সাবেক পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশে কবি, সাহিত্যিক বা শিল্পীর অভাব নেই। দেশ, কাল, সীমানার গণ্ডি অতিক্রম করে তাদের অনেকের সৃষ্টিই আজ বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বিশ্ব দরবারের স্বীকৃতি আদায় অবশ্য মোটেও সহজ নয়। বেশিরভাগ কবি-সাহিত্যকের সৃষ্টির সঠিক মূল্যায়ন তাদের জীবদ্দশায় হয়ে ওঠে না। তবে মৌলিক সাহিত্য কোনদিনই সাহিত্য জগত থেকে হারিয়ে যায় না। কালের গহ্বরে হারিয়ে না যাওয়া বাংলাদেশের তথা বৃহত্তর বঙ্গসাহিত্যের এমনই এক বিরল প্রতিভা অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১)।
পূর্ববাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট গ্রামে ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অ্যাডোয়ার্ড ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পূর্ণ করে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলেও আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য ১৯৩৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কর্মানুসন্ধানে তৎকালীন বঙ্গদেশের রাজধানী কলকাতায় চলে আসেন অদ্বৈত। তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কলকাতা শহরে, বিশেষত নারকেলডাঙার ষষ্ঠীতলা লেনে অতিবাহিত করেছেন তিনি। ১৯৫০ এ দুরারোগ্য যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন কাঁচড়াপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও ষষ্ঠীতলা লেনের ভাড়া বাড়িতেই তার মৃত্যু হয় (১৬ এপ্রিল, ১৯৫১)।
ত্রিপুরা, নবশক্তি, দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, দেশ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও সম্পাদনার পাশাপাশি অদ্বৈত তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন কলকাতা শহরেই, যদিও তার স্মৃতি-সত্ত্বা জুড়ে ছিল নদীবিধৌত পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ।
কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ছোটগল্প ও উপন্যাস, বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব আঙিনাতেই অদ্বৈত স্বচ্ছন্দে ও অবাধে বিচরণ করেছেন। ষষ্ঠীতলার চিলেকোঠার ঘরে বসেই তিনি বাংলাভাষী পাঠকদের উপহার দিয়েছেন ‘সাদা হওয়া’, ‘রাঙামাটি’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নামের’ মতো কালজয়ী উপন্যাস। সৃষ্টি করেছেন ‘সন্তানিকা’, ‘স্পর্শদোষ’, ‘জীবন তৃষা’ ও ‘আশালতার মৃত্যু’র মতো বিখ্যাত সব সাহিত্যকর্মের। অসম্ভব রসবোধ ও গবেষকের দৃষ্টিতে তুলে এনেছেন সনাতন বাংলার পল্লিগীতি, লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতির বহু জানা-অজানা নিদর্শন। ‘ভারতের চিঠি-পার্ল বার্ককে’, ‘এদেশের ভিখারি সম্প্রদায়’, ‘বর্ষা মঙ্গল’, ‘আম্রতত’ বা আরো অনেক প্রবন্ধে ভারত-বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয় অঞ্চল বা ব্যাপকার্থে বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারাকে অনায়াসে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন অদ্বৈত। মুক্তকণ্ঠ ঘোষণা করেছেন ‘নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করার জন্য রাষ্ট্রের দ্বারা নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার’ যেন সার্বজনীন মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
অদ্বৈতর মৃত্যুর পর অদ্বৈত ও তিতাস প্রেমীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বহু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উৎপল দত্তের (১৯২৯-১৯৯৩) মতো নাট্যকারের প্রচেষ্টায় লিটল থিয়েটারের উদ্যোগে মিনার্ভাতে শোভা সেন (১৯২৩-২০১৭) এবং বিজন ভট্টাচার্যের (১৯১৫-১৯৭৮) মতো বিখ্যাত নাট্যকারের অংশগ্রহণে নাটকরূপে ১০০ রাত ধরে ‘তিতাশ একটি নদীর নাম’র প্রদর্শন (১০ মার্চ-২০ জুন ১৯৬৩) অদ্বৈত মল্লবর্মণকে কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত করে তোলে।
স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানের পর (১৯৭১) ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের (১৯২৫-১৯৭৬) হাত ধরে তিতাসের চলচ্চিত্রায়ন (১৯৭৩) ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তথা অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বাংলাদেশ ও ভারতের বিনোদন, সংস্কৃতি ও চিন্তার জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে ‘পশ্চিমবঙ্গ মৎস্যজীবী সমিতি (১৯৬৯)’ ও ‘বাংলা একাডেমি’র (ঢাকা) অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’র সাহিত্যিক নির্যাস অদ্বৈত মল্লবর্মণকে সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৯০’র দশকে ড. কল্পনা বর্ধন-কৃত তিতাসের ইংরেজি অনুবাদ ও পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অদ্বৈত-সাহিত্যের অন্তর্ভুক্তি বিশ্বের দরবারে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে পরিচিতি এনে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তথা দলিত জনগণের প্রতিনিধিরূপে অদ্বৈত মল্লবর্মণের নামে ত্রিপুরা সরকার বিশ শতকের শেষ লগ্নে ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাহিত্য পুরস্কার’, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ উৎসব’ ও আগরতলা বইমেলায় ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ দিবস’ পালনের প্রচলন করেছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে উচ্চবিদ্যালয় (অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়), মহাবিদ্যালয় (অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি মহাবিদ্যালয়) ও গ্রন্থাগারের নামকরণ সহ আরো বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল মানিক সরকারের নেতৃত্বাধীন ত্রিপুরা বামপন্থী সরকার (১৯৯৮-২০১৮)।
একুশ শতকের গোড়ায় ত্রিপুরা সরকার আয়োজিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ পুরষ্কার প্রদানের অনুষ্ঠান বেশ কয়েকবার কলকাতাতেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাম জমানায় পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিবান মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (২০০০-২০১১) এই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করে অদ্বৈত-সাহিত্যের ভূয়ষী প্রশংসাও করেছেন।
কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, ত্রিপুরা বা বাংলাদেশ অদ্বৈতর নামে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, আবক্ষমূর্তি স্থাপন (গোকর্ণঘাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া), প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার নামে কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেনি। এমনকি, অতীব লজ্জা ও দুঃখজনক বিষয় এই যে, অদ্বৈত মল্লবর্মণের নামে একটি ছোট গলি রাস্তারও নামকরণ করা হয়নি! ‘পশ্চিমবঙ্গ মৎস্যজীবী সমিতি’ (১৯৬৯), ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ এডুকেশনাল ও কালচারাল সোসাইটি (১৯৯৪)’ ও ‘বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’ একাধিকবার দেন-দরবার করলেও কলকাতার ষষ্ঠীতলা লেনের নামকরণ অদ্বৈত মল্লবর্মণের নামে নামাঙ্কিত করার কোনো পদক্ষেপ পশ্চিমবঙ্গের বামশাসিত সরকারও গ্রহণ করেনি। এখনো পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে অদ্বৈতর নামাঙ্কিত যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাহলো সুদূর উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জেলা আলিপুরদূয়ারের ২ নম্বর ব্লকের টটপাড়া ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের কয়াকাতা গ্রামের ‘অদ্বৈত পাঠাগার’। সেটাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেসরকারি ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ এডুকেশনাল ও কালচারাল সোসাইটি’ ও অদ্বৈতর স্বজাতিবর্গের উদ্যোগে (২০১৭)। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা এতে নেই।
২০১১ সালে রাজনৈতিক পালাবদলের পর পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চানন বর্মা (কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়), হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর (হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয়), যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বি. আর. আম্বেদকরসহ (প্রস্তাবিত বি. আর. আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয়) আরো অনেক তপশিলি জাতিভুক্ত বিশিষ্ট্য ব্যক্তিদের নামে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলেও অদ্বৈত মল্লবর্মণ ব্রাত্যই থেকে গেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল কেন এই উপেক্ষা? সরকারি পদক্ষেপগুলো কি শুধুমাত্র নির্বাচনী রাজনীতির দিকে লক্ষ্য রেখে সংখ্যায় বৃহৎ তপশিলি জাতিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গৃহীত হয়? প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে পশ্চিমবঙ্গে মালো (ঝালো-মালো) সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা মাত্র তিন লাখের মতো (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী তিন লাখ তিন হাজার ৬১৮ জন)। আসামে তাদের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি (২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ৭৭ হাজার ৫৩৩ জন)। ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের মালোদের জনসংখ্যা নির্ণয়ের কোনো তথ্য নেই। আমাদের হিসাব অনুযায়ী ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে মালোদের মোট জনসংখ্যা দশ লাখের মতো।
স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যার বিচারে মালোদের ভোট রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব নেই। সংখ্যার দিকে না তাকিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের নামে কি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারে না? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় না হোক তার নামে পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলা সাহিত্য’ বা ‘সমাজতত্ব’ বিভাগে অন্তত একটি চেয়ার-অধ্যাপকের পদ তৈরির কথা ভাবা কি অন্যায় হবে? নিদেন পক্ষে তার স্মৃতিবিজড়িত সড়ক ও এলাকাতেও তো কোনো স্থাপনা বা নামকরণ করা যায় ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ পরম্পরা বজায় রাখার স্বার্থেই।
আজকালের খবর/আরইউ