
দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সম্যস্যা। মানব সভ্যতার বিকাশ, বৈষম্যমুক্ত সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতি অন্যতম অন্তরায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নানান উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হওয়ায় দেশে উন্নয়ন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, সঙ্গে বেড়েছে দুর্নীতি, অনিয়মও। দুর্নীতি বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ফলে এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হলেও প্রত্যাশিত উন্নয়ন এখনো হয়নি। যদিও দুর্নীতির অভিযোগে কয়েকজন মন্ত্রী, দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে এটি এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর এই নীতি বাস্তবায়নে কতটুকু আন্তরিক, কতটুকু সক্ষম, কতটুকু প্রস্তুত তাও প্রশ্ন স্বাপেক্ষ। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কালো অধ্যায় হিসেবে পরিচিত বিগত ‘এক এগার’র সরকারের সময়ে দুদকের কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাবেক বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা, মামলায় জড়িতদের গ্রেফতার, তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত আইনী ব্যবস্থা ছিল মূলত সকল রকম নীতি, আইন, বিধি বিধান এবং দুদক আইন এবং সংবিধানের পরিপন্থি। তখন গায়ের জোরে অসৎ উদ্দেশ্যে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ তথা সাজানো মামলা, চার্জশিট, তদন্ত, গ্রেফারের ঘটনায় শুধু দুদককে প্রশ্নবিদ্ধ, বির্তকিত করেনি একই সঙ্গে ‘দুদকের ইমেজ সংকট’ হয়েছে দারুণ ভাবে। এ কারণে এ জন্য জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে দুদককে।
আবার ‘সরিষায় ভূত’ রেখে তথা দুদকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারি রেখে ‘দুর্নীতির ভূত’ তাড়ানোর উদ্যোগ কার্যকর হবে না। অবশ্য ইতোমধ্যে দুদক তাদের হারানো ‘ইমেজ’ পুনঃরুদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে দুদক কর্মকর্তা এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তার ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন, কমিশনের তথ্য পাচার ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়। একই ভাবে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ জমি, ফ্ল্যাট, প্লট, ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রাখার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম কার্যালয়ে থাকাকালে অনুরূপ অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। অনুরূপ দুর্নীতির অভিযোগে দুদক পরিচালক ফজলুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- আসামিদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ, আর্থিক লেনদেন ও দুর্নীতির অনুসন্ধানের তথ্য ফাঁস। তিনি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।
দুর্নীতি দমন কমিশশের প্রতিবেদন দেখা যায়, তাদের কাজের অধিকাংশ সূচক নিম্নগামী। এটি হতাশাজনক চিত্র। কয়েক দফায় দুদকের জনবল বাড়লেও কাজে গতি বাড়েনি। তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত তিন বছরে উল্লেখ করার মতো কোনো সাফল্য নেই সংস্থাটির। উল্টো দুর্নীতির অভিযোগ থাকা দেড় হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, মেয়র, সচিব, পুলিশ, ব্যাংক কর্মকর্তা, ওয়াসা, রাজউক, গণপূর্ত, বাপেক্স ও তিতাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছে। দায়মুক্তি প্রাপ্ত অনেকের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে তথ্য-উপাত্তসহ প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও অনুসন্ধানে দুদক কোনো সত্যতা খুঁজে পেল না সে প্রশ্ন থেকে যায়। নিয়ম অনুযায়ী, দুর্নীতির অভিযোগ প্রাপ্তির পর এ সংশ্লিষ্ট কমিটি অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিলে তা ৭৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে। কিন্তু তা যথাযথ অনুসরন করা হয় না বলে বিভিন্ন সময়ে খবর প্রকাশ হয়। প্রসঙ্গত দুদকের করা একটি মামলাও এ মামলায় সম্পৃক্ত আসামীকে গ্রেফতার নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দুদক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভুলের খেসারত দিলেন জাহা আলম নামের একজন নিরীহ শ্রমিক। ভুল সংশোধন করে সম্পুরক চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। জাহা আলমকে বাদ দিয়ে সেই ভুল সংশোধন করে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে অনেক সময় কোনো বিশেষ মহলের চাপে বা তাদের খুশী রাখতে সনামধন্য ব্যবসায়ি, শিল্পপতির নামে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে দুদক। এসব মামলার ক্ষেত্রে বিবাদীপক্ষ তাদের যাবতীয় তথ্য উপাত্ত, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দুদককে দিলেও তা আমলে নেয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। কাজেই জাহা আলমের মতো এ ধরনের সাজানো মামলার কারণে দুদক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অভিমত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা গেলে দুদককে শক্তিশালী ও কার্যকর করা সম্ভব।