বলা হয়ে থাকে রবিন ঘোষ ‘একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। বরেণ্য সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে উপমহাদেশে নিজের অবস্থান মজবুত করেছিলেন। গজল সম্রাট মেহেদী হাসান ও আহমেদ রুশদির সাফল্যের পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য।’ প্রণয় সূত্রে উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তী অভিনেত্রী শবনম ছিলেন তার সহধর্মীনী। পরিচ্ছন্ন ইমেজের এই দম্পতি পাকিস্তানজুড়ে কাজের সুবাদে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও শ্রদ্ধাভাজন। জীবদ্দশায় অর্জন করেছেন নানাবিধ স্বীকৃতি ও সম্মাননায়। ১৯৩৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বাবার চাকরির সুবাদে বাগদাদে জন্মেছিলেন রবিন ঘোষ। যদিও তাদের পূর্বপুরুষদের ভিটা নরসিংদীতে। তারা ছিলেন মাইগ্রেটেট খ্রিস্টান। ছোট বেলা থেকেই সংগীতের প্রতি আকর্ষন অনুভব করতেন রবিন। বাগদাদে থাকাকালীন দেশটির আরব সংগীতের ছায়া মনে গভীর রেখাপাত করে। পরবর্তীতে যুগে সে ছায়া তার কর্মের নিজস্ব সৃষ্টির অংশ হয়ে যায়। যে কারণে তার তুলনা তিনি নিজেই। তার কর্মময় জীবন ১৯৬১ থেকে আশির দশক পর্যন্ত। এরপর বাকি জীবন সংগীতের খোঁজ খবরের আড়ালে কেটে গেলেও গুণী এই মানুষটিকে পিতৃভূমিতে বঞ্চনার আপসোস নিয়েই ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আজকের এই দিনে ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য ওয়াল’ অনলাইন রবিন ঘোষকে আখ্যা দেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরেন। সেখানে লেখা হয়- “আয়ুব খানের রাজত্ব থেকে জেনারেল জিয়াউল হকের রাজত্ব। প্রায় ২৫ বছর পাকিস্তানকে সুরের মূর্ছনায় ভাসিয়েছেন এক বাঙালি। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে ক্রিকেট মাঠ সব বিষয়েই ভারত পাকিস্তানে ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে, তাই এই ২৫ বছরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্ষমতা দখলের ময়দানে ইয়াহিয়া খান-ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলি ভুট্টো-ইন্দিরা গান্ধী, তো ক্রিকেটের ময়দানে গাভাসকার-সরফরাজ নওয়াজ থেকে জাভেদ মিঁয়াদাদ- কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত, সব ক্ষেত্রেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর চলছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাঙালি মুক্তিবাহিনী রূপকথার যুদ্ধ লড়ছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। ভারত যথাসম্ভব সাহায্য করছিল মুক্তিবাহিনীকে। জেনারেল নিয়াজি হার মানছিলেন, পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করছিল ইস্টার্ন কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। পরাজয়ের অভিঘাতে ভারত আর বাংলাদেশের প্রতি, প্রকারান্তরে বাঙালির প্রতি তীব্র ঘৃণা উগরে দিচ্ছিলেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে ভারত আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও পাকিস্তানের প্রতি ততোধিক ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি সিনেমার অন্যতম সেরা সঙ্গীত পরিচালক রবীন ঘোষ আগ্নেয়গিরির মতো এহেন পরিস্থিতিতেও প্রায় পঁচিশ বছর ধরে পাকিস্তানের সিনেমা জগৎ বা ললিউডকে সুরের জাদুতে মুগ্ধ রেখেছিলেন। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম তার সঙ্গে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আর ডি বর্মণের তুলনা করে। কেউ রবীন ঘোষকে বলেন পাকিস্তানের আর ডি, কেউ আরেকটু এগিয়ে বলেন পাকিস্তানের নৌশাদ।”
প্রায় আড়াই দশকের ক্যারিয়ারে যে গানগুলোর সুরের মূর্ছনায় নিজের ঘরানার সৃষ্টি করেছিলেন, তেমন ১০ জনপ্রিয় উর্দু গান নিয়ে এ নিবন্ধে আলোকপাত করা হলো-
‘কাভি তো তুম কো ইয়াদ আয়েঙ্গি’: আহমেদ রুশদির কণ্ঠের এই গানটির ১৯৬৭ সালের চকোরি সিনেমার জন্য সংগীতায়োজন করেছিলেন রবিন ঘোষ। চকোরি ছিল পাকিস্তানি সিনেমার ভবিষ্যত সুপারস্টার নাদিমের কেরিয়ারের সূচনা। একই সিনেমার অপর ট্র্যাকটি ছিলো কাহা হো তুমকো ধুন্দ রাহি হ্যায়। গান দুটো ব্যাপক হিট করে।
‘হামে খো কার বোহাত পাছতাও গে’: রুনা লায়লার কণ্ঠের এই গানটি ‘এহসাস’ সিনেমার। কথা সমৃদ্ধ এই গানটি লিখেছিলেন সুরুর বারাভাঙ্কভি। বলা হয়ে থাকে গানের কথা কম্পোজিশনকে ছাপিয়ে গেছে। সুরুর বারাবাঙ্কভি এই ছবিতে রবিন ঘোষের জন্য তার হৃদয়ের কথা লিখেছিলেন। সঙ্গে শবনমের জাদুকরী চোখের ধ্রুপদী কারুকাজ গানটিরকে স্মরণ রাখার জন্য যথেষ্ট।
‘সাওয়ান আয়ে’: গানটি দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছেন ইখলাক আহমেদ ও রুনা লায়লা। ‘চাহাত’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৭৪ সালে। সিনেমাটি পরিচালনা করেছিলেন অভিনেতা ও পরিচালক রেহমান। রবিণ ঘোষের সঙ্গে ছিলো তার পারিবারিক বন্ধুত্ব। জানা যায়, চোখ বুঁজে তিনি রবিনের ওপর সঙ্গীতের দায়িত্বভার দেন। এই গানটির জন্য রেহমান-রবিন আজও শ্রোতা-দর্শকের কাছে জনপ্রিয়।
‘পেয়ার ভরে দো শর্মিলায় নাইনে’: চাহাত সিনেমার জন্য গজল সম্রাট মেহেদি হাসানকে দিয়ে রবিন ঘোষ গজলের আঙ্গিকে গানটি করান। এরপর বাকিটা ইতিহাস। রবিন ঘোষ বহুমুখী সঙ্গীত রয়িতা হিসাবে তার দক্ষতা প্রমাণ করেছিলেন। কারণ যাকে দিয়ে ঝুঁকি নিবেন তিনি ইতিমধ্যে গজল সম্রাটের আসন অলংকৃত করেছেন। আর সে চ্যালেঞ্জটি নিয়ে স্লো-টেম্পো গানটি তার কণ্ঠে তুলে দেন এবং প্রমাণ করেন স্লো-টেম্প ভার্সনে মেহেদী হাসান অপ্রতিদ্বন্দী।
‘দেখো ইয়ে কৌন আগায়া’: দো সাথী (১৯৭৫) ইখলাক আহমেদ ইখলাক আহমেদ এই গীতিনাট্যে উজ্জ্বল ছিলেন যেখানে প্রেমিকা তার প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষা করছে এবং অবশেষে যখন সে আসে তখন সবকিছু সুন্দর হয়ে যায়। এটি রবিনের সমসাময়িকদের মধ্যে জনপ্রিয়দের বিপরীতে পটভূমিতে একটি গুণমানের কোরাস সহ হৃদয় থেকে স্পষ্টভাবে রচিত হয়েছিল
‘মুঝে দিল সে না ভুলানা’: পাকিস্তান সিনেমার রেকর্ডধারী ‘আয়না’ (১৯৭৭) সিনেমার একাধিক গান আজোও জনপ্রিয়। ‘মুঝে দিল সে না ভুলানা’-এর তিনটি সংস্করণে বিভিন্ন গায়ক, গীতিকার এবং কম্পোজিশন ছিল - একটি ছিল একটি প্রেমের যুগল, অন্যটি একটি নস্টালজিক এবং শেষটি চলচ্চিত্রের ক্লাইম্যাক্সে ব্যবহৃত হয়েছিল। পপ তারকা আলমগীর এবং গজল কিং মেহেদি হাসান তাদের সংস্করণের জন্য যথাক্রমে বিশেষ পুরস্কার এবং সেরা প্লেব্যাক গায়কের খেতাব জিতেছেন। এতে নারী কণ্ঠ দিয়েছেন মেহনাজ বেগম। ক্লাইম্যাক্সটি সুন্দরভাবে গেয়েছিলেন নায়ারা নূর (শিশুসুলভ কণ্ঠে)।
‘কাভি আমি খুঁজতা হুঁ’: আয়না সিনেমার অপর গানটি গেয়েছেন মেহেদি হাসান। গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন অমিতাভের মজবুরের একটি গান থেকে অনুপ্রাণিত হতে পারে তবে বাকি সংখ্যাটি পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে। মেহেদী হাসানকে কীভাবে একজন গায়ক হিসেবে উপস্থাপন করতে হয় যিনি হৃদয় জয় করতে পারেন তা কেবল রবিন ঘোষই বুঝতে পেরেছিলেন এবং তিনি গজল রাজার কণ্ঠের শক্তিকে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছিলেন।
‘মিলায় দো সাথী’: ‘আম্বার’ (১৯৭৮) গানটি এ. নায়ারের কন্ঠে তুলে দিয়েছিলেন রবিন ঘোষ। এ. নায়ার রবিন ঘোষের জন্য অসংখ্য গান করেছিলেন। ৭০-৮০’র দশকে আহমেদ রুশদি ৬০-এর দশকে তার সেরা নয়ারদের মধ্যে অন্যতম। উভয়েই দ্রুতালয়ের এবং স্লো-ট্র্যাকের গানের জন্য বিশেষ সমাদৃত ছিলেন। চমৎকারভাবে রবিন ঘোষ তাদের কণ্ঠ সিনেমায় তুলে এনেছিলেন।
রবিন ঘোষকে মনে রাখার জন্য নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘বন্দিশ’ সিনেমাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর সমস্ত গান ছিল বলিউডি ধাঁচের।
‘সামা ওহ খোয়াব সা সামা’: ‘নাহিন আভি না’ (১৯৮০) সিনেমাতে ইখলাক আহমেদের কণ্ঠে কৈশোর বয়সী এক নায়ক ফয়সাল রেহমান এবং আয়াজ নায়েককে এ সিনেময় পরিচয় করিয়ে দেন। এ সিনেমার গানগুলো লিখেন সুরুর বারাবাঙ্কভি। ব্যবসায়িকভাবে এ সিনেমার সব গানই সুপারহিট ছিলো।
‘তু হ্যায় দিল কি ধড়কা’: ‘জো ডার গয়া ওহ মার গায়া’ (১৯৯৫) সিনেমায় গুলাম আব্বাসের কণ্ঠে এ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে এ গানটি করে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দেন রবিন ঘোষ। গানে লিপে ছিলেন নাদিম। এই গানটি তাকে গোলাম আব্বাস এবং নাদিমের সাথে পুনরায় একত্রিত করে।