বুধবার ৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বিজয়ের আগে বয়েছিল অশ্রুধারা
অলোক আচার্য
প্রকাশ: বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৭:১৪ PM
বুদ্ধিজীবীরা একটি দেশের প্রাণ। তাদের মাধ্যমেই দেশ সঠিক পথে অগ্রসর হয়। এটা সব জাতির জন্যই প্রযোজ্য। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বিজয়ের ঠিক দুই দিন আগে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজয়ের নিশ্চিত শঙ্কায় কাঁপছিল আর বাঙালিরা বিজয়ের অপেক্ষায় ছিল। এর মধ্যেই এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড দেশবাসীকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির চুড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগে পাকিস্থান সেনাবাহিনী বুদ্ধিজীবি হত্যার মতো নতুন ঘৃণ্য একটি ষড়যন্ত্র করে। মূলত যখন তারা দেখলো সার্বিক পরিস্থিতি তাদের প্রতিকুলে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনোভাবেই রোধ করা যাবে না, পাকিস্থানের তৎকালীন মিত্র রাষ্ট্রগুলোও যখন পাকিস্থানকে আর সাহায্য করতে পারছিল না তখনই তারা ঘৃণ্য এক ষড়যন্ত্র করে। তারা দেশের খ্যাতনামা মানুষদের তালিকা তৈরি করে হত্যা করতে আরম্ভ করে। এর প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল স্বাধীন দেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে এইসব বুদ্ধিজীবিদের পরামর্শ এবং দিক নির্দেশনা একান্তভাবে প্রয়োজন হয়। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের শুরুতে যখন ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনীও পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে; মূলত তখন থেকেই পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করে। ৪ ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় নতুন করে আবার কারফিউ জারি করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১০ ডিসেম্বর থেকেই একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যার প্রস্তুতি নিতে থাকে এরা। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনার মূল অংশটি বাস্তবায়ন করা হয়। শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-শিল্পী, চিকিৎসক-আইনজীবী ও প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বরেই প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় চোখে কাপড় বেঁধে। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া ও রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক জায়গার নির্যাতনকেন্দ্রে নিয়ে তাদের ওপর বীভৎস নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। পরে মিরপুর ও রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে লাশ ফেলে দেয়। তাই আমাদের অগ্রগতিটা যেন শ্লথ হয় সে ব্যবস্থা তারা করতে চেয়েছিল। তারা নির্মমভাবে বেছে বেছে মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যা করে। এই তালিকা তৈরিতেও পাকিস্থান বাহিনীকে সাহায্য করেছিল এদেশের রাজাকাররা।

মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সারের মতো মেধাবী মানুষদের ওরা হত্যা করে। তারপর তাদের রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। এই তালিকায় নক্ষত্রপ্রতীম সব মানুষ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক ডক্টর মুনীর চৌধুরী, ডাক্তার মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, ডাক্তার আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, আনম গোলাম মোস্তফা, সেলিনা পারভীন, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. জিসি দেব, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল খায়েরসহ আরো অনেকে। এদের মতো একেকজন মানুষ পেতে বাঙালিকে আরো হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রায় অর্ধ শতক পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির অংশ হিসেবে সরকার ২০২০ সালে প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জনের একটি তালিকা করে। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট এক হাজার ৭০ জন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট-আত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। বুদ্ধিজীবীদের নিথর দেহজুড়েই ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্তও করতে পারেননি।

যদি এই মেধাবী মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো তাহলে দেশের অগ্রগতি আরো ত্বরান্বিত হতো। কারণ এই বুদ্ধিজীবিরা তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে ছিলেন একজন নক্ষত্র। তারা নতুন স্বাধীন দেশে যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে দেশটা আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেত। এর ফলে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। কয়েকদিন আগে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের জননী তারামন বিবি মারা গেছেন। তার আগে বিদায় নিয়েছেন একাত্তরের জননী খ্যাত রমা চৌধুরী। একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাঙালির চোখে এঁকে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব করে। ভয়াবহতার হিসাব করে না। নৃশংস ও নির্মমতার দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো গণহত্যার চেয়ে ভয়ংকর ছিল পাকিস্থানীদের গণহত্যা। নির্মম বা নৃশংস কোনো শব্দই এই নির্মমতা প্রকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। যেখানে এক রাতেই রক্তের নদী বানিয়ে ফেলেছিল ঢাকা শহরে। একদিন পৃথিবীতে আমাদের সেই বীর মানুষ থাকবেন না। সময়ের সাথে সাথে আমরা তাদের হারিয়ে ফেলবো। কিন্তু তাদের স্বপ্ন, তাদের দেখানো পথ আমাদের সামনে থাকবে। আমাদের মাঝেই তারা বেঁচে থাকবেন। স্বাধীনতা একটি স্পর্শমণি যা প্রত্যেকেই চায়। আমরাও চেয়েছিলাম। অনেক ত্যাগ, অনেক শ্রম আর বুকের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

‘বাংলাদেশে গণহত্যা’ বইতে সিডনির শৈল চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস তার মতামতে বলেছেন, ধর্ষিতা মহিলাদের সংখ্যা সরকারি কর্মচারীদের হিসাবে আনুমানিক দুই লাখ হলেও তার মতে এ সংখ্যা অনেক কম করে অনুমান করা হয়েছে। তিনি মনে করেন এই সংখ্যা চার থেকে চার লাখ ত্রিশ হাজারের মতো হতে পারে। তিনি আরো বলেন, অন্তঃসত্তা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। এসব মহিলার অনেকেই যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন আবার অনেকেই বন্ধ্যাত্ব বরণ করেছেন। অনেক মহিলাকেই যুদ্ধের পর স্বামী ছেড়ে গেছে। অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করেছেন।   

সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নিতে আজকের প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে জন্ম গ্রহণ করাটা যে কতটা সৌভাগ্যের তা কেবল স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা একটি শিশুই বলতে পারবে। যার একটি সুন্দর শৈশব থাকবে, যে নির্ভয়ে খেলা করবে, লেখাপড়া শিখবে। কারণ পৃথিবীতে আজ যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে তাদের নির্মম পরিণতি চোখের সামনে দেখছি। আমরা ফিলিস্থিনের সংগ্রাম দেখছি। এমনকি একটু বেঁচে থাকার স্বাধীনতার জন্য মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগ্রামকে দেখছি। বহু জাতি বহু সংগ্রাম, যুদ্ধ, রক্ত, ইজ্জত, সম্পদ হারিয়েছে কেবল স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার জন্য। আমরাও করেছি। দীর্ঘ নয় মাস করেছি। রক্ত দিয়েছি, সম্পদ দিয়েছি, ইজ্জত দিয়েছি। সব দিয়েছি শুধুমাত্র দেশ স্বাধীন করার জন্য। দেশ স্বাধীন মানে আমাদের নিজস্বতা অর্জন করা। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করে। ছোটবেলায় ব্যাকরণ বইয়ের ভাব সম্প্রসারণে পড়েছি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু তখন এর অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। কথাটির গভীরতা এখন বুঝতে পারি। স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা ধরে রাখা এবং মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের দেশে পরিণত করাই চ্যালেঞ্জের বিষয়। কতটা চ্যালেঞ্জের তা আমরা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বুঝতে পারি। কারণ প্রতি পদক্ষেপে বাধা আসবে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশটাকে সাময়িকভাবে অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করতে পারলেও বাস্তবিক পক্ষে আমরা আজ বহুদূর এগিয়েছি। কাউকে যে জোর করে দাবিয়ে রাখা যায় না তা আজ প্রমাণিত। পাকিস্থান নিজেরাই তাই আজ বাংলাদেশের উন্নতি দেখে অবাক। অবাক সারা বিশ^। সেই হারানো মানুষগুলো নেই ঠিক কিন্তু তাদের দেখানো তাদের স্বপ্ন দেখা পথ তো আছে। সে নিয়েই আমরা দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে যাবো।

অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

আজকালের খবর/আরইউ