রিতা বাবার বাড়ি থেকে এক সপ্তাহ থেকে আজ নিজের বাসায় আসলো। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ ছিল। তাই মায়ের সাথে কয়েকদিন কাটিয়ে আসলো। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা একদম একা। রিতার মাকে ছেড়ে আসতে মন একদমই চায়নি না। কিন্তু উপায় নেই। নিজের সংসার ছেড়ে কতদিন থাকা যায়? তাছাড়া বাচ্চাদের স্কুল আছে। রিতার হাসবেন্ড হাবিবের খাওয়ার সমস্যা হয়। শাশুড়ি মা এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। হাবিবকে এই কয়দিন বাহিরে খেতে হয়েছে।
রিতার মা বাড়িতে একা থাকে। দুই ছেলে দুই জায়গায় থাকে। রিতার মা ছেলেদের সাথে থাকতে পারেন। কিন্তু থাকেন না। কারণ দুই একবার ছেলেদের বাসায় থাকতে গিয়ে নানান সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। রিতার মা ও ভাবিদের মধ্যে মতের মিল হয় না। পরে ছেলেদের শান্তির জন্য বাড়িতে চলে আসেন। ছেলেরা আগে মাঝে মাঝে আসতো দেখতে। এখন কম আসে। তারাও ব্যস্ত। মাসে মাসে টাকা পাঠায়। কিন্তু একা মানুষ কখন কী লাগে? কাছে কেউ নেই। পরিচিত একটা ছেলে আছে। যাকে কিছু টাকা দিয়ে বাজার করান রিতার মা। কাজের মহিলা রাতে থাকে না। সকালে এসে যা করার করে দিয়ে যায়।
রিতা এবার বাড়িতে গেলে রিতার মামা হারুন এসেছিলেন। রিতার দুই ভাইও এসেছিল। হারুন রিতার মায়ের জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছেন। সেই লোকটার (কামাল) বয়সও বেশি হবে না। রিতার বাবার বয়সের হবেন। কামালের আর্থিক অবস্থা ভালো। স্ত্রী মারা গেছে পাঁচ বছর। ছেলে মেয়েরা যার যার মতো। কেউ তেমন খোঁজখবর রাখে না। একা জীবন অনেক কষ্টের। নিজের বাড়ি আছে। বিজনেস আছে। ছেলেদের উপর নির্ভরশীল নয়।
কামালের কিছুই চাই না। একজন ভদ্র মহিলা চাই। যার সাথে বাকি জীবন কাটাতে পারবেন। রিতার মামা কামালকে রিতার মায়ের ছবি দেখায়। ওনার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রথমে রিতার ভাইয়েরা রাজি হতে চায়নি। রিতা ভাইদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করায় এই সাতদিনে। ভাইদের বলে, মা একা থাকে। তাকে দেখার কেউ নেই। কোনো খবর শুনলেও আসতেও সময় লাগে। তাছাড়া মা একা একা এভাবে থাকলে শরীর খারাপ হবে। তার চিন্তা লেগেই থাকবে। একাকীত্বের মধ্যে মা বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। মাকে একা রেখে সবাই কম বেশি চিন্তায় থাকি। সারাজীবন মা আমাদের জন্য করেছে। এখন মায়ের ভালোর জন্য এতটুকু করতেই পারি আমরা। আর এখন অনেকেই জীবনে একাকিত্বের জন্য বিয়ে করছে। মাই প্রথম নয় যে দ্বিতীয় বিয়ে করছে।
দুই ভাই রাজি হলেও, রিতার মা শোনা মাত্রই রেগে যান। মাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করায় তিন ভাই বোন মিলে। এই বয়সে একা থাকা নিরাপদ নয়। একজন কাছে থাকলে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকা যায়। সবাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে। মা রাজি হচ্ছিল না। ভাবিরাও অনেক বোঝালো। কারণ তারাও চায় মা একা না থাকুক। তারপর শেষে মত দিয়েছেন রিতার মা।
রিতা ভেবে পাচ্ছে না হাবিব ও শাশুড়ি মাকে কীভাবে কথাটা বলবে। তবে রিতা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। হাবিব মত না দিলেও রিতা মায়ের শান্তির জন্য যা করা লাগে করবে। কারো মতামতের তোয়াক্কা করবে না। হাবিব বা শাশুড়ি আম্মা কেউ চাইবে না। রিতার তার মাকে এখানে এনে রাখুক। তাহলে মায়ের যাতে ভালো হয়। রিতা তাই করবে।
রাতে রিতা হাবিবকে সব খুলে বলল। হাবিব কিছুতেই মানতে পারছে না। শুধু বলছে, মানুষ কী বলবে? তোমার ভাই ভাবিদের বলো মাকে তাদের কাছে রাখতে।
রিতা হাবিবকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়। এই বিয়েতে মত না থাকলে। মাকে আমার কাছে এনে রাখবো। দরকার হলে মাকে জোর করে রাখবো আমার কাছে। এভাবে মাকে একা রেখে আমি শান্তি পাই না। তোমার মাকে নিজের মায়ের মতোই মনে করি। দায়িত্ব পালন করি। তোমার অন্য ভাই বোন কেন আম্মাকে দেখে না। সে প্রশ্ন তোমাকে কোনোদিনই করি নাই। তাই আমার মায়ের দায়িত্ব ভাইরা কতটুকু পালন করবে এটা তাদের বিষয়। আমি মেয়ে বলে আমার কী কোনো দায়িত্ব নেই?
হাবিব বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে আর কিছু বলল না রিতাকে। সকালে রিতা তার শাশুড়ি মাকে জানালো সবকিছু। হাবিব এতো কথা বললেও রিতার শাশুড়ি মা শুনে খুশি হলেন। উনি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। খুব খুশি হলেন। আরো বললেন, এই বয়সে একা থাকা অনেক কষ্টের। তোমরা আছো তাই আমি এখনো সুস্থ আছি। একা থাকলে কবেই মরে যেতাম। অন্য ছেলে মেয়ে দুটো তো খোঁজ রাখে না তেমন।
রিতা দেখলো মায়ের চোখে পানি ছলছল করছে। রিতা শাশুড়ি মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বলল, আমরা থাকতে আপনি একা হবেন কেন? আপনি আছেন মাথার উপর ছাঁদ হয়ে। সাহস পাই সবসময় আপনার কাছে থেকে। মা সবসময়ই আপনার প্রশংসা করে বলেন, এমন শাশুড়ি হয় না। একদম মায়ের মতো। আজ আব্বা (শ্বশুর) নেই। সবসময় মনে হয় আব্বাকে। আব্বা থাকলে আরও ভালো হতো।
রিতা শাশুড়ি মাকে জানালো হাবিব কী বলেছে। উনি বললেন, কোনো সমস্যা নাই। আমি বুঝিয়ে বলবো। আর তোমার মা আমাকে দাওয়াত দিবে না? রিতার আনন্দে চোখে পানি চলে আসলো। শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি না গেলে হবে? আপনার তো থাকতেই হবে। মা শুনলে কী যে খুশি হবে! মা হাবিব আর আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছিল। মেয়ের শ^শুর বাড়ির মানুষ কী ভাববে?
রিতার শাশুড়ি রিতাকে বলল, তোমার কিছু বলতে হবে না। আমিই কথা বলবো তোমার মায়ের সাথে। রিতা অনেক ভয়ে ছিল শাশুড়ি আম্মা কী বলে তা নিয়ে এখন শান্তি লাগছে। হাবিবও রাজি হবে এবার। মায়ের কথা ফেলতে পারবে না।
অবশেষে হাবিব সহ রিতা ও সবাই বিয়েতে গেল। ছোট করে অনুষ্ঠান হলো। শুধু দুই পরিবারের মানুষজন ছিল। কামালের দুই ছেলে এসেছিল। লোকটাকে ভালো লেগেছে সবার। অনেক প্রাণবন্ত মানুষ। হাসিখুশি থাকে সবসময়ই। রিতাকে বারবার বলল, এখন কিন্তু সোজা মায়ের কাছে চলে আসবে। যখনই ছুটি পাও। রিতার শাশুড়িও রিতার মা আর কামালকে দাওয়াত দিয়ে আসলো ঢাকায় আসতে।
মায়ের বিয়ের এক মাস হলো। রিতা ভিডিও কলে কথা বলে মায়ের সাথে। কামাল ভালো মোবাইল কিনে দিয়েছেন। আজ রিতার মা আর কামাল কক্সবাজার বেড়াতে গেল। এক সপ্তাহ নানা জায়গায় ঘুরবে ঠিক করেছেন কামাল। আগামী বছর হজ্জে যাওয়ার চিন্তা করছে দুজন। শুনে খুব খুশি হয়েছে রিতা।
মাকে দেখলে এখন রিতার খুব শান্তি লাগে। মায়ের বয়স যেন কমে গেছে। অসম্ভব সুন্দর লাগে মাকে দেখতে। বুঝতে পারে রিতা কামাল মায়ের যত্ন নেয়। অনেক ভালো রেখেছেন মাকে। রিতা দূরে থেকে মা আর কামালের জন্য দোয়া করে। তখন চোখ দিয়ে দু’ফোটা আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়ে।
আজকালের খবর/আরইউ