দিনে দিনে সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। এটি আরোপিত ভাবে নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ছিল এক সময়ে এ অঞ্চলে। কিন্তু সেই কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবা খাতমুখী হয়েছে আমাদের অর্থনীতি। উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটে চলা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন সাহায্যগ্রহীতা নয়, সাহায্য দাতার কাতারে উঠে এসেছে। মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে এখন চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটল বাংলাদেশের। এটিকে বাংলাদেশের ‘ঐতিহাসিক অর্জন’ বলা যায়, এই অর্জন বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার এক মহান মাইলফলক। করোনা মহামারী ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও থেমে থাকেনি দেশের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত আট মেগা প্রকল্পের কাজ। ইতোমধ্যে মেগা প্রকল্পের কয়েকটি উদ্বোধন করা হয়েছে, বাকিগুলোও একে একে বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ গুরুত্বও পাচ্ছে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন। কাজ এগিয়ে নিতে সবসময় নজর রাখছে সরকার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও মেগা প্রকল্পগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আট মেগা প্রকল্পে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত গড় ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭২ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর আগস্ট মাস পর্যন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আট মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ আট হাজার ৬৮১ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। শুরু থেকে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত এসব প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হয়েছে দুই লাখ সাত হাজার ৯২৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি খরচ করা হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে। এই প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৩০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জনকল্যাণে নেওয়া এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে যাতে জনভোগান্তি না হয় সেজন্য সরকার প্রধানের নির্দেশনা রয়েছে। সরকার অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। কারণ, ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বিদেশি ঋণ জড়িত। এ কারণে মেয়াদ বাড়লে খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার ঋণগুলো সময়মতো কাজে লাগাতে চায়। মেগা প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল জনগণের কল্যাণে। এগুলো বাস্তবায়নও হচ্ছে বড় আকারে। বড় পরিসরে কাজ করতে গেলে জনগণের ভোগান্তিও হয়। এসব কারণে বড় প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেসব কারণে মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ নজরও রয়েছে। অগ্রগতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। নিয়মিত পরিদর্শন করা হচ্ছে। যাতে বাস্তবায়নে কোনো রকম বাধাগ্রস্ত না হয় এবং দ্রুততম সময়ে শেষ হয়। মেগা প্রকল্পগুলো হলো পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ এবং দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মায়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প।
পদ্মা সেতু : গত বছরের ২৫ জুন উদ্বাধন করা হয় পদ্মা সেতু প্রকল্পের। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়নি। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ২৯৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৮৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। পুরো প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে মোট ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
মেট্রোরেল : বহুল প্রত্যাশিত মেট্রোরেল প্রকল্পের উত্তরা-আগারগাঁও অংশ গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর থেকে নির্ধারিত সময়ে জনগণের চলাচলের জন্য খুলে গেছে এ অংশটি। কিন্তু পুরো প্রকল্প শেষ হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আগামী ২০ অক্টোবর মতিঝিল পর্যন্ত খুলে দেওয়া হবে। আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ২২ হাজার ৮১৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া ভৌত অগ্রগতি ৯০ দশমিক ১২ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মূল ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। সংশোধিত ব্যয়সহ এটির মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বাড়তি অংশ যোগ হওয়ায় এই ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে মেয়াদ বেড়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প : দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৩০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫৮ দশমিক ২১ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি ৬০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা আছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ রূপপুর প্রকল্পটি উৎপাদনে আসতে পারে।
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ : পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৯৩৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮২ শতাংশ। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে মোট ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র : মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম (১২টি প্রকল্পযুক্ত) প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। সার্বিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৮ শতাংশে।
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প : এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯০ দশমিক ২০ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর : এ প্রকল্পটি ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৭৫২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ভৌত অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯০ দশমিক ১২ শতাংশে।
দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ : ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দোহাজারী-রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু-মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আগস্ট পর্যন্ত খরচ হয়েছে আট হাজার ৮৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এছাড়া ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৮ শতাংশ।
তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এর মধ্যে প্রস্তুতিও শুরু করেছে সরকার। এলডিসি থেকে বের হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্রেডিট রেটিং আগের চেয়ে বাড়বে এবং এখনকার চেয়ে কম সুদে ঋণ পাওয়া যেতে পারে। আর্থিক বাজারের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে আরও ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে। অন্যদিকে, চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, এলডিসি হিসেবে পাওয়া শুল্ক্কমুক্ত ও বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। এর ফলে রপ্তানি বিশেষত, তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে, কৃষিতে ভর্তুকি সুবিধা সীমিত করতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নে প্রাধিকার থাকবে না। ওষুধ শিল্প পেটেন্ট-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান থেকে এত দিন যে অব্যাহতি পেয়ে আসছে, তা থাকবে না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক নীতিগুলো পালন করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে বাংলাদেশকে একটি উত্তরণ কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
সরকারের নেয়া নানা অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হলে বিদেশী বিনিয়োগও বাড়বে। তখন পণ্য পরিবহন, বন্দরের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। এ সব কিছুকে বিবেচনা করে আগামী দশকে অর্থনীতির চাহিদার সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে। ভিশন-২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা খ্যাত ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়নের কাজ পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে চলছে। মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে দ্রুত এর কাজ এগিয়ে নেওয়া এবং ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এর সমন্বয় করা প্রয়োজন। এ মহা পরিকল্পনার প্রথম ধাপের কাজ ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ করা হবে। আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরে দেশের অর্থনীতি সার্বিকভাবে সম্প্রসারিত হবে। আগামী পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো হয়ে যাবে। এ সুযোগকে এগিয়ে নিতে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাশাপাশি ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সেটি দেশের অর্থনীতি এবং দেশের মানুষের আর্থিক ক্ষমতা বদলে দেবে।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