
মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। সে নিঃসঙ্গ একাকী থাকতে পারে না। এভাবেই সমাজ গঠিত হয়। এরিস্টটল যেমন বলেন, ‘মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব। যে ব্যক্তি সমাজের বাস করে না, তিনি হয় দেবতা নয়তো পশু।’
মানুষের জন্য উন্নত জীবন ব্যবস্থাই সমাজের মূলভিত্তি। সেই ভিতকে আবর্তিত করে সমাজ এগিয়ে চলে। কেননা সমাজ এমনই বিমূর্ত অবয়ব-কাঠামো যা প্রতিনিয়ত নবায়ন হয়ে চলে। সমাজ পরিবর্তনশীল।
উন্নত ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন নিশ্চিতের জন্য সমাজে কিছু ধ্যান-ধারণা রীতিনীতি চলমান থাকে। এগুলো সাধারণ অর্থে মূল্যবোধ। ব্যাপকতর অর্থে সামাজিক মূল্যবোধ হলো সেই সকল রীতিনীতি যা ব্যক্তি সমাজ থেকে পেয়ে থাকে এবং সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে আশা করে। উন্নত জীবন ব্যবস্থার জন্য মানুষ দলবদ্ধভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠাকল্পে যে সকল রীতিনীতি, নিয়মকানুন, বিধিনিষেধ অনুসরণ করে থাকে তাই মূল্যবোধ। একটি সুনির্দিষ্ট ন্যায়-সম্পর্কিত নীতি বলেই নৈতিক মূল্যবোধ যুগে যুগে সমাজে সমাজে অনুসরিত হয়ে আসছে। দেশ-কাল-সমাজ ভেদে নৈতিক মূল্যবোধের স্বরূপ, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট পৃথক হওয়া বিচিত্র্য নয়। কোথাও অনুসরণীয় কোথাও বর্জনীয়। বস্তুত নৈতিক মূল্যবোধের প্রকৃতি একেককালে একেকরকম। সমাজ কোন চালিকাশক্তির নিয়মরীতিতে চলছে এবং সেই সমাজে ‘ন্যায়’ বলতে কী বোঝায় তার উপর মূল্যবোধের স্বরূপ ও চরিত্র নির্ভর করে। অন্যদিকে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের যে সম্পর্ক ও মূল্যবোধের গুরুত্ব সেটি নির্ভর করে বা বিভিন্নতা পায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার স্বরূপ ও প্রকৃতির ওপর। রাজতান্ত্রিক সমাজে রাজা ঈশ্বরের প্রতিভূ। তার শক্তি অসীম। ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য নয়...উদ্দেশ্য রাজ্য শাসন। অপরদিকে যদি ব্যক্তি বা জনগণ প্রধান উদ্দেশ্য হয়, তবে সেই শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তি ও তার স্বাধীনতা, অধিকার এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রকৃতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। মূলত রাষ্ট্রীয় চালিকাশক্তির যে-সকল নিয়মনীতি বা আইনকানুন, সে-সব গ্রহণ করা হয় নৈতিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে; বলা যায় যে, আইনকানুন ও সংবিধান প্রণয়নে মূল্যবোধের বিষয়গুলো সর্বাধিক অগ্রগণ্য।
অতীতে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতনতা, জ্ঞান, শিক্ষা তেমন ছিল না বলেই শাসক এবং শাসকগোষ্ঠী একচ্ছত্র ক্ষমতার সুযোগ পেয়েছে বা নিয়েছে। শাসন প্রক্রিয়ার যূপকাষ্ঠে ব্যক্তির বিসর্জনও কম হয়নি। সমাজে প্রতিবাদের ঝড়-কৌশল কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। একইসঙ্গে এ কথা অনস্বীকার্য যে, যুগে যুগে নির্যাতিত অত্যাচারিত মুক্তিপাগল মানুষ নিজের ও গণমানুষের জন্য আন্দোলনও করেছে। নিজের জন্য সৃষ্টি করেছে মুক্ত পরিবেশ, কিন্তু সে-সবের স্থায়িত্ব তেমন থাকেনি। কোথাও কোথাও মানুষ সকল অত্যাচার ঈশ্বর কর্তৃক নিয়তির লিখন বা ভাগ্যলিপি বলে মেনে নিয়েছে। তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ হয়নি। এ ছাড়া বর্ণ-জাতপাত হাজারও বিভেদের চক্রে মানুষের জীবন ছিল নরকতুল্য। আজ আমরা উপরোক্ত বিভেদ আর শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে সমাজে মূলত দুটি শ্রেণি দেখতে পাই। এক. শাসক এবং দুই. শাসিত। শোষণ-অত্যাচার-নিপীড়নের বিচারে শাসকের হাতে এসেছে বিবিধ কৌশল আর অস্ত্রশস্ত্র, অন্যদিকে শাসিতের অত্যাচার নিপীড়নের রূপ-মাত্রা এবং প্রক্রিয়াও বদলে গিয়ে আরো ভয়ংকর ও নির্মম হয়েছে। প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রে প্লেটো ও অ্যারিস্টোটলের উপস্থিতিতেও সমাজে ছিল দাসপ্রথা। ব্যক্তি অধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতার স্বরূপ আর সংজ্ঞা ছিল অন্যরকম বা আজকের বিচারে অস্বাভাবিক। তাই অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে বলে গেছেন ‘মূর্খের শাসন’ আর প্রশস্তি গেয়েছেন রাজা বা একজনের শাসনকে, যিনি অবশ্যই সৎ। বস্তুত মানব সভ্যতা যতই অগ্রগামি সময় পেরিয়ে এসেছে, তার জানার পরিধি, জ্ঞান ও চিন্তার যৌক্তিকতা সর্বোপরি দর্শন বদলে গেছে। তাকে আরো যুক্তিবাদী ও ঋদ্ধ করেছে।
‘মূর্খের শাসন’ উক্তির মধ্য দিয়ে সহজেই বোঝা যায় যে, সে-সময় জনসাধারণ পর্যাপ্ত শিক্ষিত ছিল না বা অশিক্ষিত, অসচেতন, অসহিষ্ণু, বিশৃঙ্খল, তর্কবাজ বা উগ্র ইত্যাদি, যা তাকে নিজেকে, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে, আমরা আজ যাকে বলি পলিটিক্যাল কালচার, সেটি ছিল না। সক্রেটিস বলেছেন, সত্য হলো জ্ঞান অথবা জ্ঞানই সত্য। যে সত্য মহৎ কোনো বিশ্বাস এবং নৈতিকতাকে আবর্তিত করে সমাজজীবনকে সুন্দর ও সাবলীল করে তোলে। এই নৈতিক জ্ঞান ও তার চর্চা হলো শক্তি, যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশেষায়িত সৃষ্টি ও মহান করতে প্রয়াস পায়। এই উপলব্ধি না থাকলে মানুষ কখনো মানব হয়ে উঠতে পারে না। নিজের ভেতরের শক্তি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার বুঝতে এই উপলব্ধির প্রয়োজন। এই জ্ঞান ব্যতিরীকে তার কাছে স্বাধীনতা ও মানবাধিকার অর্থহীন। সক্রেটিস তাই মানব সভ্যতার উন্নয়নে মানবাধিকার সম্প্রসারণের প্রয়োজনে উক্ত করেছেন অমোঘ ঘোষণা- ‘নিজেকে জানো’ অর্থাৎ সত্য বা জ্ঞান অনুসন্ধান করো।
জ্ঞানের সঙ্গে নৈতিকতা আর গুণ সংযুক্ত হয় তখনই প্রকৃত শিক্ষার উন্মেষ ঘটে। শিক্ষা মানুষের মধ্যে মানবিকতা এবং ন্যায়বোধ জাগ্রত করারও অবিকল্প শক্তি। আজকের সময় মানবিকতা ও ন্যায় বলতে যা বোঝা যায়, অতীতে এমনভাবে বিশ্লেষিত হয়নি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে মানবিকতা ও ন্যায় তৎকালিন সময়ে প্রচলিত রীতিনীতি ও নৈতিকতার পথ অনুসরণ করে চলমান ছিল। আজও যখন সৌদি আরবে একই দিনে প্রায় শতখানেক মানুষের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়, ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য রাষ্ট্র, অনেক মানবাধিকার সংস্থা মৃত্যুদণ্ড রহিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে ন্যায়-ন্যায়বোধ এবং স্বাধীনতা একেককালে একেক সমাজে পৃথক অর্থ ও ব্যাপ্তি বহন করে থাকে। তাই জ্যাঁ জ্যাক রুশো বলেন, ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।’ এখানে এসে স্বাধীনতা ও ন্যায়বোধ অনুসন্ধান করে দেখে, আইনের শাসন কী? বস্তুত আইনের শাসন হলো কারও প্রতি কোনোরূপ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা-পক্ষপাতিত্ব ছাড়া সকলের জন্য সমানভাবে আইনের চর্চা বা অনুসরণ। সমাজে বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবেচনায় আইন তার জন্য বিশেষ সুযোগ করে দেবে একে আইনের শাসন বা প্রকৃত ন্যায়বোধ বলে না। আজকের সমাজে সঠিকভাবে ন্যায়বোধ-ন্যায়বিচার-আইনের সত্যাসত্য চর্চা ও অনুসরণ আসলে মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। মানবাধিকার বলতে সমাজে বসবাসরত প্রত্যেক সদস্য যখন খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা-নিরাপত্তা-স্বাধীনতা-অধিকার পূর্ণাঙ্গভাবে চর্চা ও অনুসরণ করতে পারে তাকেই বোঝায়; অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল সদস্য একইরূপ অধিকার ভোগ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর দেশে দেশে এমন পরিস্থিতি নেই, তবে যতটুকু প্রাপ্যতার সুযোগ বা অধিকার আছে, আর যা লঙ্ঘিত হয় না; সেটিই একঅর্থে মানুষের মানবাধিকার। এটি অর্জনের জন্য মানুষের দরকার সচেতনতা-নীতি-শিক্ষা এবং সত্য জ্ঞান। শিক্ষা যে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো উৎস থেকে গ্রহণ করতে হবে এমন কথা নেই। আমরা যদি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক শিক্ষাকেই জ্ঞানের মানদণ্ড বিবেচনায় রাখি, নিশ্চিতভাবে সেটি হবে স্থুল এবং ত্রুটিযুক্ত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম আর স্মৃতিনির্ভর পরীক্ষা ব্যতিরীকে অন্যকিছু নয়, তবে সেটি মানুষের মনে জ্ঞানের জিগীষা বৃদ্ধি করে দেয়। অতীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল অর্থশালী আর সমাজের অভিজাত শ্রেণির কুক্ষিগত। সাধারণ মানুষের সুযোগ বা অধিকার ছিল না, বর্ণ-জাতপাত ছাড়াও আর্থিক সঙ্গতি বড় প্রতিকূলে, তাই তারা ধরেই নিয়েছিল যে, অত শিক্ষিত বা জ্ঞানী হয়ে হবে কী? বর্তমান সময়ে দেশে দেশে কর্মমুখী বা পেশামুখী শিক্ষাক্রম চলমান। একাডেমিক ডিগ্রি হাসিলের পর কোনো কর্মসংস্থান। শিক্ষা বা জ্ঞানের জন্য অবারিত আছে পৃথিবীর পাঠশালা। সকলের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে পাঠাগার বা গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি। অতীতের সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা, সুযোগ আর অধিকার না থাকলেও মানুষ নিজেকে এবং তার জ্ঞানকে বিকশিত করতে পৃথিবীর পাঠশালা পর্যবেক্ষণ থেকে শিক্ষা, গুরুগৃহ ও গ্রন্থাগারের নিরিবিলিতে বসে পাঠ এবং চর্চায় নিমগ্ন থেকে ছিল। তাই মানব সভ্যতা এগিয়ে গেছে নিত্যনতুন প্রেক্ষিত উপলব্ধি, দর্শন আবিষ্কার আর গবেষণায়। মানুষ খুঁজে পেয়েছে ‘নিজেকে জানো’-র মতো সরল অথচ গভীর বাক্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। বস্তুত নৈতিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিচেতনা বা স্বাধীনতা সর্বোপরি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অনেক বিস্তৃত ও প্রভাববিস্তারি।
এখন আমরা দেখি গ্রন্থাগার বলতে কী বোঝায়? গ্রন্থাগার-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Library, যা ল্যাটিন বা গ্রিক শব্দ Libre থেকে এসেছে। Libre অর্থ বই এবং এই শব্দ থেকে এসেছে Librarium, যার অর্থ বই রাখার স্থান। Librarium থেকে উদ্ভব হয়েছে ফরাসি শব্দ Librairie, পরবর্তীতে অ্যাংলো ফ্রেঞ্চ এই শব্দটি থেকে ইংরেজি প্রতিশব্দ আসে Library; সার্বিকভাবে যা বলা হয় যে, বই বা গ্রন্থের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহশালা। আমরা দু-একটি সংজ্ঞার উল্লেখ করতে পারি- J. H. Shera বলেছেন, The library is an organization, a system designed to preserve and facilitate the use of graphic records. ইউনেসকো একটি সংজ্ঞা দিয়েছে এ রকম যে, ‘লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলতে বোঝায়, মুদ্রিত বই সাময়িকী অথবা অন্য যে কোনো চিত্রসমৃদ্ধ বা শ্রবণ-দর্শন সামগ্রীর একটি সু-সংগঠিত সংগ্রহ।’
