
যাচাই-বাছাই ছাড়াই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্বাচনী এলাকার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে এমপিওভুক্তি করা হয়েছে সম্প্রতি। এ খবরে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের চাপে ৯১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে এমপিওভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য কয়েক দিন আগে তার কার্যালয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত মার্চে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য শতাধিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠানো হলেও তিনি অনুমতি দেননি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের নির্বাচনী উপহার হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ এর কোনো শর্তই মানা হয়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে এ তালিকায় কারিগরি ও মাদ্রাসা নেই বলে মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এমপিও যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. রবিউল ইসলাম আজকালের খবরকে বলেন, ৯১টি প্রতিষ্ঠান বিশেষভাবে এমপিওভুক্তির জন্য তালিকা করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য দুই-তিন আগে পাঠানো হয়েছে। কোন্ যোগ্যতারভিত্তিতে তালিকা করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই তালিকা করা হয়েছে। তবে অবশ্যই এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী কমিটি যাচাই-বাছাই করে তালিকা চূড়ান্ত করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ৬ জুলাই শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের অধীনে দুই হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। শর্তপূরণ না হওয়ায় সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের নির্বাচনী এলাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য গত নির্বাচনে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনের আগে এমপিওভুক্ত করা না হলে ভোটে প্রভাব পড়বে। এসব যুক্তি দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেছেন তারা। ইতিবাচক সম্মতি পাওয়ার পর অনেক মন্ত্রী ও এমপি ডিও লেটার ( বেসরকারি পত্র) দিয়েছেন। প্রথমে এ সংখ্যা ছিলো ৩৩টি। ধাপে ধাপে তা বেড়ে হয়েছে ৯১টি। এরমধ্যে নিম্নমাধ্যমিক ৩২টি, মাধ্যমিক ১৫টি, উচ্চমাধ্যমিক ১২টি, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ২০টি এবং ডিগ্রি পর্যায়ে ছয়টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সর্বশেষ যুক্ত হওয়া আটটি প্রতিষ্ঠানের ধরণ জানা যায়নি। এগুলো এমপিওভুক্ত করতে সরকারের বর্ষিক খরচ হবে ৩২ কোটি ৪৫ লাখ ১৭ হাজার ৯১০ টাকা।
এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত করা হয়। ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর), পরীক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর) এবং পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার (৪০ নম্বর)। তবে এ নীতিমালার ২২ ধারায় বিশেষ ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে এমপিওভুক্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষায় অনগ্রসর, ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি এলাকা, হাওর-বাওড়, চরাঞ্চল, ছিটমহল, বস্তি এলাকা, নারী শিক্ষা, সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠী (প্রতিবন্ধী, হরিজন, সেবক, চা-বাগান শ্রমিক, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি) এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, চারুকলা, বিকেএসপি, সংস্থা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় শর্ত শিথিলযোগ্য। কিন্তু এমপিওভুক্তির জন্য চূড়ান্ত করা ৯১টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষ শর্তও মানা হয়নি। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনদের নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে গত বছরের ২১ জুলাই পর্যন্ত এমপিওভুক্ত করার জন্য অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয়। তখন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে (স্কুল ও কলেজ) চার হাজার ৬২১টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এর মধ্যে এক হাজার ৯৪১টি প্রতিষ্ঠান সকল সূচকে যোগ্যতা অর্জন করে। আর কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে দুই হাজার ৫৪৪টি (মাদ্রাসা ও কারিগরি) প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করে। এরমধ্যে মাত্র ২৯৫টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও ৩৫৩টি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। দফায় দফায় যাচাই করে গত বছরের ৬ জুলাই শিক্ষামন্ত্রণালয় দুই বিভাগের অধীনে দুই হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। তখন অভিযোগ ওঠে অনেক যোগ্যপ্রতিষ্ঠান বাদ দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ এর ১৬ ধারার চার উপধারা অনুযায়ী আপিলকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের জন্য আবেদন চাওয়া হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে এক হাজার ৯১৬টি আবেদন জমা পড়ে। আর কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের অধীনে মাদ্রাসা ও কারিগরি পর্যায়ের প্রায় এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আপিল করে। আপিল নিষ্পত্তি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গত ১২ জানুয়ারি আরো ২৫৫টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে পাঁচটি ডিগ্রি কলেজ, ২৭টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, ২২টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৮১টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পাশাপাশি ৩৩টি মাদ্রাসা, ১৭টি এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাতটি এইচএসসি বিএমটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এখনো সবাই বেতন-ভাতা পাননি।
নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, বহু বছর ধরে পাঠদানের স্বীকৃতপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় অনেক শিক্ষক অবসরে চলে গেছেন, মারা গেছেন, বেতন না পেয়ে হাজার-হাজার শিক্ষক পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিলো প্রতি বছর এমপিওভুক্ত করা। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে তা হচ্ছে না। বরং এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত গেছে। এ অবস্থায় বিশেষ বিবেচনায় এমপিও ঘোষণা নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য ও অমানবিক আচরণ করা হবে। সরকারের উচিত মানবিক হয়ে সকল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এমপিও ঘোষণা করা।
আজকালের খবর/ওআর