শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা
অধ্যাপক না হয়েই অবসরে যাচ্ছেন
নূরুজ্জামান মামুন
প্রকাশ: শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৭:২৮ PM আপডেট: ১৭.০৯.২০২৩ ৪:০৪ PM
জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পদে পদোন্নতি পান না। স্বল্প কিছু তৃতীয় গ্রেড পেলেও শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা চরমে পৌঁছেছে। সম্প্রতি ২৪তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব তথা গ্রেড-৩ এ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আর ১৬তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের বহু কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হয়ে পঞ্চম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। তারা পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করার পরও অধ্যাপক না হয়েই অনেকে অবসরে যাচ্ছেন। এর আগে শিক্ষা ক্যাডারে এতটা পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন।    

জানতে চাইলে ১৬তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব ও ডিআইএ’র উপপরিচালক সহযোগী অধ্যাপক রেহেনা খাতুন আজকালের খবরকে বলেন, আমাদের ব্যাচের এখনো ৩৫৮ জন সহেযাগী অধ্যাপক পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে পঞ্চম গ্রেডে রয়ে গেছেন। আমাদের ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডারের ২৫ জন এরই মধ্যে অধ্যাপক না হয়ে অবসরে গেছেন। একজন ক্যাডার কর্মকর্তার জন্য এটা কতটা হতাশার, কষ্টের- তা শুধু বঞ্চিতরাই উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, শিক্ষা ক্যাডারে এর আগে এতটা পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। অবসরে যাওয়ার একদিন আগেও ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।   

রেহেনা খাতুনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, শিক্ষা ক্যাডারে দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া না হলে ১৬তম ব্যাচের ৫৬ জন অধ্যাপক না হয়ে ডিসেম্বরে অবসরে যাবেন। আরো ১২৭ জন অধ্যাপক না হয়ে আগামী বছর অবসরে যাবেন। শুধু ১৬তম ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারাই পদোন্নতি বঞ্চিত নয়, যোগ্যতা অর্জন করে আরো ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির তথ্যানুযায়ী, শিক্ষা ক্যাডারের এন্ট্রি পদ (প্রবেশ) প্রভাষক। এরপর সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক সর্বোচ্চ পদ। এই তিন স্তরে বিসিএস ১৬তম ব্যাচ থেকে ৩৫তম ব্যাচ পর্যন্ত ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা পদোন্নতির সকল যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এসব কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে সরকারের বাড়তি অর্থ খরচ হবে না। কারণ এরই মধ্যে তারা পদোন্নতি দেওয়া হলে যে বেতন পাবেন বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট পেয়ে তা ভোগ করছেন। 

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি নেতারা জানান, গত মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ৩১ আগস্টের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানান। এ সময়ের মধ্যে পদোন্নতি না দিলে আন্দোলনে যাওয়ার আল্টিমেটাম দেন। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি ব্যানারে ছয়দফা দাবি বাস্তবায়নে গত বৃহস্পতিবার শিক্ষা ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। দাবিগুলো হলো- যোগ্য সব কর্মকর্তার পদোন্নতি, পদসৃজন, স্কেল আপগ্রেডেশন, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন, ক্যাডার কম্পোজিশনের সুরক্ষা, শিক্ষা ক্যাডারবহির্ভূতদের প্রত্যাহার। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করা না হলে সারা দেশের সরকারি কলেজে অবস্থান কর্মসূচি পালন ও কলেজ তালা দিয়ে ক্লাস বর্জনের কথা ভাবছে সমিতির নেতারা।  

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান বলেন, পদোন্নতি দিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুই দফা বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) সভা করেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়া হবে। শিক্ষকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্যাডারের সার্ভিস রুল অনুযায়ী তাদের আন্দোলন করার সুযোগ নেই।   

বিসিএস ক্যাডারে সংখ্যার দিক দিয়ে শিক্ষা ক্যাডার শীর্ষে। বর্তমানে এই ক্যাডারে পদ আছে প্রায় ১৬ হাজার। এর মধ্যে কর্মরত রয়েছেন সাড়ে ১৩ হাজারের বেশি কর্মকর্তা। গত মার্চ মাসে ১৪তম বিসিএসের বেশিরভাগ কর্মকর্তা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ১৬তম ব্যাচের কিছু কর্মকর্তা অধ্যাপক হলেও ৩৫৮ জন বঞ্চিত। ২০তম ব্যাচের সহযোগী অধ্যাপকরাও অনেক আগে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সব মিলিয়ে বর্তমানে হাজারের বেশি সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতি বঞ্চিত।  ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য তিন হাজার শিক্ষক রয়েছেন। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ৩৫তম বিসিএস ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার। চলতি মাসে ৩৬তম ব্যাচ  প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য হয়েছে। এই ব্যাচসহ এ সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। প্রভাষক পর্যায়ে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা টানা নয় থেকে ১১ বছর পদোন্নতি বঞ্চিত। 

সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতিযোগ্য সকল কর্মকর্তার পদোন্নতি দিলে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হবে ৮৮ লাখ টাকা। কারণ, দীর্ঘদিন পদোন্নতি আটকে থাকায় বেশির ভাগ কর্মকর্তার মূল বেতন এখন পরের পদোন্নতি গ্রেডের সমান বা বেশি হয়ে গেছে। পদোন্নতি দিলেও সরকারের ব্যয় তেমন বাড়বে না। 

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একজন সহকারী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১১ বছর ধরে পদোন্নতি পাচ্ছি না। আমাকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিলে মাত্র ২৪৫ টাকা বাড়তি খরচ হবে। তারপরও পদোন্নতি মিলছে না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের পদের চেয়ে দুই-তিনগুণ বেশি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আর আমরা যোগ্যতা অর্জন করার পরও পদোন্নতি মিলছে না। এই কষ্টে অনেকেই চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।  

২৪তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও এনসিটিবির উপসচিব সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান (লিখন) বলেন, ২০১৫ সালে আমাদের ব্যাচের এক হাজার ১৬৫ জন সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সকল যোগ্যতা অর্জ করেছেন। সবাইকে পদোন্নতি দিলে সরকারের বাড়তি এক টাকাও খরচ হবে না। বরং পদোন্নতি দিলে সবাই নতুন উদ্যমে, খুশি মনে আনন্দের সঙ্গে কাজ করবে। দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা হতাশায় ভুগছেন। সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন। 

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি ও মাউশির পরিচালক ( কলেজ-প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি ও পদসৃজন-দুটিই বঞ্চিত। কলেজভিত্তিক পদসৃষ্টি হলে সাড়ে ১২ হাজার পদ সৃষ্টি হতো। কিন্তু নয় বছর ধরে তা বন্ধ। একদিকে পদ সৃজন নেই, অন্যদিকে যোগ্য হওয়ার পরও পদোন্নতি হচ্ছে না। এতে পদোন্নতি জট দিন দিন বাড়ছে, ক্যাডারের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থায় সংবাদ সম্মেলন, অবস্থান কর্মসূচি করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এরপর দাবি মানলে আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।

ডিপিসি করেও আটকে গেছে পদোন্নতি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডিপিসি’র সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য এক হাজার ৪৫১ জন (২৪তম-২৬তম ব্যাচ) কর্মকর্তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তবে পদোন্নতিযোগ্য (জ্যেষ্ঠতার ক্রমিকে পিছিয়ে) এক হাজার ৩৮৬ জন কর্মকর্তা বাদ পড়েছেন। এরপর গত ১০ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ডিপিসি’র সভায় সংক্ষিপ্ত তালিকার প্রস্তাবও বাতিল করা হয়েছে। 

সূত্র জানিয়েছে, ডিপিসি কমিটির সভাপতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বলছেন, সহযোগী অধ্যাপক পদ যতগুলো শূন্য আছে সমান সংখ্যক পদোন্নতি দিতে। সচিবের এই সিদ্ধান্তের কারণে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আটকে গেছে। এই জট না খুললে অন্য পদের পদোন্নতি হচ্ছে না। আগামী মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অথচ এসব শিক্ষকরাই ভোট নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। 

জানতে চাইলে ডিপিসি কমিটির সদস্য ও মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ বলেন, সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। মন্ত্রণালয় এটি চূড়ান্ত করবে। তবে আমাদের দাবি শূন্যপদ নয়, শতভাগ পদোন্নতিযোগ্য সবাইকে পদোন্নতি দেওয়ার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালের জুনে সর্বশেষ সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে এক হাজার ৪৭৯ জন প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অথচ প্রশাসন, পুলিশ ক্যাডারে বছরের দুটি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। শূন্য তো দূরের কথা, পদের চেয়ে তিনগুণ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডারে প্রতি বছর পদোন্নতি দেওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরেরও পদোন্নতি দেওয়া হয় না। শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাচের পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির কারণে বঞ্চনার ঘটনা বেশি ঘটছে। 

শিক্ষকদের অভিযোগ, ডা. দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি জট বেড়েছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময় প্রতি বছরই সকল পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তখন বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদ ছাড়াও শতাংশ হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় গড়ে ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য অবসরে যাওয়ার আগের দিন বিশেষ ডিপিসি করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দীপু মনি পদোন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানার জন্য চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। 

আজকালের খবর/ওআর








সর্বশেষ সংবাদ
মার্কিন শ্রমনীতি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করতে পারে: পররাষ্ট্র সচিব
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা-হয়রানি
একদিনে দশটি পথসভা, উঠান বৈঠক ও একটি জনসভা করেন সাজ্জাদুল হাসান এমপি
নতুন বছরে সুদহার বাড়ছে
শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেই আজকের উন্নত বাংলাদেশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রাজপথের আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: মুরাদ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকায় ইসলামী ব্যাংক
ইতিহাসের মহানায়ক: একটি অনন্য প্রকাশনা
নতুন বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
এক দিনে সারাদেশে ২১ নেতাকে বহিষ্কার করল বিএনপি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft