রবিবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
কারাম উৎসবে নেচে-গেয়ে মঙ্গল প্রার্থনা
ফরহাদুজ্জামান ফারুক, রংপুর
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৭:০০ PM
সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে বাজতে থাকে ঢাকঢোল আর মাদল। সঙ্গে ডুগডুগি, খঞ্জনি আর কাঁসর। কারামগাছকে ঘিরে পূজা-অর্চনায় হেলে দুলে নেচে-গেয়ে শুরু হয় উৎসব। প্রতি বছর এভাবেই ভাদ্র মাসের একাদশীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা উদযাপন করেন তাদের ধর্মীয় উৎসব ‘কারাম’। নিজস্ব সংস্কৃতির রেশে শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ নানান বয়সী মানুষ নেচে-গেয়ে মেতে ওঠেন এই উৎসবে।

বছরের পর বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব পালন করে আসছেন রংপুর নগরীর ওরাঁও সম্প্রদায়ের মানুষেরা। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় নগরীর শেখপাড়ার আদিবাসী পল্লীতে পালন করা হয় ১৭৩তম কারাম পূজা ও সামাজিক এ উৎসবটি। নেচে-গেয়ে আর কেজ্জায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা কারাম উৎসবের মাধ্যমে বিপদ থেকে মুক্তি, অতিবন্যা ও খরা থেকে বাঁচতে দেশ ও মানুষের মঙ্গল কামনা করেন। উৎসবটি দেখার জন্য ওরাঁও সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও সমবেত হন আদিবাসী পল্লীতে।

কারাম মূলত একটি বৃক্ষ। বাংলা বছরের ভাদ্র মাস এলেই এই বৃক্ষের ডাল নিয়ে একটি নির্ধারিত স্থানে পুঁতে রেখে সেখানে দুধ ছিটিয়ে জ্বালানো হয় ধূপ। পুঁতে রাখা কারামের ডাল ঘিরে চলে নৃত্যযোগে ধর্মীয় কেজ্জাপঠন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপদ থেকে নিজ নিজ সম্প্রদায়কে রক্ষার আকুতির সঙ্গেহ দেশ ও মানুষের মঙ্গল কামনা প্রাধান্য পায় কারাম উৎসবে। এ কারণে ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবকে ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি সামাজিক উৎসব হিসেবেও গুরুত্ব দিয়ে আসছেন সমতলে থাকা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা।

শেখপাড়া আদিবাসী পল্লীতে ওরাঁও সম্প্রদায়ের একশর বেশি পরিবার রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই কৃষিকাজনির্ভর। বেশ কয়েকটি পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার আলোয় নিজেদের জীবন বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ সচেতনতার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছেন। তবে এই পল্লীতে নিম্নআয়ের পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে উৎসবের দিনেও কখনো কখনো অনেকের পরনে জোটে না নতুন কাপড়। তবে আনন্দ ভাগাভাগিতে কারো কোনো কমতি নেই। যেন ছোট-বড় সববয়সী মানুষের মিলনমেলা কারাম উৎসব।

ওরাঁও সম্প্রদায়ের লোকেরা জানান, সপ্তাহখানেক আগে থেকেই চলতে থাকে পূজার প্রস্তুতি। পূজার আগের রাত থেকে শুরু হয় উপবাস। এটা শেষ হয় তিনদিন পর কারাম গাছ বিসর্জনের মধ্যদিয়ে। এ উৎসবে অনেক আনন্দ হয়ে থাকে। নিজেদের পাশাপাশি দেশের মানুষের মঙ্গল কামনা করা হয় কারাম উৎসবে। তাদের পূর্বপুরুষরা বিশ্বাস করতেন কারাম পূজার মাধ্যমে সব বিপদ-আপদ দূর হয়ে যায়, এ জন্য বংশ পরম্পরায় তারাও প্রতি বছর ঘটা করে এই উৎসবটি পালন করে আসছে।

সেখানকার উত্তর শেখপাড়ার বাসিন্দা রতন টপ্য বলেন, কারাম আমাদের সবচেয়ে বড় একটি উৎসব। এই উৎসবে আমরা অনেক আনন্দ করে থাকি। আমাদের সবার বাড়িতে মেহমান আসছে। বাড়ি বাড়ি পিঠা-পুলিসহ মজাদার খাবার তৈরি হয়। আমরা ছোট-বড় সবাই মিলে অনেক আনন্দ করে থাকি। প্রকৃতির দেবতা আমাদের বছরের পর বছর ধরে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে আসছেন, তাদের কারাম পূজার মাধ্যমে বিপদ থেকে মুক্তির প্রার্থনা করি।

আদিবাসী পল্লীতে প্রায় সাত বছর ধরে উত্তম কুমারের বসবাস। তিনি ভিন্নধর্মাবলম্বী হলেও আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যরকম সংখ্য তার। প্রতিবছরের মতো এবারো কারাম উৎসব দেখতে এসেছিলেন তিনি। তার মতো বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই উৎসবের আয়োজন দেখতে আদিবাসী পল্লীতে আসেন।

উত্তম কুমার বলেন, প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবটি এখনকার ওরাঁও সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা পালন করে আসছে। কারাম গাছের ডালকে তারা রক্ষাকবজ মনে করেন। সেজন্য কারাম গাছের পূজা-অর্চনা করে ওরাঁও সম্প্রদায়। সন্ধ্যার পর থেকে সারারাত তারা নেচে-গেয়ে আর কেজ্জাপাঠ করে থাকেন।

অভিভাবক বিলকিজ রানী বলেন, আমাদের বাচ্চারা এই উৎসবের দিনেও স্কুল-কলেজে যায়, কারণ তাদের ছুটি নেই। আমরা মনে করি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মতো আমাদেরও ধর্মীয় উৎসব পালনে এই দিনটিতে বাচ্চাদের ছুটি থাকা প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের এখন থেকে এসব উৎসবের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে না দিতে পারি, তাহলে এটা একসময় বিলুপ্ত হতে পারে। এজন্য আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি উদ্যোগে পাঠপুস্তকে কারাম উৎসব অন্যান্য উৎসবের কথা তুলে আনা উচিত।

স্থানীয় শিক্ষার্থী চন্দনা ধানোয়ার বলেন, কারাম উৎসব আয়োজন নিছক বিনোদনের জন্য করা হয় না। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের পাশাপাশি আমাদের মতো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার বিশেষ উদ্যোগ এই উৎসব। আগে ছোট আকারে কারাম উৎসব হলেও এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক পরিসরে এটি হয়ে আসছে। এই দিনে আমরা ভীষণ আনন্দ করি।

আদিবাসী পল্লীর হিরোয়াশি জেএসসি ফুকুই বৌদ্ধবিহার সভাপতি রুবেল ধানোয়ার বলেন, এটি ১৭৩তম কারাম উৎসব। আদি সময় থেকে যারা আমরা ওরাঁও আদিবাসী তারা এ কারাম পূজাটি পালন করে আসছি। কারাম বৃক্ষকে পূজা করার মাধ্যমে আমরা মনে করি আমাদের সব বিপদ-আপদ দূর হয়ে যাবে। দেশের মানুষের মঙ্গল হবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এ আয়োজনকে আরো ভালো করে করার জন্য। তবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে আমরা ভালোভাবে এ উৎসবটি পালন করতে পারবো।

রংপুর জেলা আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সভাপতি টিউলিপ এক্কা বলেন, কারাম উৎসব সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রাণের উৎসব। ওরাঁও, সাঁওতাল, মুন্ডা, পাহান, মালো, মাতোসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব কারাম উদযাপন করা। আমরা নিজস্ব সংস্কৃতি ও গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে আনন্দ করি। পরের দিন কারাম গাছের ডালটি পুকুরে নয়তো নদীতে বিসর্জন দেওয়ার মধ্যদিয়ে আমাদের উৎসব শেষ হয়ে থাকে।

তিনি আরো বলেন, সরকার আমাদের মতো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের জীবনমানের উন্নয়নে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমরা সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া অনুভব করছি। আমরা চাই এই উৎসবের দিনে আমাদের জন্য সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক। একই সঙ্গে আমাদের আদিবাসীর স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। 

ওরাঁও সম্প্রদায়ের ১৭৩তম এই কারাম উৎসবে প্রতি বছরের মতো এবারো সহযোগিতা করেছেন জানিয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামছুল হক বলেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের কারাম পূজাটি ঐতিহ্যবাহী বড় একটি উৎসব। প্রতি বছরে তারা নানা আয়োজনে এ উৎসবটি পালন করে থাকেন। তাদের সব আয়োজনে আমি পাশে থেকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে আসছি। এ ধরনের সামাজিক ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব আমরা উপভোগ করি এবং আমার খুব ভালো লাগে।

আজকালের খবর/ওআর








সর্বশেষ সংবাদ
রাশিয়ার ‘বন্ধু ও নিরপেক্ষ’ তালিকায় বাংলাদেশের নাম
কবি নজরুলের মাজারে প্রনস নির্বাহী কমিটির শ্রদ্ধা
‘মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগের ফলে বিএনপিই বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে’
ভিসানীতি-নিষেধাজ্ঞা পরোয়া করে না আওয়ামী লীগ: কাদের
বোমা বিস্ফোরণে সোমালিয়ার সেনাসহ নিহত ১০
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বাউফল রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন
লেখক সম্মাননা দেবে ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল
ফরিদপুরে মুরগীর ট্রাকে ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার চার
পঞ্চগড় জেলা বাপার সভাপতি খায়ের, সম্পাদক জুয়েল
কিশোরগঞ্জে আব্দুর রশিদ ল’ কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সনদ বিতরণ
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft