বুধবার ৪ অক্টোবর ২০২৩
চিরকালীন প্রেরণার উৎস কবি নজরুল
রণজিৎ মোদক
প্রকাশ: শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৩:২৯ PM
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো/তবু আমাকে দিবো না ভুলিতে।’ মুসলমানেরা বলছেন, কাফের আর হিন্দুরা যবন বলে যাকে ধিক্কার দিত, তিনি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা কাব্যে ধূমকেতুর মতোই তার আবির্ভাব। পচন ধরা প্রথাগত সমাজ চক্র ভেঙেচুরে এক নতুন সমাজ নির্মাণ করাই তার স্বপ্ন ছিল। যেখানে অনাচার, যেখানে অবিচার সেইখানেই সকল অন্যায়, অসত্য, শোষণ-নির্যাতন আর দুঃখ-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ছিলেন কাজী নজরুল। তিনি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং পরাধীনতার গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করতে বজ্রকঠিন হাতে কলম ধরেছিলেন। কবিতা লেখার জন্য কবি কারারুদ্ধ হন। বন্দি করেও থামানো যায়নি তার লেখা। দুঃখ দারিদ্র্য এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে তার জীবন। বিদ্রোহ ও তারুণ্যের কবি, এক কথায় সাম্যবাদের কবি মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

যারা তাকে ঘৃণা করেছে তিনি তাদেরকেই বেশি ভালোবেসেছেন। চরম আর্থিক অনটন আর দুঃখ দারিদ্র্যের মধ্যেই তার বাল্যকাল কেটেছে। তাই দুঃখ দরিদ্রতার কষ্ট তিনি হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছেন। প্রতিটি দুঃখী মানুষের প্রতি তার হৃদয় ভরা প্রেম লক্ষ করা গেছে। ‘কুলি’ কবিতায় কবির হৃদয় নিংড়ানো প্রেম ফুটে উঠেছে। তিনি তার ‘মানুষ’ কবিতায় মানুষকে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান।’

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ, ভারতের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায়। পিতা কাজী ফকির আহমদ, মাতা জাহেদা খাতুন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। নজরুলের জন্মের পূর্বে তার একাধিক ভাইবোন মারা যায়। দুঃখের মাঝে জন্ম বিধায় তার নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। যদিও তিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু তার বাল্যকাল কাটে বাংলাদেশের ত্রিশালে। কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল এখনো কবির স্মৃতি ধরে রেখেছে। যে বটগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাতেন সেই বটগাছটি তেমনই রয়েছে। দরিরামপুর স্কুল নজরুলের কথাই বলছে।

খুব অল্প বয়সেই তার মধ্যে কবিত্ব ভাব ফুটে ওঠে। তিনি মুখে মুখে ছন্দ মিলিয়ে পদ্য রচনা করতে পারতেন। স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম তার ভালো লাগেনি। গ্রামের লেটোর দলে যোগ দিয়ে গান গেয়েছেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে মহকুমা শহর আসানসোলে গিয়ে রুটির দোকানে চাকরি নেন। আসানসোলের দারোগা কাজী রফিজউল্লাহ নিজ বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখান থেকে গ্রামে গিয়ে শিয়ারশোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন। নজরুল তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। ১৯১৪ সাল স্কুল থেকে পালিয়ে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। নিজ দক্ষতার গুণে অল্প দিনের মধ্যে নজরুল হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সেনাশিবিরে ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সাহিত্যচর্চা চালিয়ে যান। কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠান। তার প্রথম লেখা ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ একটি গল্প এবং প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ ও তার বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হলে নজরুলের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছিল, ঠিক তখনই এসব লেখা প্রকাশিত হওয়ায় পরাধীন জাতির প্রাণে আগুন প্রজ¦লিত হতে থাকে। ‘আগমনী’ শিরোনামে কবিতাটি দুর্গা মায়ের বর্ণনা থাকলেও বজ্রের আঘাতের ন্যায় ব্রিটিশের বুকে বিদ্ধ হতে থাকে। কবির ওপর নেমে আসে নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচার। কবিকে বন্দি করে ব্রিটিশ সরকার। কারাগারে রেখেও দমাতে পাড়েনি। কবি গেয়ে উঠলেন, ‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত’।

নজরুলের কথায় নিপীড়িত মানুষের কথাই ধ্বনিত হয়েছে। কবির বাউণ্ডেলে জীবনে বহু আলোর বিচ্ছুরণ লক্ষ করা গেছে। তিনি শ্যামা সংগীত লিখে জগৎ মাতার কৃপা লাভ করেন। এ সমস্ত শ্যামা সংগীত, ভজন কীর্তন লিখে মুসলমান সমাজের কাছে কাফের বলে ধিক্কৃত হন। তারপর একজন মুসলমান হয়ে হিন্দুর মেয়ে প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করে আলোচিত সমালোচিতের রোষানলে পতিত হন। অথচ এই প্রমীলাই কবির জীবনে কাব্য প্রেরণার উৎস রূপে ছিলেন। জাত পাত নজরুলকে ঘায়েল করতে পারেনি। তিনি তার কবিতায় গেয়ে উঠলেন, একই মায়ের আমরা দু’টি সন্তান হিন্দু মুসলমান। কবি যদিও কুমিল্লাতে নার্গিস নামে এক বিদুষীকে বিয়ে করেন কিন্তু বাসর রাতেই কবি সেখানে থেকে চলে যান। মুক্ত পাখিকে যে কেউ জোর করে খাঁচায় বন্দি করে রাখতে পারে না। কবিরা স্রষ্টার মুক্ত পাখি।

আজ প্রমত্তা পদ্মার বুকে স্বপের সেতু বাঙালির অহংকারের গর্বের সৃষ্টি। এই পদ্মার বুকে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার কোকিল কণ্ঠী আব্বাস উদ্দীন ও তার ছোট মেয়ে ফেরদৌসী ঢাকায় আসতে ছিলেন। আব্বাস উদ্দীন বললেন, কাজীদা আপনি হিন্দুদের নিয়ে অনেক গান লিখেছেন এবার মুসলমানদের জন্য কিছু লিখুন। মুসলমান সমাজ আপানকে কাফের বলে গালি দেয়। কবি বললেন, আমার স্বজাতিরাই আমাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। একদিন এরাই আমার জন্য কাঁদবে। কবি সত্যি সত্যি এক জ্যোতিষীর ন্যায় কথাগুলো বলেছিলেন। কবিরা যে ভূত ভবিষ্যতের সাক্ষী।

নৌকায় বসে কবি লিখলেন-
‘পদ্মার ঢেউরে আমার/শূন্য হৃদয় নিয়ে যা/নিয়ে যা... রে...।’

এই গানটি নৌকায় সুর করে ফেরদৌসীর কণ্ঠে তুলে দিলেন। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন ঢাকায় রেডিও সেন্টার উদ্বোধনে এ গানটি পরিবেশন করা হয়। আজ নজরুলকে ছাড়া যেন কোনো কিছুই করা যাচ্ছে না। হামদ-নাত গজল সবার হৃদয় স্পর্শ করে। কে যাও তুমি কাবার পথে...:/ দুঃখের দীনের দরদি মোর নবি কামলে আলা।/রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশি ঈদ। এসব গান গজল নজরুলকে অমরত্ব দান করেছে। সে দিনের সেই ঘৃণা আজ সম্মানের স্বর্ণ মুকুটে পরিণত হয়েছে। কবি ১৯৪২ সালে এক দুরারোগ্য মস্তিষ্কের রোগে বাক রুদ্ধ হয়ে পরেন।
পূর্বে তিনি বলে গেছেন-
‘আর আমি বন্ধু সারাদিন/কোলাহল করে তোমাদের ঘুম ভাঙ্গিব না।...’
কবির অন্তিম ইচ্ছার কথা কবি নিজেই বলে গেছেন-
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’।

১৯৭২ সালে ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তাকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। ১৯৭৬ সালে ২৯ আগস্ট ঢাকা পিজি হাসপাতাল (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) নজরুলের মৃত্যু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। সম্প্রতি ঢাকা কবিতা ক্যাফে ‘জয়বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়েছে, কবি নজরুল যে ওয়ার্ডে দেহ ত্যাগ করেছেন সেই ওয়ার্ড কবির নামে এবং অসুস্থ কবি-সাহিত্যিকদের সেবা দানে নির্ধারিত রাখা হোক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করা হয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে কাজী নজরুল আমাদের নিত্য সাথী।

আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, কবি এবং কবিতার মৃত্যু হয় না। কবি তাই তার মহাপ্রয়াণের পূর্বে গেয়ে গেছেন- ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব/তবু আমারে দেব না ভুলিতে’।

কবি জানতেন তাকে হয়তো সবাই ভুলে যাবে, কিন্তু তার লেখাকে ভুলা যাবে না। কবিতা, গান, গজল তার কথাই মনে করিয়ে দিবে। কবি মহান কর্মের কর্মী, মুক্ত স্বাধীন তাই কবিকে ভুলতে গিয়েও ভোলা যাবে না। গণমানুষের মুক্তির দিশারি চিরকাল আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
আরও কমলো সোনার দাম
বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা: বদিউল আলম মজুমদারের শ্যালক গ্রেপ্তার
ইংরেজি দৈনিক পিপল'স লাইফ উদ্বোধনে স্পিকার ও তথ্যমন্ত্রী
শিক্ষক স্বল্পতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে সোনাগাজী সরকারি পাইলট হাইস্কুল
ফেনীতে বিএনপির রোডমার্চে লক্ষাধিক লোক সমাগমের প্রস্তুতি
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ধামরাইতে আপন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা, বড় ভাই আটক
হাইস্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু ২৪ অক্টোবর
মানুষের সেবা করা একটি উত্তম ইবাদত: দয়াল বড়ুয়া
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে প্রথম ধাপের পরীক্ষা নভেম্বরে
শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে মালয়েশিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালে বাংলাদেশ
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft