বিশ্বজুড়ে আছে অনেক রকম মেলা। একটি দেশের ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে এসব মেলার উৎপত্তি। মেলার রকম যেমনই হোক, মেলা মানেই মিলন-মেলা; আনন্দ ও উৎসব। প্রাণে প্রাণে মিলিত হওয়ার অনন্য এক মাধ্যম মেলা। তবে একটি মেলার ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশেই মিল পাওয়া যায়। পৃথিবীর অনেক দেশই এই মেলাটির আয়োজন করে থাকে। সেটি হল বইমেলা বা Book Fair। আমাদের দেশে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি দুই বিষয়েই বইমেলা বা Book Fair অনুচ্ছেদ লিখতে হয়।
বইমেলায় অনেক বইয়ের দোকান বা বুক স্টল থাকে। কে কত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকরভাবে স্টল তৈরি করবে সে ব্যাপারেও প্রতিযোগিতা চলে। অসংখ্য লেখকের নানা স্বাদের বই দিয়ে সুসজ্জিত থাকে স্টলগুলো। বইপ্রেমিরা বইমেলায় ভিড় করে একা অথবা স্বপরিবারে অথবা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। পছন্দমতো বই কেনে, আনন্দ-উল্লাস করে, খাওয়া-দাওয়াও হয়। মেলা প্রাঙ্গণ জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ। মানুষকে বইমুখি করার জন্য বইমেলার চেয়ে বড় আয়োজন আর নেই।
বইমেলার ইতিহাস কিন্তু অনেক প্রাচীন। কাগজ আবিষ্কার মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় বড় মাইলফলক। কাগজ আবিষ্কারের ফলে মানুষের ভাষাকে বর্ণমালা দিয়ে ধরে রাখা সহজ হল। এই অগ্রযাত্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিল পনেরো শতকে গুডেনবার্গের মুদ্রাযন্ত্র আবিষ্কার। কাগজের বুকে হাতের লেখার পরিবর্তে চলে এল ছাপা অক্ষর। গড়ে উঠল ছাপাখানা। লেখায় এল অকল্পনীয় গতি। আর সে থেকেই সূচনা হল বইয়ের। বলা হয় যে, সেই সময়েই জার্মানিতে বইমেলার সূচনা হয়। অনেকে মনে করেন, জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা হয়। মতান্তরে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে। ১৭ শতকের পর ইউরোপসহ বিশ্বের আরো কিছু দেশে বইমেলা শুরু হয়।
সারাবিশ্বে এখন অনেকগুলো আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়ে থাকে। সারাবিশ্বে এখন যে সব আন্তর্জাতিক বইমেলা হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো-ফ্রাঙ্কফুট বইমেলা, লন্ডন বইমেলা, আন্তর্জাতিক কোলকাতা বইমেলা, নয়াদিল্লি বইমেলা, কায়রো বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা, আবুধাবি বইমেলা ইত্যাদি।
আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের এই মাতৃভাষার আছে গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রক্তদামে কেনা আমাদের এই বাংলা ভাষা। এই বাংলা ভাষায় আছে জাতীয় ও বিশ্বমানের সাহিত্যিক ও সাহিত্যকর্ম। আমাদের দেশেও বইপ্রেমী মানুষের আকুল আকাক্সক্ষা মেটাতে বছরের বিভিন্ন সময়, দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজন হয় বইমেলার। তবে বইমেলা বা গ্রন্থমেলা শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে যে মেলার কথা চলে আসে সেটি হল বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে এই মেলা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কবি-লেখক ও বই প্রেমীদের পদধ্বনি বাজে এই মেলায়। একুশে বইমেলা আমাদের ভালোবাসা-আমাদের প্রাণের স্পন্ধন। আমাদের এই একুশে বইমেলারও আছে উল্লেখযোগ্য ইতিহাস। আজ আমরা এই মেলার যে বিশাল, বৈচিত্র্যময় রূপ ও আড়ম্বর দেখতে পাই একদিনে সেটি হয়নি। অনেক পথ অতিক্রম পথ, অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে।
সরদার জয়েন উদ্দীন; শিশুসাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান। তিনি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছেন। বাংলা একাডেমি থেকে ষাটের দশকে তিনি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। তিনি যখন বাংলা একাডেমিতে ছিলেন তখন বাংলা একাডেমি প্রচুর বিদেশি বই সংগ্রহ করত। একদিন তিনি একটা বই পেয়ে যান নাম- Wonderful World of Books. এই বইটি পড়তে গিয়ে তিনি দু’টি শব্দ পেয়ে যান Book এবং Fair। বইয়ের মেলা হতে পারে এবং বইয়ের প্রচার ও প্রসারে এই মেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তিনি সেটি অনুধাবন করতে পারেন।
ওই বইটি পড়ার কিছু পরেই সরদার জয়েন উদ্দীন ইউনেস্কোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করছিলেন। কাজটি শেষ হওয়ার পর তিনি ভাবছিলেন বিষয়গুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনী করবেন। তিনি একটা শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করে ফেললেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নিচতলায়। যতদূর জানা যায়, এটিই ছিল স্বাধীনতার পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানের (যেহেতু তখন বাংলাদেশের জন্ম হয়নি) প্রথম বইমেলা। এটি হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় আলোচনা সভারও ব্যবস্থা ছিল। আলোচক ছিলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহীদ মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম। এই মেলায় সরদার জয়েন উদ্দীন একটি মজার কাণ্ড করেছিলেন। তিনি মেলার ভেতর একটা গরু বেঁধে রেখে তার গায়ে লিখে রাখেন- ‘আমি বই পড়ি না।’ এই কাণ্ডটি জনগণকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পরও আমাদের বইমেলার সাথে সরদার জয়েন উদ্দীনের নাম জড়িয়ে যায়। ১৯৭২ সালে তিনি যখন গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক, তখন ইউনেস্কো এ বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ ঘোষণা করে। আর এ উপলক্ষ্যেই ডিসেম্বর মাসে সরদার জয়েন উদ্দীন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। এ সময় একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি। তবে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী, মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলাম তাদের বই নিয়ে বসে যান। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বড় আকারের সাহিত্য সম্মেলন হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সে উপলক্ষ্যে নিজামী, চিত্তবাবু, তাজুল ইসলামসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরের দেয়াল ঘেষে বই সাজিয়ে বসেন। এভাবেই বিচ্ছিন্নভাবে বই বিক্রর উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমিতে একটি বইমেলা আয়োজনের জন্য গ্রন্থমনস্ক মানুষের চাপ বাড়তে থাকে।
১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। এরপর প্রতি বছর মেলার আকার-আয়তন বাড়তে থাকে। প্রকাশনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও পাঠকের সংখ্যা। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের শক্তিশালী ভিত গড়ে উঠতে থাকে। এখন এই মেলা চলে মাস জুড়ে। পৃথিবীতে এক মাসব্যাপী আর কোনো বইমেলা নেই।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত এই অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। বইমনস্ক, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক প্রগতিশীল বিকশিত মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে এই বইমেলার অবদান অনস্বীকার্য। এই মেলায় শুধু যে বইয়ের প্রদর্শন ও বেচা-কেনা হয় তা নয়। বইমেলা চালাকালীন প্রতিদিন বিভিন্ন আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর, লেখক আড্ডাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। লেখককুঞ্জে লেখকদের সঙ্গে পাঠকের মত বিনিময়ের সুযোগ থাকে। থাকে তথ্যকেন্দ্রে বিভিন্ন নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের খবর। থাকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের লোকজন। নিয়মিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে বইমেলার আপডেট খবর প্রকাশিত হয়, সারসরি সম্প্রচার হয়।
