বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি তা কখনোই ওয়াশিংটনকে সামরিক স্বৈরশাসক এবং স্বৈরাচারি শাসকদের সমর্থন করতে বাঁধা দেয়নি। অথচ ওয়াশিংটনের নীতি ছিল এতে বাঁধা দেওয়া। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে, উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছে একের পর এক আত্মসমর্পণ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো। সে সময় ওয়াশিংটন এবং তার মিত্রদের হতে এসব উন্নয়নশীল দেশ ব্যাপক সামরিক কর্তৃত্ববাদের শিকার হয়। আজও সে পরিস্থিতি ভিন্ন কিছু নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন মিত্র পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামোকে শক্তিশালী করতে অনেক কিছুই করেছে ওয়াশিংটন। তবে ইসলামাবাদ চীনের দিকে ঝুঁকে গেলে তা ওয়াশিংটনের ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। ফলে তারা আবার পাকিস্তানকে তাদের গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতির পর্যায়ক্রমিক পুনঃবিবৃতির জন্য একটি সুবিধাজনক লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। রাষ্ট্রের আদর্শ এবং প্রকৃত বাস্তবতার মধ্যে বিরাট দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও, রাজনীতিতে গণতন্ত্রের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আজ আর নেই। তথাপি শাস্ত্রীয় গণতন্ত্র এবং বিশ্বব্যাপী আমাদের দেখা গণতন্ত্রের মধ্যে রয়ে গেছে বিস্তর এক ফারাক। গ্লোবাল সাউথ থেকে অভিবাসীদের বাদ দিতে বা দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টার্গেট করার জন্য জনপ্রিয় সব স্লোগান ব্যবহার করেছে ডানপন্থীরা। ডানপন্থীদের এই উত্থান গণতন্ত্রের ঘাটতির বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটি হইচই তৈরি করেছে। কিন্তু, এ ধরনের কুসংস্কারমূলক ও অগণতান্ত্রিক চর্চা কোনো নতুন ঘটনা নয়। ঐতিহাসিক ভাবেই এর ভিত্তি রয়েছে। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা এবং কর্তৃত্ববাদী দমন-পীড়নের অগণিত ঘটনাগুলো বিশেষ করে ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া যায়।
ঔপনিবেশিক শাসনের মূল দায়িত্ব ছিল শোষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়া। তারা শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইনের ডালি সাঁজিয়ে রাখতো এবং জনগণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের জবরদস্তিমূলক শক্তি প্রয়োগ করতো। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করে এমন স্বাধীনতা এবং আর্থ-সামাজিক আকাক্সক্ষার প্রচার করেনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থা। পরিবর্তে তা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর নিপীড়নমূলক এবং অসাম্যমূলক কাঠামো এবং নীতিগুলোকেই বজায় রেখেছে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী জালিয়াতি ও গণতন্ত্রের অপূর্ণতাগুলো সংশোধনে বাংলাদেশকে চাপ প্রয়োগ করছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের বাণীগুলো সাবেক ব্রিটিশ রাজের উত্তরাধিকার থেকে এসেছে। ব্রিটিশ রাজকে প্রতিস্থাপনকারী দেশগুলোতে ব্রিটিশদের সেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় এসে পৌঁছেছে। আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের বক্তৃতা। যার প্রধান লক্ষ্য প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখানে সুবিধাপ্রাপ্ত একটি শ্রেণি তৈরি করা। যারা উন্নয়নের প্রচারের জন্য একটি উপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করে। আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের উত্তরাধিকার থেকে উদ্ভূত নাগরিকত্বের যে কোনো ধারণাই ঔপনিবেশিক যুগের বিকৃতি ও দুর্ভাগ্য এড়াতে পারেনি। পাকিস্তান সুদীর্ঘ কাল ধরে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শাসনের আদর্শ হয়ে উঠেছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার যুদ্ধই এর গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কেন্দ্রবিন্দু। ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে ইসলামাবাদের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্ররোচণা এবং জটিল অর্থনৈতিক সমস্যার মুখে পুরানো কর্তৃত্ববাদ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল।
পাকিস্তানের একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হলো-জবাবদিহি কমে যাওয়ার শঙ্কার সাথে সাথে সেখানে একটি বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের অস্বস্তিকর সমীকরণে চতুর্থ উপাদান হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আবির্ভাব যে ইতিবাচক তাতে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রী, একজন প্রধান বিচারপতি বা রাষ্ট্রপতির যতই জনপ্রিয়তা থাকুক না কেন সেনাবাহিনীর প্রধানই এখনো পাকিস্তানের শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী। খাকি-পোশাকের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে লড়াই করার প্রবণতা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের অভাবে পাকিস্তান আজ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রয়েছে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই দুটি দলই গত তিন দশক ধরে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের সরকার ও বিরোধী দলের আসনে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখনো গণতন্ত্র জীবিত থাকলেও তার দশা হয়েছে কলঙ্কিত এবং ভঙ্গুর। বাস্তবের সাথে গণতন্ত্রের আদর্শগুলো এখানে সংগ্রাম করছে। ঔপনিবেশিক আমলের অনেক কর্তৃত্ববাদী বৈশিষ্ট্যই উত্তর-ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কর্তৃত্ববাদ আরও শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে। ঔপনিবেশিক যুগের আরেকটি উজ্জ্বল ধারাবাহিকতা হল-দমনমূলক আটকের নীতি। কোনো ব্যক্তি সরকার বা ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধমত হলে বা ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে দমনমূলক আটক করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে এই নীতির অনুশীলন হচ্ছে। এসব দেশে বহু মানুষকে বিনা বিচারে বন্দি করা হয় এবং বন্দি রাখা হয়।
১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের প্রণীত যুদ্ধকালীন অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে প্রথম সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। গান্ধীর পরিভাষায় এগুলো ছিল-অনিয়ম আইন। ব্রিটিশদের করা সেই আইন এখন অনুশীলন করছে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের গণতন্ত্রীয়নামী কর্তৃত্ববাদী সরকার। আর সেই মডেল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত। ঔপনিবেশিক পূর্বসূরি থেকে সার্বভৌমত্বের একক মতাদর্শের সাথে সুনির্দিষ্ট অনাচারী আইনের ধারাবাহিকতা বা পুনঃপ্রবর্তনের রদ করা দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অসংখ্য অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। এসব সমস্যা সৃজনশীলভাবে মিটমাট করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশে কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। উপমহাদেশ জুড়ে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কূটনৈতিক অগ্রগতি অপরিহার্য। ঔপনিবেশিক শাসনের কর্তৃত্ববাদী উত্তরাধিকার থেকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর আবার রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। শাসক ও ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন মানেই আন্দোলন-সংগ্রামের জয় নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রক্ত ঝরা অনেক আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু তার সব লক্ষ্য-আকাক্সক্ষা অর্জন করতে পারেনি। ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই, কিন্তু তার চরিত্র ও কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই সব আন্দোলন-সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কর্মসূচী-অঙ্গীকার থাকার পরো তা জনআকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরই আমরা সেই অবস্থা দেখেছি। এমনকি ৯০-এর গণআন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তিত শাসকের চরিত্রেও তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এসব আন্দোলন ছিল ধারাবাহিক, পরিকল্পিত ও কর্মসূচীভিত্তিক। অভিজ্ঞ নেতৃত্বও সেখানে ছিল। নীতি ও কাঠামোগত পরিবর্তন না করে শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন দিয়ে তা অর্জন করার প্রচেষ্টা ছিল মারাত্মক ভুল।
প্রতিবেশী মিয়ানমারে দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পর সামরিক সরকারকে সরিয়ে সুকি ক্ষমতায় এসেও নিজের হাতকে রক্তাক্ত করেছেন। শান্তিতে নোবেল পেয়েও সেটাকে কলঙ্কিত, কলুষিত করেছেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপোষ করে ক্ষমতায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা রক্ষা করতে পারেননি। আবারো সেখানে হত্যা-নির্যাতন চলছে ও সীমাহীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো শাসকই তার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ইমরান খানের দল আর বছর খানেক থাকলেই সেই গৌরবের অধিকারী হতো। কিন্তু বিরোধীদের কারণে তা হতে পারেনি। তাকে চলে যেতে হয়েছে। এই অঞ্চলের আরেক দেশ আফগানিস্তানের অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। দীর্ঘ যুদ্ধে তার সবকিছুই ভেঙে পরেছে। দেশটির অর্থনৈতিক সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী ও ধর্ম দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটির বর্তমান সরকারের এখনো কোনো স্বীকৃতি নেই। শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, সারা বিশ্বেই বিচিত্র মাত্রায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গত কয়েক দশকে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে বামপন্থিদের প্রভাব বাড়ছে। ইউরোপের অনেক জায়গাতেও বামপন্থিরা এগিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক জায়গায় ডান ও অতি ডানপন্থিদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কোথায় জাতীয়তাবাদ ও উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তিশালী হচ্ছে, কোথাও ধর্মান্ধতার প্রভাব বাড়ছে। মানুষের স্বাধীনতা ও পছন্দের অধিকারকে অস্বীকার করি না। যেকোনো দেশের মানুষ তারা পছন্দ অনুযায়ীই চলবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব দেশ-জাতির চিন্তা-চেতনা-পছন্দ-আকাক্সক্ষার মানের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো। তাদের দায়িত্ব সেভাবেই সেখানে শাসন কাঠামো ও পদ্ধতির পরিবেশ তৈরি করা। একটি অগ্রসর রাজনৈতিক ধারা বা সংস্কৃতির বিস্তার ও সমাজের গুণগত পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা।
কিন্তু নীতিহীন, দুর্নীতিবাজ শাসকদের পাল্লায় পরে দেশ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পিছিয়ে যায়, সংকটপূর্ণ হয়। শিক্ষা ও উন্নয়নে এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কায় ভুল নেতৃত্বের কারণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে সৃষ্ট বিরল বিদ্রোহের দৃশ্য বিশ্ব প্রত্যক্ষ করলো। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে। কীভাবে নির্বাচন হবে, সেখানে সব দল অংশগ্রহণ করবে কিনা-তা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। আগের মতো নির্বাচন হলে দেশ-বিদেশে তা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠছে। তেমন কিছু হলে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেই ভাবনায় নাগরিকরা শঙ্কিত। বর্তমান সরকার কি পারবে বিগত দিনের মতো সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে? নাকি বিগত ও বিদ্যমান সংকট থেকে শুরু হওয়া কোনো গণআন্দোলন সবকিছু এলোমেলো করে দেবে। এমন প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে নাগরিকদের মাঝে।
রায়হান আহমেদ তপাদার : প্রবাসী ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