
টেকসই অর্থনীতি বিশেষ করে টেকসই ব্যাকিংয়ের ওপর এখন বাংলাদেশ-সহ উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর আগ্রহ বাড়ছে। লেবানন, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শেষে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার পটভূমিতে ‘টেকসই’ ব্যাংকের দাবি প্রবলভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। ২০২০ সালে টেকসই অর্থায়ন নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর টেকসই অর্থায়ন নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবেশ অনুকূল শিল্পসহ টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে অন্য আরো ব্যাংক। এ ধরনের পরিবেশ-বান্ধব উদ্যোগে অর্থায়নের জন্য কেউ বেছে নেন কৃষি খাত, কেউ ইফালুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি), কেউ কৃষিপণ্য সরবরাহ সোপান (সাপ্লাই চেইন), কেউ বা সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রম ইত্যাদি। ব্যাংকগুলো এখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছে প্রতিটি অর্থায়ন উদ্যোগের মূল প্রতিপাদ্য হতে হবে ‘টেকসই উন্নয়ন’।
ব্যাংকের অর্থায়নে শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বর্জ্য দূষণ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং দাহ্য জ্বালানি দ্বারা কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব সহকারে ভাবনা চিন্তা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি ‘টেকসই’ শিল্প উদ্যোগে জড়িত উদ্যোক্তা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সহজ শর্তে অর্থায়ন সুবিধা বাড়ানোর জন্যও উদ্যোগী হয়ে উঠছে ব্যাংকগুলো। পরিবেশ নিয়ে সংবেদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি চলছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকব্যবস্থা পুনবির্ন্যাসের উদ্যোগ। সংশ্লিষ্ট সকল উদ্যোক্তা ও ব্যাংকগুলোর বর্ধিত সামাজিক দায় পালন (সিএসআর) কার্যক্রমকে আরো গতিশীল, লক্ষ্য-অভিমুখী এবং অর্থবহ করে তোলার প্রয়োজনবোধের বিষয়টি তো সব সময়েই সক্রিয় বিবেচনায় রাখা হয়েছে। টেকসই ব্যাংকিংয়ের ওপর দীর্ঘদিন কাজ করছে এমন একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ডিজাস্টার’ টেকসই ব্যাংকিং ‘অ্যাপ্রোচ’ বাস্তবায়নের নয়টি মূল আদর্শ সাব্যস্ত করেছে। এভাবেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দরদি, সংবেদনশীল ও মূল্যবোধভিত্তিক করে সামাজিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ এবং সামাজিক অবদান, মানবাধিকার, নারীর আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং, পরিবেশ ও সামাজিক সুশাসন, সক্ষমতা বৃদ্ধি, সহায়তামূলক অংশীদারিত্ব এবং রিপোর্টিংয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। টেকসই ‘অ্যাপ্রোচ’ শুধু আর্থিক ক্ষেত্রেই নয়- সব পর্যায়ে, সব খাতে ও ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে হবে।
টেকসই ব্যাকিং একটি নতুন ধারণা হলেও বিশ্ব পরিবেশ এবং জলবায়ুগত বিভ্রাট এবং তজ্জনিত বিপর্যয়ের আলোকে এই নতুন ‘অ্যাপ্রোচটি’ নিয়ে এখন খুব জোরেশোরে কথা চলছে। ইতোমধ্যেই এই নতুন ধারার কিছু প্রকার-প্রকরণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞাবদ্ধতাও পরিদৃশ্যমান। সবই পরিবেশ-বান্ধব অর্থায়ন সম্পর্কিত। যেমন কোথাও একে বলা হচ্ছে গ্রিন ব্যাংকিং, কোথাও বলা হচ্ছে গ্রিন ফাইন্যান্স; আবার বড় দাগের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও বিশেষ সংজ্ঞা উঠে এসেছে। এ ছাড়া ব্যাংকসমূহের নিজস্ব ‘স্কুল ব্যাংকিং’-এর অঙ্গীকার তো আছেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে ঝুঁকছে বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব কারখানা ২০০টির বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবেশবান্ধব প্রকল্প ও টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করছে।
ফলে এসব খাতে অর্থায়নও বাড়ছে। এখন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের প্রায় ১৪ শতাংশই টেকসই খাতে। টেকসই অর্থায়নের পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম শুরু করেছে। তারই অংশ হিসেবে অনেক ব্যাংক শাখা ও এটিএমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। কাগজের ব্যবহার কমিয়ে আনছে কোনো কোনো ব্যাংক। আবার টেকসই অর্থায়নের আওতায় এমন প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে, যেখানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব উদ্যোগের ফলে পরিবেশ কতটা সুরক্ষিত হচ্ছে, তার কোনো হিসাব যদিও নেই; তবে অর্থায়নের নীতি ও কৌশলের মাধ্যমে পরিবেশের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। সারা বিশ্বে পরিবেশের সুরক্ষা এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ জন্য দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন সময় এসেছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব স্থাপনা খাতে ঋণের লক্ষ্য বেঁধে দেওয়ার। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ইটকারখানাতেও ঋণ দিতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এতে সরাসরি পরিবেশের ক্ষতি ঠেকানো যাবে।
