রবিবার ৩ ডিসেম্বর ২০২৩
জি-২০ সম্মেলন: বৈশ্বিক সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর চার প্রস্তাবনা
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ: বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৮:১২ PM
ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো বহুল প্রত্যাশিত জি-২০ সম্মেলন।  এই সম্মেলনকে ঘিরে জি-২০ সদস্যভূক্ত দেশসমূহ ছাড়াও বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহেরও আগ্রহও লক্ষ্যণীয়। এর কারণ জি-২০ সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের বহুপাক্ষিক বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা  সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। একই সঙ্গে সম্মেলনে অংশ নেওয়া জি-২০ সদস্যভূক্ত রাষ্ট্রের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা বিশ^ব্যাপী চলমান সন্ত্রাস, জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলার পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেয়।

এবারের প্রতিপাদ্য ছিলো, ‘চেতনায় এক পৃথিবী এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’। মূলত দীর্ঘ দিন ধরেই বিশ^ নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের বৈঠকের ‘এক বিশ^, এক পরিবার, ভিসা মুক্ত বিশ^’ গড়ার স্লোগান দিয়ে আসছিলো। এবার বিষয়টি সম্মেলনের প্রতিপাদ্য করে সামনে নিয়ে আসা হলো। আর এ কারণে পুরো বিশে^র দৃষ্টি ও আগ্রহের কেন্দ্র এই সম্মেলন। দিল্লির ঐতিহাসিক প্রগতি ময়দানের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার ‘ভারত মন্ডপম’-এ এবারের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন জি-২০-এর সদস্যসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নেতারা। আমাদের সৌভাগ্য সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তার বক্তব্যও বিশ^ নেতাদের দৃষ্টি কেড়েছে।  অন্যদিকে কনভেনশন সেন্টারের সামনেই স্থাপন করা হয়েছিল বিশাল এক নটরাজ মূর্তি। জি-২০ সম্মেলনে বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের স্বাগত জানাতে ২৮ ফুট লম্বা এ নটরাজ মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল।

১৯৯৯ সালে এশিয়ার আর্থিক সংকটে পরে বিশ্বের ২০টি প্রধান দেশ একটি অর্থনৈতিক গোষ্ঠী গঠন করে, যা জি-২০ নামে পরিচিত। এই জোট বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মোট জিডিপির ৮০ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ পরিচালনা করে। এখন পর্যন্ত ১৭টি জি-২০ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আর এবারের ১৮তম জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নয়াদিল্লিতে। শীর্ষ সম্মেলনের আগে ভারতের ৬০টি শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি-২০র ২২০টি বৈঠক। এসব বৈঠকে প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন।

জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষ্যে বিশেষ লোগো প্রকাশ করে ভারত।  লোগোতে সাত পাপড়ির এক পদ্মফুলের ছবি রয়েছে। পদ্ম ভারতের জাতীয় ফুল, ভারতের আধ্যাত্মিক ধারণাতেও এই ফুলটি পবিত্র বলে স্বীকৃত। জি-২০ সভাপতিত্বের লোগোতে পদ্মের চিহ্নকে তাই ভারতের সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিকতা, সম্পদের প্রতীক বলেই জানিয়েছে ভারত। লোগো উন্মোচনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, পদ্মের সাতটি পাপড়ি পৃথিবীর সাতটি মহাদেশ এবং সংগীতের সাতটি সুরের প্রতিনিধিত্ব করছে। একইসঙ্গে লোগোতে ছিলো গেরুয়া, সাদা, সবুজ ও নীল রংয়ের সংমিশ্রণ। জি-২০ সম্মেলন গোটা বিশ্বকে একত্রিত করবে।

জি-২০ এবারের সম্মেলন এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে,  যখন করোনা মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর পরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট প্রবল হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ সম্মেলনকে ঘিরে সদস্যভূক্তদেশ ছাড়াও তৃতীয় বিশে^র দেশসমূহও আগ্রহ সহকারে অনেক আশায় বুক বেধেছে। কারণ জি-২০ দেশসমূহ তাদের নিজ নিজ দেশের অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ, পারস্পরিক হিংসা বিদ্দেষের উর্ধ্বে ওঠে অস্ত্রমুক্ত বিশ^ গড়ার অঙ্গীকার এবং অর্থনৈতিক, বহু পাক্ষিক বাণিজ্যিক ব্যবস্থা, সামাজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি কল্পে সংকল্প ব্যক্ত হয়।

জি-২০-এর সদস্যসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নেতা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথি দেশ এবং ১৪টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানসহ বিশে^র প্রায়  ১৪০টি দেশ জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেয়। জি-২০ এর সদস্য দেশের মধ্যে রয়েছে-আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, কোরিয়া, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সম্মেলনে অংশ নেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির মতো পরিচিত রাষ্ট্রনেতারা। সম্মেলন চলাকালে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্মেলনের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি লিখেছিলেন, অনৈক্য উপেক্ষা করে একতা বজায় থাকবে এমন একটি পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে ভারত বিভেদ, বাধা দূর করে সহযোগিতার বীজ বপনে বদ্ধপরিকর এবং এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে ভারত শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌঁছাবে আর বিশ্বের কেউই পেছনে পড়ে থাকবে না। এতে ভৌগোলিক সীমানা, ভাষা এবং মতাদর্শকে ছাড়িয়ে ভারত এবার জি-২০ সম্মেলনের মাধ্যমে মানবকেন্দ্রিক অগ্রগতির আহ্বান জানানো হয়।

সম্মেলনে পর্যবেক্ষক দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রথমেই ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জি-২০র সদস্য না হলেও দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দুই দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। নাইজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা টিনুবুও যোগ দেন ‘আমন্ত্রিত’ হিসেবে। এই তালিকায় আরো ছিলেন  নেদারল্যান্ডসের মার্ক রট, মিসরের আবদেল ফাতা, মরিশাসের প্রবীন্দ জগন্নাথ, ওমানের হাইতাম বিন তারিক, সিঙ্গাপুরের লি সেইন লং, কমোরোসের অসুমনি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মোহাম্মদ বিন জায়েদের মতো রাষ্ট্রনেতারাও।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করার ও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। শীর্ষ সম্মেলনে তার চার দফা সুপারিশে এই আহ্বান জানান তিনি। সম্মেলনে তিনি ‘ওয়ান আর্থ’ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় তার সুপারিশের প্রথম পয়েন্টে বলেছেন, ‘এখানে জি-২০ এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ও বাংলাদেশ সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সুপারিশ তৈরি করতে তাদের প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। দ্বিতীয় পয়েন্টে  তিনি বলেন, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে এবং সারাবিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী সাহসী, দৃঢ় এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিত। তৃতীয়ত, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সদস্য হিসেবে জলবায়ুজনিত অভিবাসন মোকাবিলায় অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চালু করার অনুরোধ জানান। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, সব মানুষেরই উপযুক্ত জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকা উচিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক সম্প্রদায় ভুলবেন না এবং তাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রদত্ত একটি বক্তব্য সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। তিনি তার বক্তব্যে  ভারতকে ‘গ্লোবাল সাউথের নেতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর আগে তার দেশ ‘গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। গত আগস্টে ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকায় জানিয়েছিলেন তার লক্ষ্য ‘গ্লোবাল সাউথের এজেন্ডাকে অগ্রসর করা’। এই প্রথমবারের মতো ভারত এত শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতাদের আতিথেয়তার সুযোগ পেয়েছে। ভারতের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানের থিম রাখা হয়েছে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’। অর্থাৎ, গোটা বিশ্বই হলো একটি পরিবার। এবারের জি-২০ সম্মেলনে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরো বেশি ঋণ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট সিস্টেমের উন্নতি এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির নিয়মগুলো নিয়েও আলোচনার হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব নিয়েও আলোচনা হয়েছে সাইড লাইনে। প্রত্যাশা জি-২০ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও সকল সদস্যভূক্ত দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন তাহলে স্বার্থক হবে এ সম্মেলন।

মোতাহার হোসেন : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
 
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
হাইকোর্টে মির্জা ফখরুলের জামিন আবেদন
সাগরে ঘূর্ণিঝড় ‘মিগজাউম’, বন্দরে ২ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত
গাজীপুরে রডবোঝাই ট্রাকে আগুন, চালক দগ্ধ
পাকিস্তানে যাত্রীবাহী বাসে বন্দুকধারীদের হামলা, নিহত ৮
কাকরাইল-শান্তিনগরে রিজভীর নেতৃত্বে মিছিল
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
উপচে পড়া দর্শকে অনুষ্ঠিত হলো ‘বিজয়ের উল্লাস’
জামালপুরে পুলিশ ভ্যানে ট্রেনের ধাক্কা, পুলিশ সদস্যের মৃত্যু
মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে ২৯টি দল
টাঙ্গাইলের দুই নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
ফের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ জাতিসংঘের
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft