প্রকাশ: রবিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২৩, ৬:৫৭ PM

মু. মাজাহারুল ইসলামের জন্ম ১৯২৬ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার ইসলামনগর গ্রামে। তার পিতার নাম মু. কলিমুদ্দিন, মাতার নাম সখিনা খাতুন। ১৯৭১ সালের ২০ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইসলামনগর গ্রামে আক্রমণ করে। ইসলাম নগরে ঢুকেই তারা শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। সেদিন তারা একটি ফাঁকা মাঠে ইসলাম নগরের প্রায় সব পুরুষদের জড়ো করেছিল। মাজাহারুল ইসলামও সেখানে উপস্থিত হন। সেখানে কায়সার বিহারি একটা ছোট কাপড়ের পুটলি মেজরের হাতে দিয়ে উর্দুতে বলে এখানে ব্যাংক ডাকাতির টাকা রয়েছে। মেজর যখন পুটলিটা খোলে তখন সেখানে একটি রুমাল দেখা যায়। যেটিতে পাঁচ-সাত দিন আগে শহীদ মাজহারুলের পুত্র আবু সাঈদ কিছু টাকা বেঁধে বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। সে মেজরকে বলে এগুলো আমার টাকা। কিন্তু মেজর বাংলা ভাষা বুঝে না।
ইয়াকুব হোসেনের পিতার নাম ছিল মশিতুল্লাহ সরকার। ইয়াকুব হোসেনের পৈতৃক নিবাস ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের ইসলাম নগর পাড়ায়। দুই ভাইয়ের মধ্যে ইয়াকুব হোসেন ছিলেন ছোট। তিনি ১৯৪৮ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। কিন্তু তিনি বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মাহাবুবা খাতুনের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শহীদ হওয়ার সময় তার তিন ছেলে ছয় মেয়ে ছিল।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের ইসলামনগর এলাকাটি। ফলে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় রাজাকার, বিহারী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নজর ছিল ইসলামনগরে অবস্থিত খানকা শরীফের ওপর। ১৯৭১ সালে ২০ মে, বুধবারের রাত। ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্প থেকে আসা পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর একদল সৈন্য সেই রাতে ঘেরাও করেছিল খানকা শরীফের ইসলাম নগর মহল্লাটি। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে পরিচিত ইসলাম নগর। ঠাকুরগাঁও স্টেশন রোডে অবস্থিত ইসলাম নগরের খানকা শরীফকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভীষণ ভয় পেতো। ফলে তারা কখনোই খানকা শরীফের ওপর সরাসরি আক্রমণ চালায়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে প্রথম থেকেই স্থানীয় রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের নজর ছিল ইসলাম নগরে অবস্থিত খানকা শরীফের ওপর। পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ড খানকা শরীফ নামে পরিচিত। এখানে প্রায় সাত হাজার লোকের বসবাস ছিল। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই গ্রামে আসেন। বৈশাখ মাসের কোনো এক বুধবার পাক সৈন্যরা আক্রমণ চালায় ইসলাম নগরে। ইসলামনগরে ঢুকেই তারা শুরু করে তাদের নারকীয় অত্যাচার। তারা গ্রামের অনেক পুরুষদের একটি ফাঁকা মাঠে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে সবাইকে শুয়ে পড়তে বলে এবং গুলি করার জন্য তৈরি হয়। ভাগ্যক্রমে সেখানে একজন মেজর উপস্থিত হয় এবং গুলি করতে নিষেধ করে। এরপর কী মনে করে যেন সবাইকে ছেড়ে দেয়। তবে ছেড়ে দেওয়ার আগে সবার নাম ঠিকানা লিখে নেয়। তবে সেখান থেকে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে দুইজন ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়। তারা হলেন কোম্পানি সাহেব ও সিরাজুল ইসলাম।
এই দলের নেতৃত্বদানকারী সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফজাল ও ক্যাপ্টেন হারুন অর রশিদ জানতে চায় গত নির্বাচনে তারা কোন দলকে ভোট দিয়েছেন। উত্তরে প্রাণের মায়ায় দুই-এক জন মিথ্যার আশ্রয় নিলেও অধিকাংশই নির্ভয়ে বললেন, তারা আওয়ামী লীগকে অর্থাৎ নৌকায় ভোট দিয়েছেন। কেন তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছেন, এই প্রশ্নের উত্তরে মহল্লার আলোকিত মানুষ ডা. মোস্তফা আহম্মেদ তার সত্য কারণ ব্যাখ্যা করেন। এরপর সেনা অফিসার একটা তালিকা বের করে কতগুলো নাম পড়ে শোনালো। এদেরকে আগামীকাল সকাল ১০ টার মধ্যে ক্যাম্পে হাজিরা দিতে হবে, নইলে এই মহল্লার সবাইকে মেরে ফেলা হবে বলে শাসিয়ে দিল। গ্রামের সব মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে এগিয়ে আসল আট জন পুরুষ। সকলের ধারণা ছিল প্রথমে যে দুইজন ব্যক্তিকে ধরে ছিল তাদের মত এদেরকেও ফেরত আসতে দিবে।
সেদিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের ৫ তারিখ। ওইদিন সকালে আটজন নিবেদিত প্রাণ মানুষ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পড়ে তৈরী হয়ে আসল সবার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে। সেদিন তাদের বিদায় জানাতে জড়ো হয়ে ছিল শত শত মানুষ। একটা গরুর গাড়ি করে তারা রওনা দিল। পাকিস্তানির বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছালে তাদেরকে রেখে দিয়ে পাকিস্তানিরা গাড়িচালককে দিয়ে খালি গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দেয়। খালি গাড়ি পেয়ে সবার হৃদয় অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। তবু আপন জনের ফেরার অপেক্ষায় তারা আশায় বুক বেঁধে প্রহর গুনতে থাকে। তারপরে তাদের কী হয়েছিল কেউ জানতে পারেনি। স্বজনরা খোঁজ করে জানতে পারেনি তাদের অবস্থা। সাত দিন পর সবাই একটা আশার কথা শুনতে পেল। ওই এলাকার ছোট ছোট ছেলেরা সাতদিন পর একদিন বেলা ১১-১২ টার সময় দেখতে পায়, একটা আর্মি ট্রাকে করে সেই আটজনকে গ্রামের দিকে নিয়ে আসছে। সবাই ভাবল এবার তারা সবাই গ্রামে ফিরে আসবে। কিন্তু তা হলো না। তাদের মধ্যে মো. হাকিম নামে একজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি সাতজকে নিয়ে ট্রাক আবার ফিরে যায় শহরের দিকে। তারপর ট্রাকটি কোথায় গেল তা আর কেউ বলতে পারে না। বাকি সাতজনকেও হয়তো সেদিন ফেরত দেওয়ার জন্যই এসেছিল। কিন্তু স্থানীয় কারো কারো ইশারায় তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছিল। বাকি সাতজনকে নিয়ে বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমির পাশে আরো আট জনের সঙ্গে তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এই আট জনের পরিচয় জানা যায়নি। এই আট জনকে বালিয়াডাঙ্গী থেকে ধরে আনা হয়েছিল। লাশ মাটি চাপা দিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দুই জনকে। এদের মধ্যে একজন ছিল ঠাকুরগাঁও রোডের জুতা সেলাইকারী কারিগর রামচরণ ও অন্যজন আব্দুল হাকিম। ট্রাকের চালক সি অ্যান্ড বি, আজিমউদ্দিনকেও লাশ মাটি চাপা দিতে বাধ্য করা হয়। রামচরণ ও ট্রাক চালক দেশ স্বাধীনের পরে তাদের আত্মীয়-স্বজন এলাকাবাসীকে এই ঘটনা জানান।
ফারজানা হক স্বর্ণা : প্রভাষক, রত্নাই বগুলাবাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও।
আজকালের খবর/আরইউ