বসবাসের উপযোগী হবে এই ধরণি। টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে গত তিন বছর বছর ধরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই বা সাসটেইনেবল রেটিং বা মান প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই মান যাচাই করা হয়। সূচকগুলো হলো টেকসই অর্থায়ন সূচক, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম, পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন, টেকসই কোর ব্যাংকিং সূচক ও ব্যাংকিং সেবার পরিধি। ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংক ও চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে টেকসই রেটিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথম ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই রেটিং প্রকাশের ঘোষণা দেয়।
২০২১ সালে প্রথমবারের মতো রেটিংয়ে থাকা শীর্ষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক মোট মেয়াদি ঋণের পাঁচ শতাংশ পরিবেশবান্ধব খাতে বিতরণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। আর মোট ঋণের ২০ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে দেওয়ার জন্য বলেছে। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্পে অর্থায়ন। টেকসই অর্থায়নের মধ্যে রয়েছে পরিবেশবান্ধব খাতের অর্থায়ন। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলো টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন করে ২৫ হাজার ২৯০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের নয় দশমিক ৮৫ শতাংশ। ওই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থায়ন করে ৮৫৯ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন করে ২৬ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের নয় দশমিক ৯৪ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন বেড়ে হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে তিন হাজার ৬১৫ কোটি টাকা ঋণ পরিবেশবান্ধব খাতে, যা মোট মেয়াদি ঋণের পাঁচ দশমিক শূন্য আট শতাংশ।
কখনো খেলাপি হয়নি, পরিবেশ দূষণ করেনি-এমন গ্রাহকদেরই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই অর্থায়ন করছে। এসব ঋণগ্রহীতা কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে। জাহাজভাঙা কারখানাও পরিবেশবান্ধব হয়ে যাচ্ছে। এতে টেকসই অর্থায়ন বাড়ছে। এসব ঋণ আদায়ের হারও ভালো। কোভিড-১৯ মহামারি শুধু আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের মূলেই আঘাত করেনি, পরিবেশ নিয়ে আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব স্থাপনার বিভিন্ন নির্ণায়কের মধ্যে রয়েছে- টেকসই নির্মাণ ভূমি, জ্বালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা, পানি ব্যবহারের দক্ষতা, কর্মবান্ধব পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত মান, কারখানার অভ্যন্তরে বায়ুর মান, প্রযুক্তির ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে, যা আমাদের সবুজ বিপ্লবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরো গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
এই ‘প্রটোকল’ বা কর্ম সোপানগুলোর একটাই লক্ষ্য এবং তা হলো, পরিবেশবান্ধব অর্থায়ন এবং বিশ্বজুড়ে পরিবেশের যে অনাসৃষ্টি চলছে তাতে এটিই সাব্যস্ত হওয়া স্বাভাবিক যে, দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে হলে ‘টেকসই’ অর্থনীতি এবং টেকসই উন্নয়নের কোনোই বিকল্প নেই। একটি প্রাচীন পোলিশ প্রবাদে আছে, প্রকৃতিকে যদি পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়, প্রকৃতি তার বদলা নেয় কামান দেগে। মানুষ যেভাবে প্রকৃতির ভারসমতাকে বিনষ্ট করেছে তারই প্রতিশোধ চলছে ইউরোপে ৪৫ থেকে ৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়; শীত ও বর্ষার মধ্যেও দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে বনভূমি ও জনপদ; অস্বাভাবিক ভূকম্পন হচ্ছে; সমুদ্র উঁচু হয়ে উঠছে; মেরুতে বিশাল বিশাল বরফখণ্ড গলে গলে পড়ছে। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীলতার গুরুত্ব অনুধাবন করে ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাই যেভাবে এগিয়ে আসছে এ জন্য প্রশংসা ও অভিনন্দন দু’টিই তাদের পাওনা। কোনো কোনো ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি উদ্যোগে টেকসই উন্নয়নকে মূল প্রতিপাদ্য করে নেওয়ার সময় এসেছে। কার্বন নিঃসরণ আমাদের কমাতেই হবে। দাহ্য বর্জ্যরে আগ্রাসন কমাতে বিকল্প ও নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকতেই হবে। আগে এটি হয়তো মূল্যবোধের ব্যাপার ছিল; কিন্তু এখন এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। প্রকৃতি বাঁচলে আমরা বাঁচব। প্রকৃতি পচলে আমরাও রসাতলে যাব। ব্যাংকগুলো বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত প্ল্যান্ট কিংবা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এই গুরুত্ববোধকে আরো বাড়াতে হবে। উৎপাদন ও সরবরাহ ধারায় অর্থায়ন বা অর্থ-সংস্থানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হওয়ার কথা নয়। যেসব শিল্পে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য হলেও ব্যবস্থা (ইটিপি) নেই, সেই শিল্পে ব্যাংক অর্থায়নে অপারগ, এটা পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে। এই ধরনের পরিবেশানুকূল উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদি এবং সহজ শর্তে বিনিয়োগ করার কথা ভাবতে হবে, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো এই খাতে উৎসাহী হয়। তেমনি নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা শক্তি খাতেও সহজ শর্তে মেয়াদি বিনিয়োগের কথা ভাবতে হবে, যাতে সৌর বিদ্যুতের আরো প্রসার ঘটে এবং দেশে সৌর বিদ্যুতের প্যানেলসহ অন্য সব যন্ত্র এবং প্রযুক্তি তৈরি করার পথ সুগম করতে হবে, যাতে সৌর বিদ্যুতে মানুষের ঝোঁক এবং নির্ভরশীলতা আরো বাড়ে। ভাবতে হবে ‘উইন্ডমিলের’ কথাও। ‘পরিবেশানুকূল উদ্যোগ’ নিজেও একটি বড় খাত হয়ে উঠতে পারে। সেজন্য চাই জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা। তেল বিক্রি কমিয়ে দেওয়া বা রেশনিং প্রথা নিতান্তই একটি নেতিবাচক পদক্ষেপ। আমাদের হতে হবে পজেটিভ বা ইতিবাচক এবং ‘প্রো-অ্যাকটিভ’ পথের পথিক। বিকল্পের বিহিত করতে পারলে বৃক্ষ বিনাশও বন্ধ হবে; জীবাশ্ম-জ্বালানি বা ‘ফসিল ফুয়েলের’ ওপর এত নির্ভরশীল না হলেও চলবে। অর্থায়নের একটি দ্বার উন্মোচন করতে হবে যাতে ‘টেকসই’ অর্থায়ন কাঠামো নিজেও টিকে থাকতে পারে। বিশ্বজুড়ে জৈব বর্জ্য আজ এক বিরাট শিল্প কাঁচামাল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন দূষণ কমতে শুরু করেছে; অপরদিকে তেমনি সস্তায় বহু রূপান্তরিত উপজাত দ্রব্য উদ্ভাবিত এবং উৎপাদিত হচ্ছে। প্যাকেজিং খাত আজকের ‘নতুন বাস্তবতায়’ এক বিশাল চাহিদা সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকগুলোর উচিত হবে, উৎপাদনের পাশাপাশি উদ্ভাবন এবং গবেষণা কাজেও পৃষ্ঠপোষকতা করা। আমাদের দেশে বহু সুপ্ত মেধা গুপ্ত হয়ে পড়ে আছে। সরকার ও সমাজপতিদের উচিত হবে, সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব মেধা খুঁজে বের করা এবং প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সহায়তার মাধ্যমে তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাকে বাস্তবে নিয়ে আসতে সাহায্য করা।
অতি সম্প্রতিকাল পর্যন্তও এ দেশের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই উন্নয়নের বিশ্বব্যাপী যৌথ অভিযাত্রার মূলস্রোতে ছিল না। তবে এখন বিশ্বের উন্নয়ন ভাবনা, পরিবেশ ও আবহাওয়াগত বিষয়ের সাথে এত নিবিড়ভাবে জড়িত হয়ে পড়ছে যে, ব্যাংকগুলোর সেবা নীতি ও লেনদেনের একটা বড় অভিমুখ তৈরি করেছে টেকসই গুণ বা জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন হয়ে যাবার পর টেকসই ব্যাংকিং ধারণা তত্ত্বগত পরিমণ্ডলী ছাড়িয়ে ব্যাংকের কাউন্টারের সামনে চলে এসেছে। ব্যাংকগুলো এখন ‘সবুজ’ পণ্য উৎপাদন এবং ‘সবুজ’ বাণিজ্যের দিকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঝুঁকছে এবং পরিবেশ অনুকূল উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের সর্বোচ্চ তাগিদ বাস্তবায়ন করছে। কৌশলপট সাজান হচ্ছে কীভাবে ‘সবুজ বিনিয়োগ’ বাস্তবায়ন করা যায় এবং কার্বন নিঃসরণ বিরোধী প্রকল্পে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া দেওয়া যায়। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোর করপোরেট দায়বদ্ধতা কর্মসূচির সুফলভোগীদের মধ্যে তারা জলবায়ু-শরণার্থীদের আরো বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছে। বিশ্ব ব্যাংকব্যবস্থার এই ‘সবুজে ফিরে আসার’ তাগিদ বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল এবং আছে। টেকসই উন্নয়নমুখী ব্যাংকিংয়ের অন্য কয়েকটি সহযোগী সুফলের মধ্যে থাকছে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং, জনবান্ধব ব্যাংকিং এবং অংশগ্রহণমূলক ব্যাংকিং। টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য যেহেতু সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামীণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তাই পরিবেশ ও জলবায়ুমুখী যেকোনো উদ্যোগের প্রথম এবং প্রধান সুফলভাগী তারাই হবেন।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