গণগ্রন্থাগারকে বলা হয় জনসাধারণের বিশ্ববিদ্যালয়, কেননা জানা ও শেখার জন্য এখানে যত বই-সাময়িকী বা অন্যান্য মাধ্যম, সবগুলোই থাকে সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কোনো ব্যক্তি নিজ রুচি-পছন্দ-চাহিদা অনুসারে শেখা বা জানার জন্য যে-কোনো মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন। সমাজে বসবাসকারী মানুষজনের মনমেজাজ-রুচি-পছন্দ একেকজনের একেকরকম, তাই পাবলিক পাঠাগার বা গণগ্রন্থাগারে সংগৃহিত থাকে বিবিধ বিষয়ের বই, যাতে ব্যক্তি তার পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী বই পড়তে পারেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভূবনে নিজের জন্য পৃথক আকাশ তৈরি করতে সক্ষম থাকেন। রবিঠাকুর গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত বইয়ের মধ্যে যেমন সমুদ্রের মতো জ্ঞানের বিশাল পরিধির ধারণ দেখেছেন, তেমন জ্ঞানপিপাসু পাঠক গণগ্রন্থাগারে খুঁজে পান জানা ও শেখার অবারিত ক্ষেত্র। গণগ্রন্থগারের মূল লক্ষ্য জনসাধারণ বা জাতিকে জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ করা। যে ঋদ্ধতায় আলোকিত হয়ে মানুষ নিজেকে জানতে পারবেন, সমাজের নৈতিকতা বুঝতে পারবেন এবং অনুসরণ করতে উদ্যোগী হবেন। শিক্ষিত বা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত জাতি নিজের অস্তিত্বের যেমন ভালো-মন্দ সহজে বুঝতে পারেন, তেমনভাবে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে অনুধাবন ও উপলব্ধি করে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে পারেন শান্তি-শৃঙ্খলা-উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যকরণের মধ্য দিয়ে। এছাড়া জনসাধারণ ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক বিভিন্ন পেশাজীবী নিজ নিজ বিষয় ও ক্ষেত্রের তথ্য ও তত্ত্ব আপডেট রাখার সুযোগ পান গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে। সুতরাং গণগ্রন্থাগারের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং প্রায়োগিক ব্যবহার বহুমুখী এবং প্রয়োজনীয়।
ব্যক্তির আত্মানুসন্ধান, উপলব্ধি, তার স্বাধীনতা, অধিকার, নৈতিকতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, সভ্যতার ইতিহাস ইত্যাদি জানার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি সরকার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রাপ্যতা, অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে যেমন সচেতন হয়ে থাকেন তেমনভাবে জনসাধারণের বিশাল অংশের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশের অন্যতম একটি উৎস গণগ্রন্থাগার। ব্যক্তি তার নিজের বা অন্যকোনো দেশ বা জাতির ইতিহাস-শিক্ষা-সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি-মতাদর্শ ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা, পর্যাপ্ত জ্ঞানচর্চা ও তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ পান। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যখন থেকে গণগ্রন্থাগারের সূচনা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রগুলো উৎকর্ষতার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। অনেক জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আরো ঋজু এবং দৃঢ় হওয়ার সুযোগ লাভ হয়েছে। মানুষ নিজ জীবনযাপনের মানোন্নয়নে সচেষ্ট থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে আইনের শাসন এবং অন্যায়-অনাচার-শোষণ-অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার শক্তি পেয়েছে। বিশ্বের রাজনৈতিক কাঠামো ও সরকার ব্যবস্থাপনা, বাজার ও অর্থব্যবস্থা, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোর পরিসর আরো উন্নত ও আধুনিক করার চেষ্টা করেছে। মূলত সবই হলো নিজেকে জানার ফলাফল এবং উন্নত জীবন নিশ্চিত করার অদম্য আগ্রহে। গণগ্রন্থাগারের সমৃদ্ধ সংগ্রহ এবং তার সুষ্ঠু ব্যবহার মানুষের জীবনকে ইতিবাচক পরিবর্তন ধারায় সংশ্লিষ্ট করে। চিন্তা-বুদ্ধি-কৌশল বিভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ নানান যুক্তিতর্কের অবতারনা এবং সে-সবের ক্রমঅগ্রসর গতি জাতিকে সঠিক পথনির্দেশ বা সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে গণগ্রন্থাগার। যে সকল মতবাদ ভ্রান্ত সেগুলো পরিহার, যা নেতিবাচক ফলাফল দিয়েছে গ্রন্থপাঠ অভিজ্ঞতা সেগুলো এড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করার কৌশলও শিখিয়ে থাকে। এ কথা তো সত্য জ্ঞানচর্চার পরিসীমা বা শেষ নেই। আজ নির্দ্বিধায় স্বীকার্য যে, মানব সভ্যতার ইতিহাস অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে সত্যিকারার্থে গণগ্রন্থগারের সঠিক চর্চারও ফলাফল। এও চরম সত্য যে, যুগে যুগে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে শত্রু রাষ্ট্র প্রতিপক্ষের সকল স্থাপনার আগে জ্ঞানপীঠস্থান গ্রন্থাগারগুলো ধ্বংস করেছে। গণগ্রন্থাগার হলো সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবেক বা অন্তর্দৃষ্টির প্রতিফলক। তাই প্রত্যেক সভ্যতায় মানুষের নৈতিকতা, জীবনযাপন, সমাজ ও অর্থনৈতিক কাঠামো, শাসনব্যবস্থা, মানবিক মূল্যবোধ সবকিছুর দৃষ্টান্ত সঠিকভাবে নির্দেশিত করে সেই সময়ের জ্ঞানচর্চার স্বরূপ অন্বেষার মধ্য দিয়েও। পৃথিবীর অন্যতম গণগ্রন্থাগার ৩৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে গ্রিক সভ্যতার সৌন্দর্য নগরী এথেন্সে স্থাপিত হয়েছিল, যেখান থেকে দর্শন ও রাস্ট্রচিন্তার ইতিহাস পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য পূর্ব-এশিয়ার অন্যতম রাজা অসুরবানিপাল ৬৬৮-৬২৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার জন্য সুপরিচিত হয়ে আছেন। অধিকন্তু ইতিহাসবেত্তাগণ বলে থাকেন যে, এসব গণগ্রন্থাগার সঠিক স্বরূপ বা চরিত্র পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করতে পারে নাই। এগুলো ছিল সমাজ ও রাস্ট্রব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সুবিধাভোগী মানুষের জন্য, গণমানুষের জন্য নয়।
গণগ্রন্থাগার মানুষকে আত্মসচেতন, উদার, পরমতসহিষ্ণু এবং সার্বিকভাবে ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল ও ন্যায়সঙ্গত জীবনব্যবস্থার পথনির্দেশ করে থাকে। মানুষকে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে, মানবতার বিকাশ ঘটাতে, নিবেদিতপ্রাণ থাকতে অনুপ্রাণিত করে সত্য জ্ঞানের চর্চা। জ্ঞানচর্চা নিজেকে চেনার, জানার এবং বোঝার পাঠাভ্যেস। মানুষ যখন নিজেকে বুঝতে পারে, তখন সমাজব্যবস্থায় শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ করতে নৈতিক মনোবল পেয়ে অগ্রণী হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গণতন্ত্র কী? রাষ্ট্রের যে শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ বাস্তবিক অর্থে থাকে তাকেই গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র বলা হয়। যেখানে মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে, সত্য ও ন্যায়নীতি, পরমতসহিষ্ণু নেতৃত্ব ও জনসাধারণ, পরস্পরের প্রতি মিথ্যা দোষারোপ বা কাদা ছোঁড়াছুড়ি নেই, সবকিছুই পরিচালিত হয় শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খল ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে কল্যাণের লক্ষ্যে। গণতন্ত্র একটি সরকার পদ্ধতি যা সমাজের অভ্যন্তরে জনগণের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুষ্ঠু চর্চার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়, এটি রেডিমেড কোনো শাসনব্যবস্থা নয়। এখানে ব্যক্তি হলো মূখ্য বা প্রধান, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যক্তির উন্নত নিরাপদ শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিতে কাজ করে যায়। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে পেতে হলে কিছু শর্ত অবশ্যই ইতিবাচক ফরমে থাকা প্রয়োজন। যেমন- একতা-শান্তি-শৃঙ্খলা-শিক্ষা, অর্থনৈতিক সমতা বা সাম্য এবং মানবাধিকার। জনসাধারণ নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক উন্নত সংস্কৃতি ধারণ করে, কিন্তু উপরোক্ত শর্তগুলোর কোনো না কোনোটির ঘাটতি আছে, সে-ক্ষেত্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সত্যি সত্যি খুব মুশকিল। পৃথিবীতে অনেকরকম সরকারব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে, এখনো রাস্ট্র ভেদে পৃথিবীর একেক ভূখণ্ডে একেকরকম সরকার পদ্ধতি। তারপরও গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা অধিকতর কাম্য ও অগ্রগণ্য। কেননা গণতন্ত্র হলো বিবর্তনবাদী দর্শন যেখানে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক ‘জনগণ স্বয়ং’ নির্ধারণ করে থাকে। দিগ্নির্দেশ করে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন কৌশল বা প্রক্রিয়াও। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিছু অনুষঙ্গের উপরও কার্যকর হয়ে থাকে। যেমন: জনগণকে বিচার-বুদ্ধি-যুক্তি-ন্যায় ও বিবেকসম্পন্ন হতে হবে, সমাজে প্রচলিত নৈতিকতা ও আইনের শাসনের প্রতি আনুগত্যশীল থাকতে হবে, সকলের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা বা সাম্য থাকা বাঞ্ছনীয়, বাকস্বাধীনতা, বুদ্ধিচর্চা, যৌক্তিক এবং পর্যাপ্ত শিক্ষা ও উন্নত মানবাধিকার অবস্থান থাকা দরকার, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন লক্ষ্যে একতাবদ্ধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা বা সম্মানবোধ এবং পরমতসহিষ্ণু হতে হবে ইত্যাদি। যেভাবেই উল্লেখ করা হোক না কেন, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় যে প্রাক-ধারণাগুলো রয়েছে, সমাজে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তিকে সে-সব সম্পর্কে সম্যক সচেতন-শিক্ষিত-দীক্ষিত থাকা দরকার যাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে। অশিক্ষিত অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্যের সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ শুধু লিফলেট-পোস্টার আর ফেস্টুনে শোভা পেয়ে থাকে, বাস্তবে সমাজের উঁচুতলার মানুষ যারা শক্তিধর ও ক্ষমতাবান তারাই শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার সুযোগ পায়, যাকে এলিটতন্ত্র বলা হয়।
জনগণের মধ্যে বোধের এই জায়গাটি সুন্দর সাবলীল ও স্বচ্ছ করে দিতে পারে জ্ঞানের চর্চা, যার কেন্দ্রভূমি গণগ্রন্থাগার, যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-যুক্তি-দর্শনের বিশাল সংগ্রহ, যা ব্যক্তির একার পক্ষে সংগ্রহ করা কঠিন ও দুরূহ কাজও বটে। গণগ্রন্থাগার হলো জনসাধারণের জন্য অবারিত বিশ্ববিদ্যালয়, এখানে আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে মনস্থির একাগ্র মনন ও সাধনা প্রয়োজন। গণগ্রন্থগারের সর্বজনীন পরিবেশে যে-কোনো ব্যক্তি নিজেকে ঋদ্ধ করতে পারলেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উন্নত হবে এবং সমাজ ও রাস্ট্রে অগ্রগামি হবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকার। সুতরাং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকাশে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকা দ্ব্যর্থহীনভাবে সত্য ও শাশ্বত।
লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক।
আজকালের খবর/আরইউ