিউজ ছড়ানো। এএফপি এবং রিউমার স্ক্যানারের মতো ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা থেকে এসব গুজব সম্পর্কে জানা গেছে।

বিভিন্ন পত্রিকায় এ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল যে, ‘স্পেন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী’। ২৩ জুলাইয়ের এ সফরটি পূর্বনির্ধারিত ছিল তবে ১৮ জুলাই থেকে ফেসবুকে চাউর হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন’। এক কবি, গীতিকার ও অভিনেতার নামে পেজ খুলে, সেখান থেকে সময় টিভির দোহাই দিয়ে লেখা হয়, ‘ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হলো আগামী ৭২ ঘণ্টা’। ফ্যাক্ট চেকিংয়ে বেরিয়ে এলো যে, সময় টিভি এমন কোনো সংবাদ প্রচার করেনি, এমনকি ওই পেজটিও কবি, গীতিকার ও অভিনেতা মারজুক রাসেলের নয়। তিনি নিজে ডিবির অফিসে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, এই উসকানিমূলক পেজটি বন্ধ করার জন্য যাতে তার মানহানি না ঘটে। তবে এ গুজবের ফলে নেটিজেনদের মধ্যে অনেক হিংস্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলে ২৭ জন এবং রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ জন নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের একটি গুজব রটানো হয়েছিল আন্দোলন চলাকালে। যার ফলে রোকেয়া হলের সামনে বহিরাগতদের ব্যাপক সহিংসতা দেখা দেয়। রংপুরেও এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়েছে। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, সেসব স্থানে ধর্ষণের এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।

সাইবার ৭১-সহ আরো অনেক পেজ ও ফেসবুক আইডি থেকে প্রথম আলোর বরাত দিয়ে একটি তথ্য ছড়ানো হয়েছিল যে, ‘শহীদের সংখ্যা ৯০০ ছাড়িয়ে গেছে।’ এর পরপরই আমরা দেখলাম কীভাবে সাধারণ ছাত্রছাত্রী, পুলিশ ও সাংবাদিকদের ওপর অতর্কিত হামলা হয়। তবে প্রথম আলো জানিয়েছে, তারা এমন কোনো সংবাদ প্রচার করেনি।

একটি ফেসবুক আইডি থেকে ২২ জুলাই বিকেলে একটি পোস্ট দেওয়া হয় কালবেলার বরাতে, ‘হাতিরঝিলে ১০০ ছাত্রের মৃত লাশ উদ্ধার। এখনো কি আপনাদের ঘরে বসে থাকার সময়? সবাই মিলে দেশটাকে আরেকবার স্বাধীন করুন।’ এ কথার মধ্যে প্রকাশ্যই উসকানি রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা একটি স্বাধীন দেশকে তারা আর কী বা কার থেকে স্বাধীন করতে চায়? এটি স্পষ্টতই সরকার পতন ষড়যন্ত্রের অংশ। তবে কালবেলা জানিয়েছে, তারা কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি।

সাইবার কমিউনিটি নামক পেজ থেকে ব্রেকিং নিউজ নামে একটি পোস্ট করা হয় যে, ‘সরকার পতনের ডাক দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।’ মুহূর্তেই কয়েক হাজার লাইক, কমেন্ট, শেয়ার হলো এ পোস্টটি। অন্য আরেকটি ভিডিও শেয়ার করা হয়, যেখানে দেখা যায় যে, হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় আন্দোলন করছে সরকার পতনের উদ্দেশ্যে। পরবর্তী সময়ে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে জানা যায় যে, এই ভিডিওটা গত বছর ইরাকে আশুরার একটি গণপদযাত্রার। তবে এসব চাউর হওয়ার পরপরই আমরা দেখলাম বাংলাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, যানবাহনে আগুন, হতাহত ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

জননিরাপত্তার স্বার্থে যখন পুলিশ-বিজিবি মোতায়েন করা হলো, তখন দেখা গেল পুলিশ ও বিজিবির বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এত বেশি পরিমাণে ছড়ানো হয়েছে যে, সহিংসতার সময়ে যাত্রাবাড়ীতে একজন পুলিশকে হত্যা করে ব্রিজের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় যে কী ভীষণ ঘৃণা তারা লালন করে সরকারি স্থাপনা ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

ফেক নিউজের হাত থেকে যেমন রক্ষা পাননি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তেমনি সেনাবাহিনীও। একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়েছিল এটা লিখে যে, সেনাবাহিনী মোতায়েনের আগে প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারের সঙ্গে মিটিং করেছেন। পরে ফ্যাক্ট চেকিংয়ে দেখা গেছে, সেই ছবিটিতে যাকে ভারতীয় হাইকমিশনার বলা হয়েছিল, তিনি আসলে সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার তারিক আহমেদ সিদ্দিক। তিনি ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা নন। ফেসবুকের বিভিন্ন ফেক পোস্টে এটিও দাবি করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী হিন্দিতে কথা বলেছে রাস্তাঘাটে অর্থাৎ তাদের দাবি ভারত থেকেও সেনাবাহিনী আনা হয়েছে।

ফেক নিউজ অনিচ্ছাকৃত বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত যেভাবেই ছড়ানো হোক না কেন, এতে ক্ষতির পরিমাণ সমান। ফেক নিউজ ছড়ানোর উদ্দেশ্য হতে পারে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, সরকার পতনের ষড়যন্ত্র, কারোর মানহানির উদ্দেশ্যে, একটি সমাজব্যবস্থায় ফাটল ধরানোর উদ্দেশ্যে, কোনো একটি বা দুটি ধর্মীয় জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা তৈরির জন্য, কিংবা ফেক নিউজের বহুল প্রচারের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য। যে উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন, দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি, সুরক্ষা, অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র এতে হুমকির মুখে পড়ে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হয় নাকি সাধারণভাবে শুধু মতামত প্রকাশ করা হয় এ দুটি প্রশ্ন এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তাই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে ফেক নিউজ বহুগুণে ছড়িয়ে পড়ার একটি পরোক্ষ অনুমতি আমরা দিয়েছি। এ ছাড়া এটি প্রোপাগান্ডা এবং চরমপন্থিদের মতামত প্রকাশের জন্য একটি স্থান সরবরাহ করেছে। যতক্ষণ না আমরা ফেক নিউজ সমস্যার যথাযথভাবে সত্যতা যাচাই ও আসল অপরাধীদের শাস্তি দিতে সক্ষম হব, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি সহিংসতাকে উসকে দেবে এবং আমাদের মানবাধিকার হুমকির সম্মুখীন হতে থাকবে। তাই, নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু শেয়ার করার আগে তথ্যসূত্র এবং ফ্যাক্ট যাচাই করা।

ইন্টারনেট আবিষ্কারের মূল কারণ মানবকল্যাণ সাধন করাই ছিল কিন্তু বর্তমানে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের এ ঘটনাই যার বাস্তব উদাহরণ।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ।

আজকালের খবর/আরইউ








http://www.ajkalerkhobor.net/ad/1724840661.gif
সর্বশেষ সংবাদ
ঢাকা ওয়াসার এমডি হলেন ফজলুর রহমান
১ অক্টোবর থেকে বিমানবন্দর এলাকা হর্নমুক্ত ঘোষণা
বিএসএমএমইউ শিক্ষক নিপুণ গ্রেপ্তার
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গ্রেপ্তার
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগে শরিক হতে প্রস্তুত বিশ্বব্যাংক
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
দিল্লিতে মেয়ের সঙ্গে থাকছেন শেখ হাসিনা, ঘুরতে দেখা গেছে লোদি গার্ডেনে
যুবককে পিটিয়ে হত্যা: ঢাবির ৫ শিক্ষার্থী আটক
ঢাবির হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনি, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির মৃত্যু
সেনাবাহিনীকে সব জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া ঠিক হবে না: ফখরুল
আগস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭৬ জনের মৃত্যু: যাত্রী কল্যাণ সমিতি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft