
সহধর্মিনী ও বড় কন্যাকে নিয়ে দশ দিন আমেরিকা থাকার পরিকল্পনা নিয়ে ২ মার্চ ২০০১ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করি। বিমানটি মাটি ছেড়ে আমেরিকার উদ্দেশে উড়াল দেওয়ার পরই বুকের মধ্যে কেমন যেন ছ্যাৎ করে ওঠল। মনে হলো- বাংলার মাটি থেকে আমার শিকড় আলগা হয়ে গেছে। সোনার হরিণ ধরতে নাকি সোনালি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে দেশ ত্যাগ করলাম, নাকি অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়ালাম সে সংশয় আমাকে তাড়া করছিল। ইচ্ছা ছিল দশ দিন আমেরিকার তামাশা দেখে দেশে ফিরে যাবো।
ঢাকায় আমি ঢাকা সিটি করপোরেশনে করনিকের চাকরি এবং আমার সহধর্মিনী বারডেম হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ছিলেন। আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব স্বচ্ছল না থাকলেও অস্বচ্ছল ছিল না। তখনকার শান্তিময় জীবনের কথাগুলো মনে পড়লে আজ ২৩ বছর পরেও আমি অশ্রুসিক্ত হই। নিজেকে ধিক্কার দেই, আমি একজন শান্তি হত্যাকারী, আমার বিচার হওয়া দরকার। সবকিছু ঠিকই ছিল কিন্তু তথাকথিত আত্মীয়ের বিবেক বর্জিত লোভের কাছে আমার পরিবারটি একটি ঝরা পাতায় রূপ নেয়।
বলেছিলাম যে আমেরিকায় তামাশা দেখতে এসেছি। এক সময় নিজেই তামাশায় পরিণত হয়েছি। মানুষের স্বরূপ দেখার জন্য নিজেকে এতটা ঝরা পাতা হতে হয় তা আমেরিকা না এলে হয়তো জানাই হতো না। আমেরিকা সম্পর্কে আমার উচ্চ ধারণা ছিল। আসলে আমার ধারণার চেয়েও অনেক বেশি উচ্চতায় আমেরিকার অবস্থান। সমস্যা শুধু তৃতীয় বিশ^ থেকে ছুটে আসা কিছু মানুষরূপী কীট যারা এই সভ্য দেশের সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। আমেরিকার উদারতা এদেরকে খাদের কিনারে নিয়ে যায়। আসলে এ সব কথা বলার জন্যে আমার এই নিবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য নয়। যে ঘটনাটির কথা আমি বলব, সে ঘটনার সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত হলাম সেটি বলার জন্যই একটু পিছনের ঘটনা বলা।
প্রথমে একটি গ্যাস স্টেশনে রাতের শিফটে কাজ পাই। ডাঙায় বাঘ জলে কুমির- এই অবস্থা। তখন আমি আর আমি থাকি না। আমি হয়ে যাই নীল চাষী। প্রতিদিন কিছু সংখ্যক মানুষের নিত্য নতুন মানুষ ঠকানোর কৌশল দেখে আমি শিহরিত হয়ে যাই। সময় আমার অনুকূলে ছিল না বলে আমাকে সয়ে যেতে হয়। সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা যখন হারিয়ে ফেলি তখন বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরিটি ছেড়ে দিতে হয়। তখন আমার সহধর্মিনী নার্সিং কোর্স করছেন। সে সময় আমার কাছে মাত্র এক হাজার ২০০ ডলার ক্যাশ ছিল।
চাকরি হারানোর পর চোখে সরিষার ফুল দেখতে পাই। এদিক-সেদিক চাকরি খোঁজার চেষ্টা করি। সুবিধা করতে পারিনি। জনৈকা মহিলা একজন ভদ্রলোকের নাম বললেন। তার দেখা পাওয়ার জন্য তাদেরই রেস্টুরেন্টে সন্ধ্যার পর তার আসার সম্ভাব্য সময়ে অপেক্ষা করি। দুএকদিন পরেই ভদ্রলোকের দেখা পাই। আমার কথা তিনি মনযোগ দিয়ে শোনেন এবং আমার জন্য কাজের চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন।
ভাগ্য আমার অনুকূলে ছিল এবং ভদ্রলোক আমার প্রতি দয়াশীল ছিলেন একথা স্বীকার না করে পারছি না। যেহেতু আমি এখনো আসল ঘটনার কাছে আসতে পারছি না, তাই সঙ্গত কারণেই তাদের নাম বলছি না। পরের দিন বিকাল তিনটায় কারো কাছ থেকে আমার টেলিফোন নম্বর যোগাড় করে একটি ঠিকানা বললেন এবং কীভাবে বাসে গিয়ে কোথায় নামলে তার দেখা পাবো বলে দিলেন। আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তার কাছে উপস্থিত হই। অফিসে উপস্থিত হওয়ার পর আমাকে কিছু ফরম পূরণ করতে দেওয়া হয় এবং ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য একজন অফিসারের রুমে ডাকা হয়। মিনিট দশেক পরেই তিনি আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন। মানে আমার চাকরি হয়ে গেছে। এটি ছিল আমার কাছে একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা।
একজন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করলেন এবং কুশলাদি বিনিময় করলেন। প্রথম ভদ্রলোক তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি একজন বাংলাদেশি এবং এই কোম্পানির কর্ণধার। এটি ছিল বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি পার্কিং কোম্পানি। পুনরায় কুশলাদি বিনিময় করে আমি বাসায় চলে আসি। বাসায় আসার আগেই প্রথম ভদ্রলোক আমার বাসায় ফোন করে বলে দেন যে আগামী দিন আমাকে কাজে যোগদান করতে হবে।
এ আনন্দ কোথায় রাখব এবং কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারি না। সকালে ভদ্রলোক আমাকে তাদের রেস্টুরেন্টের সামনে অপেক্ষা করতে বলেন এবং নির্ধারিত সময়ে তার গাড়িতে করে আমাকে অফিসে নিয়ে যান। অফিসে আরো কিছু কাগজপত্র সাইন করার পর তিনি তার গাড়িতে করে কর্মস্থলে পৌঁছে দেন। একদিনের ব্যবধানে আমার ও পরিবারের দৃশ্যপট বদলে যায়। আমার চাহিদা মোতাবেক সব তৈরি করে কেউ যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি সোনার হরিণ দেখিনি, তবে সোনার মানুষ দেখেছি।
এক জায়গাতে একইভাবে টানা সাত বছর কাজ করার পর সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কোম্পানি আমাকে পাশেই আর এক লোকেশনে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। সেখানে টানা চার বছর কাজ করার পর একদিন এক দোকান মালিকের সঙ্গে আমার সামান্য সংঘাত হয়। আমার সুপারভাইজার গাড়িটি টো কোম্পানিকে ফোন করে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে যা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনী এবং আমার ক্ষমতার বাইরে। সারাদিন সুপারভাইজার রং তামাশা করে সন্ধ্যার সময় এসে সেই দোকান মালিকের সঙ্গে আঁতাত করে আমার বিরুদ্ধে জঘন্য এক মিথ্যা কাহিনী তৈরি করে আমার মালিককে বিভ্রান্ত করে এবং আমাকে প্রায় চাকরিচ্যুত করে ফেলে। বিশে^র পরাশক্তির দেশ আমেরিকার নির্লজ্জ মিথ্যাচার এমন সাদরে গৃহীত হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো জানার কথা নয়। এই ঘটনা আমার পুরো পরিবারকে তছনছ করে দেয় এবং চাকরি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
কয়েক মাস এখানে সেখানে সামান্য কাজ করে আমার জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়ে অথচ মিথ্যাবাদী সুপারভাইজার কোনো সাজাই পায়নি। দীর্ঘদিন পর বিষয়টি মালিকের নজরে আসে এবং আমাকে হলিউডে ভালো জায়গায় কাজ দেবেন বলে নিশ্চিত করেন। তখন হলিউডের এই প্রতিষ্ঠান আমার কোম্পানির হস্তগত হওয়ার প্রক্রিয়াধীন ছিল। সেই সময় আমাকে অন্য এক সিটিতে কাজ দেওয়া হয়, যেখানে যাওয়া-আসা এবং কাজের ধকল আমাকে নাস্তানাবুদ করে তোলে। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। হলিউডের সূর্য কবে উদয় হবে সে জন্য আমাকে প্রতি ভোর অপেক্ষা করতে হয়।
সকল কিছু অতিক্রম করে অবশেষে দেড় বছর পর হলিউডে এক সোনালি সূর্যের উদয় হয়। আমার কোম্পানি হলিউডে অনেকগুলো পার্কিং গ্যারেজ ইজারা পায়। মালিকের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য আমি তাগাদা দিতে থাকি এবং মালিক তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। বলতে গেলে তিনি আমাকে হলিউডে সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াজ লোকেশনে কাজ দেন। ২০১৪ সালের মধ্য ডিসেম্বরে আমি হলিউডে কাজে যোগদান করি। এই প্যাঁচাল লেখা পর্যন্ত আমি একই জায়গায় কর্মরত আছি। গত ২৪ জুলাই ২০২৩ একুশ বছরের নানা ঘটনার এক অলিখিত মহাকাব্যের অবসান ঘটিয়ে চাকরিটি আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি চাকরিটি এখনো ছাড়িনি। কিন্তু কোম্পানির ইউনিফর্ম আইডিসহ সবকিছু বুঝিয়ে দেওয়ার সময় অবুঝ শিশুর মতো কেঁদেছি, যার কোনো অর্থই হয় না। কিন্তু একজন অর্থাৎ প্রথম ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জানে না ছোট এই চাকরিটি কীভাবে গত ২১ বছর আমাকে এই শহরে টিকিয়ে রেখেছে।
এবার আসল ঘটনাটি বলা যাক। আমি আমার কর্মস্থলে কাজ করছি। ২০২৩ সালের মার্চ বা এপ্রিলের ঘটনা। দিন তারিখ সঠিক মনে নেই। বিকাল তখন সাড়ে ছয়টা বা সাতটা হবে। আমার ম্যানেজার মিস ভ্যানিসা গার্সিয়া কাজ শেষ করে বাসার দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার অফিসে বুথের সামনের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো কাস্টমার নেই। আমি কোনো কারণ ছাড়াই দাঁড়িয়ে। আমার পার্কিং গ্যারেজটি চারতলা একটি বিল্ডিং। এখানে একসঙ্গে প্রায় ৪৫০টি গাড়ি পার্ক করা যায়। এর নিচতলায় এক কোনায় ছোট একটি অফিস যেখানে একজন ম্যানেজার, ক্লার্ক, একজন ক্যাশিয়ার কাজ করে। সুপারভাইজার বা অন্য কর্মচারিরাও বিভিন্ন প্রয়োজনে এই অফিস ব্যবহার করে। অফিস কক্ষের সামনে দিয়ে একটি গাড়ি বের হওয়ার দরজা আছে। এখানেই কাস্টমারকে থামতে হয় এবং নির্ধারিত ফি দিয়ে বের হতে হয়। আমার পদবি হলো ক্যাশিয়ার। নির্ধারিত ফি আদায়ে করে গেট খুলে দেওয়া।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাম দিকে তাকালে রাস্তার কিছু অংশ দেখা যায়। ডান দিকে তাকালে গ্যারেজের শেষ দেওয়াল এবং সামনে এক্সিট এবং গ্যারেজের কিছু অংশ। উপর থেকে কেউ একজন গ্যারেজের শেষ অংশ এবং রাস্তার শুরু এমন জায়গায় একটা জুতা ফেলেছে। আমার কোনো ভাবান্তর নেই কেন না হোমলেস লোকেরা প্রায়ই এমন কাজ বা এরচেয়ে অদ্ভুত কাজও করে থাকে। এর দু মিনিট পর প্রায় একই স্থানে আরো একটি জুতা ফেলেছে। তবু আমার কিছু আসে যায় না। যদিও এক্সিটের সামনে দুটো জুতা পড়ে আছে দেখতে খারাপ লাগছে। জুতা পরিস্কার করতে অফিসের বাইরে যাবÑ কেমন যেন অসম্মানিত লাগছিল আমার। আমি দাঁড়িয়েই আছি। এর এক দুই মিনিট পর একজন ভদ্র মহিলা আমার জানালার কাছে এসে বললÑ একজন মহিলা তিনতলা থেকে নিচে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করছে। এবার আমি কাল বিলম্ব না করে দ্রুত বাইরে চলে গেলাম এবং উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একজন মহিলা আমার ঠিক অফিস বরাবর তিন তলায় রেলিঙের উপর বসে নিচের দিকে পা ঝুলিয়ে হাত-পা নাড়িয়ে চিৎকার দিচ্ছে আর এটি সেটি নিচে ছুঁড়ে মারছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী করছ এখানে?’ সে জবাব দিল, ‘আমি লাফ দিবো এবং আত্মহত্যা করব।’ আমি দু’হাত নেড়ে নিষেধ করলাম, ‘ভুলেও এ কাজ করবে না। তোমার কী সমস্যা? আমি দেখবো। তুমি নিচে নেমে এসো।’
এবার সে আরো জোরো হাত পা নাড়তে লাগল এবং ন্যাকা কান্না শুরু করল। আমি ভাবতে লাগলাম কীভাবে ওকে লাফ দেওয়া থেকে বিরত রাখব। ইতোমধ্যে আমার ম্যানেজার মিস ভ্যানিসা অফিস থেকে বের হয়ে গিয়ে তার গাড়িতে বসে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন। তিনি গ্যারেজের ভেতরে আর আমি বাইরে। তিনি আমাকে দেখছেন এবং আমিও তাকে দেখছি। আমি তার কাছে এসে বললাম, ‘ম্যাম, দেখে যান একজন মহিলা তিন তলা থেকে লাফ দিতে চায়, সে আত্মহত্যা করবে।’ তিনি ফোনকল কেটে দিয়ে আমার সঙ্গে এলেন এবং উপরের দিকে তাকিয়ে আঁৎকে ওঠলেন। ম্যানেজার আমার চোখের দিকে তাকালেন। কী করা উচিত তিনি স্থির করতে পারলেন না। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি ওই মহিলার চোখের আড়ালে গিয়ে পুলিশ কল করুন, আমি ওকে সামলাচ্ছি।’ ম্যানেজার এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পুলিশ কল করলেন যে তিনি তিন তলার মহিলাকে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু তিন তলার মহিলা আমার ম্যানেজারকে দেখতে পাচ্ছে না। আমি আমার বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করলাম। মহিলার এই আত্মহত্যার পরিকল্পনা আমাকে ঠেকাতেই হবে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি মহিলা যদি লাফ দেয় তাহলে সরাসরি আমার মাথার উপর পড়বে। আর আমি যদি সরে যাই তাহলে পড়বে আমার সামনে। আমি তার সঙ্গে নানা ধরনের কথা বলে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে লাগলাম। আমার পরম সৌভাগ্য যে মহিলা আমার কথা শুনছে এবং জবাব দিচ্ছে। আমার পরিকল্পনা হলো সর্বোচ্চ দশ মিনিট যদি এভাবে কাটাতে পারি তাহলে এর মধ্যেই পুলিশ চলে আসবে। আমি তাকে বললাম, ‘তুমি কি জানো, আমি এই গ্যারেজের মালিক। তুমি চাইলে আমি এটা তোমাকে লিখে দিতে পারি, কিন্তু খবরদার লাফ দিবে না।’
সে এমন এক বিপদজনক জায়গায় বসে আছে যে, নড়াচড়ায় একটু অসাবধান হলে এমনিতেই নিচে পড়ে যাবে। আমি বললাম, ‘তুমি বসে থাকো, আমি এসে তোমাকে নামিয়ে নিয়ে আসি।’
কিন্তু সে আমাকে তার কাছেও যেতে দিতে চাইল না। সে যেখানে বসে আছে লিফট ব্যবহার করলে আমি ৩০-৩৫ সেকেণ্ডে তার কাছে যেতে পারি। এরপর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তাকে দেখালাম, ‘এই ব্যাগভর্তি ডলার আছে। তোমার যত খুশি তুমি নিতে পারো। তবু তুমি নিচে নেমে এসো।’
তাতেও সে সম্মত নয়। সে তার ক্রেডিট কার্ড, নেইল পলিশ, লিপস্টিক একটা একটা করে নিচে ছুঁড়ে মারছে। আমি তার সঙ্গে আরো আবোল-তাবোল কথা বলে যাচ্ছি এবং ম্যানেজার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে এবং অবস্থান ও গতিবিধি জেনে নিচ্ছে। আমি শীতে জমে যাচ্ছিলাম। ম্যানেজারকে বললাম ওর দিকে নজর রাখতে। আমি এক দৌড়ে অফিস রুমে ঢুকে আমার জ্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এখনো আমি পুরোপুরি ঠিক আছি এবং আমার পরিকল্পনা ঠিকমতো কাজ করছে। আমি মহিলাকে ছেলে ভোলানো কথা-বার্তা বলে যাচ্ছি এবং সে সঙ্গে সায় দিয়ে যাচ্ছে। এক সময় আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কেন আত্মহত্যা করতে চাও?’ সে জবাব দিল, ‘এটি খুব খারাপ এক গল্প।’ আমি বললাম, ‘সেটি যতই খারাপ হোক আমি তা শুনবো এবং তার সমাধান করে দিবো। তবু তুমি নেমে এসো।’ তার একই কথা সে নামবে না এবং লাফ দেবেই।
আমার হাতে ঘড়ি ছিল না এবং পকেটে কোনো মোবাইল ফোনও ছিল না। মোবাইল ফোনটি অফিসে। ছোটবেলা থেকেই সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত আছি। নৈতিকতার বিচারে এ সময় তার কোনো ছবি তোলা সংগত মনে না হওয়ায় আমি তার কোনো ছবি তুলিনি। এভাবে কত মিনিট পার হয়েছে বলতে পারবো না। তবে দশ মিনিট পার না-ও হতে পারে। রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার গাড়িতে ভরে গেছে।
ইতোমধ্যে পুলিশ রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়েছে। সকলে এখন তাকিয়ে আছে তিন তলায় রেলিঙে বসা মহিলার দিকে। এমন সময় পুলিশের একটি গাড়ি এসে আমাকে গেটটি খুলে দিতে বলল। আমি অফিস রুম থেকে চাবি এনে গেট খুলে দিলাম। পুলিশ কীভাবে তার কাছে যাবে তা আমার জানা ছিল। মহিলা শুধু রাস্তার উপর জমায়েত হওয়া গাড়িগুলোই দেখছে কিন্তু তার পিছন দিয়ে পুলিশ তার কাছে যেতে পারে সেটি বোধ হয় তার জানা ছিল না। এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে পুলিশ তার কাছে পৌঁছে যায় এবং সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে পিছন থেকে ধরে ফেলে।
দুই-তিন মিনিটের মধ্যে পুলিশ তাকে গাড়িতে করে রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে আসে। এ সময় বিভিন্ন সংস্থার লোকজন পুলিশের গাড়িটি ঘিরে ধরে এবং মহিলাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে। এ সময় আমিও তার কাছে যেতে চাইলে পুলিশ আমাকে বাধা দেয়, পুলিশের ওপর আমার ভীষণ রাগ হয়। পুলিশ আমাকে প্রশ্ন করল, কেন আমি তার কাছে যেতে চাই। আমি জবাবে বললাম তার সঙ্গে আমার কথা আছে। পুলিশ আমাকে দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে বলল। রাগে আমার গা জ¦লে যাচ্ছিল। এতক্ষণ তো আমিই মহিলাকে নানা ছলনা করে ঝাঁপ দেওয়া থেকে বিরত রেখেছিলাম। এক মুহূর্তেই আমি হিরো থেকে জিরো হয়ে গেলাম! পুলিশের গাড়ি থেকে আমি পাঁচ-ছয় ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছি। পুলিশ মহিলাকে নামিয়ে আনার আগ পর্যন্ত সকলেই আমার ভূমিকাটি দেখেছে। এখন বিভিন্ন সংস্থার লোকজন তাকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করছে আর ছবি তুলছে কিন্তু আমাকে ধারেকাছে যেতে দিচ্ছে না।