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের একমাত্র কাজ হচ্ছে দুর্নীতি দমন। এক্ষেত্রে অপরাধীদের মধ্যে কে কোন দলের অনুসারী, কতটা প্রভাবশালী তা বিবেচনায় আনা ঠিক নয়। অথচ দুদকের কাজকর্মে তা প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা অটুট রাখতে হলে দুদককে অবশ্যই কাজের মধ্য দিয়ে নিষ্টা, সততা শতভাগ নির্মোহভাবে প্রমাণ দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে দুদক একটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। দেশে যে হারে দুর্নীতির বিস্তার ঘটছে। দেশে প্রকৃত উন্নয়নের স্বার্থে দুর্নীতির মূলোৎপাটন জরুরি। দুদকের ২০২২ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়। তাতে অনেক সুপারিশ রাখা হয়। এতে বলা হয়, ঘুষ-দুর্নীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উভয়পক্ষ সুবিধাভোগী। বঞ্চিত হয় শুধু রাষ্ট্র এবং সমাজ। তাই কমিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সংবিধানে ঘোষিত ম্যান্ডেট অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভোগ করতে না দেওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি কমিটি ওইসব দপ্তরে কী ধরনের দুর্নীতি হয়, কীভাবে সে দুর্নীতি রোধ করা যায়-সেই সুপারিশ কমিশনে দাখিল করে। পরে কমিশন প্রতিটি সুপারিশ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে দাখিল করে। সঙ্গে একটি চিঠিও দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, দুদক টিমের মাধ্যমে ওঠে আসা দুর্নীতি রোধ করা না গেলে মানুষ আরো বেশি ক্ষতির শিকার হবেন। রাষ্ট্রের সেবা থেকে জনগণ বঞ্চিত হবেন। কমিশন থেকে মন্ত্রীদের অনুরোধ করা হয়, তারা যেন স্ব স্ব মন্ত্রণালয় ও তার অধীন দপ্তর ও অধিদপ্তরের দুর্নীতি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। কিন্তু কশিমশনের ওই সুপারিশ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়, সংস্থা, অধিদফতর বাস্তবায়ন করেছে এমন তথ্য নেই। বাস্তবে পর্যাপ্ত আইন না থাকা ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতায় অনেক ক্ষেত্রে দুদক রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। দুর্নীতি বিরোধী অভিযান জোরদারে এবার স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। দুর্নীতিবাজদের তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আওতায় আনতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে সংস্থাটির গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। তাতে মুখ দেখে নয়, দুর্নীতির গুরুত্ব বুঝে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই টিমের সদস্যরা রুটিন কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন। তারা শুধু বিশেষ বা বড় ধরনের দুর্নীতির অনুসন্ধানের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এ টিম অর্থ পাচারে জড়িতদের বিষয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করবে । তা ছাড়াও তাদের নজরে থাকবে জনগুরুত্বপূর্ণ, বহুল আলোচিত এবং স্পর্শকাতর দুর্নীতির ঘটনা।
অপরদিকে সরকারি অফিস-আদালত এমনকি অফিস সময়ের বাইরে অন্য কোথাও ঘুষ লেনদেনের ঘটনা হাতেনাতে ধরতে ছদ্মবেশে কাজ করছেন বিশেষ এ টিমের সদস্যরা। দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তিতে, তদন্তে, অনুসন্ধানে দীর্ঘ সূত্রিতার অবসান দরকার। পাশাপাশি নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি, কাজের স্বচ্ছতা, সক্ষমতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এসব করার সঙ্গে দুদকের হারানো গৌরব, হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ। কাজেই দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন, দেশ গঠনে দুদককে আরো বেশী মনোযোগী হওয়ার প্রত্যাশা। ইতোমধ্যে এই উদ্যোগের সফলতা আসতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে আরো তৎপরতার প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট মহলের।
মোতাহার হোসেন: উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
আজকালের খবর/আরইউ