বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সম্পর্কের রসায়ন
আলমগীর খোরশেদ
প্রকাশ: শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৩:২৮ PM
সৃষ্টিকর্তা জগতের প্রথম মানব বাবা আদমকে সৃষ্টি করলেন তার ইবাদত বা আরাধনার জন্য। আদি মানব আদম বেহেশতে ঘুরে বেড়ান, ফুলে-ফলে-নহরে সজ্জিত বেহেশতে থেকেও কেমন যেন খালি খালি লাগে তার। মনটা বিষণ্ন হয়ে থাকে সারাক্ষণ। একটা শূন্যতা একাকীত্ব বিষণ্নতা আদমের মনকে কালো মেঘে ছেয়ে রাখে। সৃষ্টিকর্তা বুঝতে পারেন, আদমের একজন সঙ্গি প্রয়োজন। সৃষ্টিকর্তা তাই অনেকটা সময় নিয়ে, অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে, আদমের বাম পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন আদি মানবী বিবি হাওয়াকে। আদমকে ডেকে হাওয়াকে দিলেন সঙ্গী করে। আদমের মন ভালো হয়ে গেলো। আর কোন বিষণ্নতা স্পর্শ করেনি বাবা আদমকে।

সম্পর্ক মানে কি হাতে হাত, চোখে চোখ, কাছে পাওয়ার আকুলতা? মন দিয়ে আরেকটি মনকে স্পর্শ করতে হয়, তাহলেই প্রাণ ফিরে পায় সম্পর্কের নদী। সম্পর্ক কি কেবল বিপরীত লিঙ্গেই সীমাবদ্ধ?  সম্পর্ক কোনোদিন করা যায় না। এটি আস্তে আস্তে গড়ে উঠার বিষয়। কতটুকু অনুভূতি বুকের ভেতর সহমর্মিতার বরফ গলালে সেটি সম্পর্ক হয়, তা একটা আপেক্ষিক বিষয়।  একটি সম্পর্ক যখন সম্পর্কে পরিণত হয়, তখন  সেটিকে বুকের ভেতর আগলে রাখতে হয়। সম্পর্ক মানে একসাথে হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার নির্ভরতা। সম্পর্ক হলো চোখ বুজে পাশের মানুষটার হাত ধরে নিশ্চিন্তে বিশ্বাসের খুঁটি পুঁতে রাখা যায় মনের জমিনে। 

যতোই নারী পুরুষের মাঝে আদর্শিক বোঝাপড়া নিয়ে জীবন চলুক, কোনো একসময় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কাছে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে।  বিপরীত মানুষটার সাথে কোনো না কোন সময় বন্ধুত্বের বাউন্ডারি ক্রস করে, গড়ে উঠে ভালোবাসার সম্পর্ক। নারীরা পুরুষদের বন্ধু ভেবে কাটিয়ে দিতে পারলেও সামাজিকতার রক্তচক্ষুকে এড়াতে পারে না। অপরদিকে পুরুষরা বেশির ভাগ ভাবুক হয়ে মনের অজান্তেই বন্ধু থাকা সেই নারীর প্রেমে পড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন নারীকে তার আরেকজন নারী বন্ধুর চেয়ে পুরুষ সঙ্গী বেশি বুঝতে পারে। আগলে রাখে,  কেয়ারিং হয়। নারীরা তাদের মনের সুখ দুঃখ আরেকজন নারীর কাছে ততোটা বলে সুখ পায় না, যতটুকু পায় একজন পুরুষের কাছে।

দাম্পত্যই হোক কিংবা বন্ধুত্বই হোক সব সম্পর্কেই থাকে ভালো-মন্দের মিশেল এক টকঝাল সৃষ্টি। তিল তিল করে অনেকগুলো স্বপ্ন একসাথে করে গাঁথা হয় সম্পর্কের বিনি সুতোর মালা। খোলা মনে কথা না বললে নিজের ভেতর গুমড়ে মরলে পাশের মানুষটি কোনোদিন তা বুঝবে না। সম্পর্কে স্পার্ক থাকতে হয়। এনার্জি থাকতে হয় সম্পর্কে। বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সন্মান সামাজিক প্রথাকে এড়িয়ে গেলে হোঁচট খেতে হয়। সম্পর্কের রসায়ন তখনি বাড়ে যখন সঠিক বোঝাপড়া ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো হয়। স্বামী স্ত্রী’র সম্পর্ক তো আরো জটিল। এক্ষেত্রে ব্যাক্তিত্ব, উষ্ণতা, মনের টান, দৈহিক আকর্ষণ অন্তরঙ্গতা, মায়া কাজ করে।

সম্পর্কে মানসিক সংযোগ লাগে। যদি মনোযোগ হারিয়ে যায় তবে সম্পর্কও ফিকে হয়ে আসে। দুজনে একসাথে চা, কফি, গেম, স্পর্শ রান্নায় সাহায্য ঘনিষ্টতাকে বাড়িয়ে দেয়।

কাউকে ঠকিয়ে শঠতা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে হয়ত আপাতদৃষ্টিতে নিজেকে সুখী মনে হয় কিন্তু মনের খুঁটি থাকে খুব দুর্বল। যাকে নিয়ে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক হঠাৎ তাকে গুডবাই দেওয়া যায় কি? তার মন জানায় ভুল থাকলেও শরীর জানায় তো ভুল ছিল না। মন ভুলে গেলেও শরীর কখনো ভুলে না। সম্পর্ক বিষয়টি আসে ভালো লাগা থেকে।

রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আত্মার সম্পর্ক বা মনের সম্পর্ক অনেক দৃঢ় হয়। এমনি চলার পথে সব ঠিক থাকলে সম্পর্ক কোনো বিষয় না। কিন্তু যদি রক্তের সম্পর্কের মানুষ কোনো কারণে বিট্রে করে, সে সম্পর্ক কোনোদিন জোড়া লাগে না। যা আরো শত্রুতায় রূপ নেয়। দূরে সরে যায় আপন বলয় থেকে।

একান্নবর্তী পরিবারে মা বাবা ভাইবোন, সবাই মিলে  গড়ে তোলে স্বর্গীয় এক আবহ। একসাথে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, টেলিভিশন দেখা, নববর্ষ উদযাপন, ঈদ ও অন্যান্য পার্বন, ছেলেদের মুসলমানি, কারোর বিয়ে বয়ে আনে আনন্দ উচ্ছ্বাস। সংসারে দুটি মানুষ, বছর ঘুরতেই সৃষ্টির ধারায় তিনজন হয়ে যায়। বাড়ির বড় ছেলেটির উপার্জনে সংসার চলে বিধায় বউটি আলাদা একটা সংসার আশা করে। এতো মানুষের রান্না, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা মন সয়না। সংসারে ননদ-দেবর থাকলে তাদের সাথে সম্পর্কের একটা গ্যাপিং চলে আসে। সবাই কেমন জানি বদলে যেতে থাকে।

কোনো সম্পর্কই জলের মতো নয়। এতে স্বার্থ বা দেনা-পাওনা উঁকি মারে। বোনেরা যদিও সম্পর্কে আপন থাকে, ভাইদের পাশে থাকে, একসময় সেও বদলে যায়। পানি ফুটালে জ্বালিয়ে দেয় আবার সেই পানি ঠাণ্ডায় উপশম দেয়। সংসারে ছেলের বউ আসলে একান্নবর্তী পরিবারে পূর্বে বিরাজ করা শান্তিময় লক্ষ্মী চলে যায়। মেয়েরা ছলে, কৌশলে ধরে রাখতে চায় বরকে হাতের মুঠোয়। সম্পর্কের এটিও একটি কৌশল নাকি অপকৌশল?

পারিবারিক ভাবে বিয়ের জন্য যখন প্রস্তুতি নিতে থাকে তখন বর-কনের  বাড়িতে বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যায়। জাত, কূল, বংশ নিয়ে। প্রেম করা যায় যে কারোর সাথে, কিন্তু যার তার সাথে সংসার নয়। প্রেম আর বাস্তব জীবন এক নয়। সংসার মানে কেবল একসাথে থাকাই নয়, এরই মাঝে আগামী প্রজন্ম, সৃষ্টির চলমান ধারা লুকিয়ে থাকে। বিয়ের পর বুঝা যায়, সেই লালমুখো,  ললিপপ মানুষটা কেমন?

প্রেম করার সময় কোনো চাহিদা, চাওয়া-পাওয়া থাকে না, দুজন একসাথে থাকলে গাছতলায়ও ঘুমাতে পারবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে  তা হয় না।  বিয়ের পর অর্থনৈতিক টানাপোড়ন চললে, ভালোবাসার কথার চেয়ে সাংসারিক চাহিদা, মনে, কথায়, আচরণে পরস্পরকে  আঘাত দেয়। চাল নাই, তেল নাই, আলু নাই, হাজারটা নাই মেঘের মতো চারপাশ থেকে  ঘিরে রাখে। ভালোবাসা তখন হারিয়ে যায় দূর তেপান্তরে।

ছেলে-মেয়েরা ইদানিং খুব চুজি। মেয়েরা যখন অনার্স পড়ে, তখন তাদের মাথায় ঢুকে যায় বিসিএস, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসনের পদস্থ স্বামী। যখন মেয়েটি মাস্টার্স পড়ে বিয়ে হচ্ছে না, বিসিএস চাহিদা থেকে নেমে বর একটা সরকারি চাকরি করে এমন হলেই হবে। তারপরও যখন বিয়ে হয় না, তখন  বলে একটা পয়সাওয়ালা ছেলে হলেই হবে। ছেলেরা ঘোষণা দেয়, মেয়ে হবে শিক্ষিতা, সুন্দরী,  মেরিটোরিয়াস, ধনী বাবার মেয়ে। ভাই বোন বেশি নয়।

সম্পর্কের নীল পাখিটা যতোই ডাকাডাকি করুক, ভালোলাগার  ইনার বিউটি আর আউটার বিউটি এক নয়। মানুষ তার নিজের মনের ভেতর মনকে নিজেই কাঁদায়। সমঝোতা ও মেনে নেওয়া হয় না বলে।

মেয়েরা একটু অপ্রসারণ। নিজেকে লুকায়। যদিও ওরা সময়ের সাথে পুরুষের তুলনায়  বেশি ম্যাচুরড হয়। মেয়েরা নিজেদেরকে বেশি প্রাধান্য করতে এক সময় নিভৃতে নিজেরাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। ভালোবাসা, সম্পর্ক, দিল্লিকা লাড্ডুর মতো, পেলেও  অসম্পূর্ণতা, না পেলেও আফসোস।

সম্পর্ক দুই ভাবে হতে পারেÑ কোনটা ঝোঁকের মাথায়, যেখানে ভাবাবেগ কাজ করে যা ভাবাভাবির ধার ধারে না। জীবনের যত না পাওয়ার বেদনাবোধ  সব সম্পর্কে এসে মাথা নোয়ায়। অজানা-অচেনা দুজন নর নারী ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে এক হাত থেকে চার হাত হয়। পৃথিবীর সব কিছু মনে হয় স্বপ্নময়ী। একই ছাদের নিচে, এক বিছানায় থেকে সম্পর্ক এগিয়ে না গেলেও সন্তান ঠিকই চলে আসে। সন্তান জন্ম দিতে ঘটা করে সম্পর্ককে শো ডাউন করার প্রয়োজন পড়ে না। এটি পুরোটাই শারিরীক মনের কোনো দখল লাগে না।

দীর্ঘদিন সম্পর্ক চালিয়ে নিতে একগুয়েঁমী চলে আসে। একে অপরের প্রতি কাজ করে উদাসীনতা। সম্পর্কে বিরাজ করে শিথিলতা।

সম্পর্কে শিথিলতার চেয়ে ডিভোর্স ভালো। ছাড়াছাড়ি মনকে মানানো যায় কিন্তু পাশাপাশি থেকেও মুখ দেখেও অচেনা ভান, কথাহীন, স্পর্শহীন, মায়াহীন জীবন আরো কষ্টের।

আজ যার সাথে কথা বলতে মন চায় না, অভিমানে দূরে বসে থাকা, সে কি জানে, আজকের এইক্ষণটাই হয়তো শেষ। মানুষটা চলে গেলে কোনো গসিপই হবে না আর। তোতা পাখির মতো সম্পর্ক সম্পর্ক করে যতোই লেখালেখি কলমের নিভ থেকে বেরিয়ে আসুক, বাস্তবতার আলোকে সম্পর্ক বলতে তখন কিছুই থাকে না। সম্পর্কে মানসিক ঘনিষ্ঠতা, মানসিক সংযোগ, একে অন্যের প্রতি মায়া, টান, খোলাখুলি কথা, আত্মঅন্বেষণ খুবই জরুরি। তাহলেই জমে উঠে সম্পর্কের রসায়ন।

আজকালের খবর/আরইউ