তিন-চার মিনিট বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের সঙ্গে কথা বলার পর গাড়ির জানালা আটকে চলে যাচ্ছিল। এবার আমি গাড়ির পিছনে দৌড়াতে লাগলাম। কয়েক গজ যাবার পর পুলিশ গাড়িটি থামাল। পুলিশ জানতে চাইল আমি গাড়ির পিছনে দৌড়াচ্ছি কেন? আমি জবাব দিলাম, আমি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। পুলিশ জবাব দিলো, সে তো কারো সঙ্গে কথা বলবে না। আমি পুলিশকে অনুরোধ করলাম, তুমি জানালা খুলে দিয়েই দেখ না, সে কথা বলে কিনা। পুলিশ জানালা খুলে দিলো। মহিলা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকাল। পুলিশের গাড়ির পিছনের সিটে তেরছা হয়ে সে বসে আছে। পুলিশ আমাকে তাড়া দিচ্ছে- যা বলার তাড়াতাড়ি বলার জন্য। আমি মহিলার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আত্মহত্যা কোনো ঘটনার চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। তুমি যে কারণে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে, তুমি আত্মহত্যা করলে তো সে ঘটনা বন্ধ হতো না। তোমাকে বেঁচে থেকেই ঘটনার মোকাবেলা করতে হবে। এমন বোকামি আর কখনো করবে না। তোমার জন্য আমার শুভকামনা রইল।’
পুলিশ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা কী বুঝল আমি জানি না। হয়তো ভেবেছ এমন উপদেশওয়ালা হলিউডে অভাব নেই। মহিলা যদি ঝাঁপ দিত এতক্ষণে হয়তো লাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকত। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ যে সে মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনেছে।
এরপর পুলিশ গাড়ির জানালা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল। আমি অফিস রুমের দিকে চলে এলাম। আমার ম্যানেজার মিস ভ্যানেসা গার্সিয়া তার গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি অন্যরকম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তিনি হয়তো ভাবছেন কেউ ছোট চাকরি করলেও বড় বুদ্ধি রাখতে পারেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মহিলা কেন আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল আমি তার কারণ জানি কিনা?’ আমি বললাম, ‘মহিলা বলেছেন, এটি একটি খারাপ গল্প, আমি গল্পটি জানতে চাইনি।’
ম্যানেজার বললেন, ‘মহিলার স্বামী তাকে রেখে অন্য আর একজন মহিলার সঙ্গে পরকিয়া করছে যা সে দেখেছে, সে জন্যই সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছে।’
আমি ছোট করে জবাব দিলাম, ‘ও’। ম্যানেজার চলে গেলেন।
আমি অফিস রুমে ঢুকে আমার চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লাম। শীতের মধ্যেও এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল পান করলাম। কৃতজ্ঞচিত্তে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালাম দরকারের সময় আমার বুদ্ধি সঠিকভাবে কাজ করেছে বলে। জীবনে এমন ঘটনার মুখোমুখি আর হতে হয়নি।
মহিলা চলে গেলেও সে আমার মাথার মধ্যে রয়ে গেছে। যদি আমার সামনে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করত তবে সে দৃশ্য আমি কীভাবে সহ্য করতাম? ঘটনাটি ঘটেছিল এক শুক্রবার বিকেলে ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে।
পরের মঙ্গলবার আমার ডিস্ট্রিক ম্যানেজার মিস জেনিফারের সঙ্গে অফিসে আমার দেখা হয়, তার সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপারে বৈরী সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। আর আমি তার কথার নিরব জবাব দিতাম এই বলে যে, ‘আমাকে কেউ দেখতে পারা না পারা আমার কাছে কোনো মূল্য নেই। এটি কোনো অর্থই বহন করে না। আমার ন্যায্য প্রাপ্তিতে কেউ বাধা দিলে প্রতিবাদ করার অধিকার আমার আছে।’ আমাকে আমার ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করার কারণেই আমার এমন ক্ষ্যাপাটে স্বভাব হয়েছে।
অফিসে দেখা হওয়া মাত্র তিনি আমার কাছে জানতে চান, ‘এমন একটি সিরিয়াস ঘটনাকে আমি কীভাবে সামাল দিলাম।’ আমি কোনো প্রকার ভূমিকা না করেই সংক্ষেপে জবাব দিলাম, ‘নানা ধরনের কথা বলে তাকে ভুলিয়ে ঝাঁপ দেওয়া থেকে বিরত রাখি। আর অপেক্ষা করতে থাকি পুলিশের গাড়ি আসার জন্য।’ তিনি শুধু শুনলেন। এই ঘটনার জন্য বাজারের সবচেয়ে সস্তা পণ্য একটি ‘ধন্যবাদ’ আমার প্রাপ্য ছিল কিনা জানি না। তিনি ধন্যবাদ জানালেন না। সম্ভবত শত্রু যদি কোনো ভালো কাজ করে তাহলে ধন্যবাদ জানানোর রেওয়াজ তাদের নেই। আমি তাতে বিন্দুমাত্র কিছু মনে করিনি। তবে যে কেউ অনুমান করতে পারছেন যে মহিলা যদি লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতেন তবে কোম্পানি, প্রপার্টি মালিক সিটি অব লস অ্যাঞ্জেলেসকে বিরাট ধরনের জরিমানা গুনতে হতো।
মিস জেনিফার তখন অফিসের কম্পিউটার মাউস নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। তিনি জানালেন যে এই ঘটনা কোনো প্রকার অঘটন ছাড়া সামাল দিতে পারার জন্য সিটি অব লস অ্যাঞ্জেলেস মিস ভ্যানিসা ও তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার কাছে ই-মেইল করেছে। তিনি আমাকে ই-মেইল পড়ে শোনালেন। আমি এর একটি প্রিন্ট কপি চাইলে তিনি জানালেন আমাকে প্রিন্ট কপি দিতে হলে তার বসের পারমিশন লাগবে। তার বসের সাথেও আমার সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে। তারা হয়তো ভেবেছিলেন সিটির এই ই-মেইল দেখিয়ে আমি কোথাও থেকে কোনো সুবিধা বাগিয়ে নিতে পারি। এরপর আরো একদিন আমি জেনিফারের কাছে একটি প্রিন্ট কপি চাই। এবার তিনি বসের কথা বাদ দিয়ে হিউম্যান রিসোর্সের অনুমোদনের কথা বলে এড়িয়ে যান। এরপর আর একদিন অনুরোধ করি আমার প্রিন্ট কপি দরকার নেই শুধু কত তারিখে ঘটনাটি ঘটেছিল তারিখটি বললেই চলবে। আমি তারিখটি ভুলে গেছি। তিনি দেই দিচ্ছি করে আর দিলেন না।
২০২৩ সালের ২৪ জুলাই কোম্পানি সিটি অব লস অ্যাঞ্জেলেসের সঙ্গে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। ফলে আমি চাকরি হারাই এবং জেনিফার তার কোম্পানির সঙ্গেই থেকে যায়। আমি নতুন কোম্পানিতে যোগদান করি একই পদে। একই স্থানে থেকে যাই এবং জেনিফারের সঙ্গে আমার চিরদিনের জন্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মিস ভ্যানিসা আগেই চাকরি ছেড়ে চলে যায়। কাকতালীয় হোক আর কোকিলতালীয় হোক মিস ভ্যানিসা এবং আমি এখন একই কোম্পানিতে আছি। যাওয়ার দিন তিনি কথা দিয়েছিলেন আমাকে এসে দেখে যাবেন। সম্প্রতি তিনি এসে আমাকে দেখে গিয়েছেন।
তপন দেবনাথ : প্রবাসী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