কিন্তু এই প্রাণের বইমেলা নিয়ে প্রকাশক ও লেখক পর্যায়ে কিছু অভিযোগ-অনুযোগও আছে। তরুণ-মেধাবী কবি-লেখকরাও বিভিন্নভাবে হেনস্থার শিকার হয় প্রকাশকদের দ্বারা। প্রকাশকরা বলেন বই বিক্রি হয় না। আর পাঠকরা অভিযোগ করেন, অনেক নিম্ন মানের বইয়ে সয়লাব হয় বইমেলা। কারো অভিযোগই পুরোপুরি মিথ্যে নয়। অনেক প্রকাশকই যথাযথ সম্পাদনার মাধ্যমে মানসম্মত বই প্রকাশ না করে লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যা-তা বই করে ফেলেন। এমন অনেক প্রকাশক আছেন যারা সম্পূর্ণভাবেই লেখকের টাকায় বই করে অভ্যস্থ। টাকা নিয়েও ঠিকমতো লেখকের হাতে বই তুলে দেন না এমন অভিযোগও কম নয়। এ ব্যাপার আমার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। কয়েক বছর আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এক তরুণকে একটা স্টলের সামনে বিমর্ষভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তাকে জিজ্ঞেস করি-আপনার কি কোনো বই এসেছে? তিনি আমাকে জানান-তিনি টিউশনি করে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে জমিয়ে মোট ১৬ হাজার টাকা প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ফেব্রুয়ারির অনেক আগেই। কিন্তু প্রকাশক তার বই তখন পর্যন্ত করেননি। ফোন করলে প্রকাশক ফোন ধরেন না। স্টলে এসেও তাকে পান না। মেলা প্রায় শেষের দিকে। আর কবে বই দেবেন? সত্যি যুবকটির জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। তিনি শেষ পর্যন্ত বই পেয়েছিলেন কিনা জানি না। তখন আমি তাকে শুধু এটুকুই বলি-আপনারা বই প্রকাশের জন্য এত পাগল হয়ে ওঠেন কেন? পড়বেন আর লিখবেন। লেখা প্রকাশের জন্য তো পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া আছেই।
রাষ্ট্রের এ ব্যাপারে কিছু একটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বই যদি না চলে, বই যদি বিক্রি না হয় তো আপনি প্রকাশনা ব্যবসায় আসবেন না। শুধু লেখকের টাকায় প্রকাশনা ব্যবসায় চালাবেন এটি কেমন কথা? হাতেগুনা কয়েকজন লেখক ছাড়া আর কেউ-ই রয়েলিটি পান না। হাতেগুনা কয়েকটি প্রকাশনা ছাড়া অন্য কোনো প্রকাশনা রয়েলিটি দেয় না।
আমাদের প্রাণের এই বইমেলা নিয়ে অভিযোগের বাইরেও আমদের কিছু দুঃখবোধ আছে। প্রতিক্রিয়াশীল, পশ্চাৎপদ, বদ্ধ চিন্তার কিছু মানুষ সব সময়ই আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। তারা এই বইমেলার ওপর আঘাত হানতেও দ্বিধাবোধ করেনি। ২০১৩ সালে দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ে যায় বইমেলার বেশ কিছু স্টল। সেই ঘটনার পরই ২০১৪ সাল থেকে বইমেলাকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। বাড়ানো হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই বইমেলায় নির্মম আক্রান্তের শিকার হোন ভাষাবিদ ও বহুমাতৃক লেখক হুমায়ূন আজাদ। মুক্ত চিন্তার লেখক অভিজিত রায় খুন হন বইমেলায়, তার স্ত্রী বন্যাও আহত হন ভীষণভাবে।
যে জাতিতে চিন্তা যত মুক্ত, চিন্তার ভিন্নতা যত বেশি সেই জাতি তত উন্নত ও বিকশিত। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে সেটিই দেখতে পাই। জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, সাহিত্যে তারা অনেক এগিয়ে। তাদের চিন্তা কোনোভাবেই বাধাগ্রস্থ নয়। বাধাহীন চিন্তা থেকে উন্মোচিত হচ্ছে নব নব সভ্যতার দুয়ার। তারা হচ্ছে অধিকতর বিকশিত মানুষ।
তবে আমরা বাংলাদেশের মানুষ আজীবন প্রতিকূলতার স্রোত ঠেলেই এগিয়ে যাওয়ায় অভিজ্ঞ। কোনো বাধাই শেষ পর্যন্ত আমাদের সামনে টিকতে পারেনি। আমরাই বিজয়ী হয়েছি। সংগ্রামের উত্তপ্ত রক্ত আমাদের শিরায় প্রবাহিত। আমরা হারতে জানি না। আমাদের প্রাণের একুশে বইমেলা আরো প্রাণবন্ত হবে, আরো চিন্তার বহুমুখিতার সুযোগ করে দেবে আমরা এই আশাই বুকে ধারণ করি। রাষ্ট্র পরিচালকগণ জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে মূল্য দিয়ে কাজ করবেন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এটিই আমার চাওয়া।
আজকালের খবর/আরইউ