শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক; একাল সেকাল
অলোক আচার্য
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৭:৩৫ PM
প্রতিটি সময়ের একটি সোনালী অতীত থাকে। সম্পর্কেরও থাকে। এখন যেমন প্রতিটি সম্পর্কই হালকা, অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা এবং অসহনীয় হয়ে উঠছে। মাত্র কয়েক দশক আগেও সেই সম্পর্কগুলো ছিল মজবুত বিশ্বাসের খুঁটিতে গড়া। অনেক মধুর সম্পর্কের ভেতর চমৎকার একটি সম্পর্ক হল শিক্ষকের সঙ্গে তার ছাত্র-ছাত্রীর সম্পর্ক। শিক্ষকের সঙ্গে তার ছাত্র-ছাত্রীর সম্পর্ক কেমন হবে সেটি নির্ভর করে ব্যক্তি ও বাহ্যিক পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে। তবে সত্যি কথা হল এখন এই সম্পর্ক যতটা তিক্ত তখন ছিল ততটাই মধুর। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর পারিবারিক এবং মানসিক বিষয় শিক্ষকের নখদর্পণে থাকতো। এখন তা থাকে না। অনেক শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের নামটিই হয়তো বলতে পারেন না। এটি হতে পারে শিক্ষকের তুলনায় ছাত্র-ছাত্রী বেশি হওয়ার কারণে। তবে আগ্রহের বিষয়ও থাকে। থাকে আন্তরিকতার প্রশ্নও। সম্পর্কটি ভাঙতে ভাঙতে এতটাই হালকা হয়েছে যে ছাত্রছাত্রীরা অনায়াসে শিক্ষককে গালি দিচ্ছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে গায়েও হাত তুলছে। শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সরে গেলে থাকে তিক্ততা। এখন মনে হয় সেটুকুই আছে। আমার সব শিক্ষককে আমি মনে রাখতে পারিনি। তবে যে শিক্ষকদের মনে রাখতে পেরেছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছু নেই। এমন না যে তারা আমাকে সবসময় আদর করেছেন, আদর এবং শাসন মিলিয়েই সম্পর্কটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ তখন শিক্ষকরা বেত ব্যবহার করতেন। শাসন করার উপকরণই ছিল বেত। সেই বেতের মার আমার পিঠেও পরেছে। তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। এখন মনে হয় যদি আরো একটু শাসন করতেন, আমি আরো ভালো অবস্থানে থাকতে পারতাম। এখন বেত বা কোনো ধরনের শাস্তি নিষিদ্ধ।
বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক বা মানসিক আঘাত দেওয়া উচিত নয়। আমি বিজ্ঞানী নই। সুতরাং এর ভালো বা মন্দ দিক বলতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারি সেই সময় বেত হাতে থাকলেও যেমন শিক্ষকদের ভয় পেতাম, আবার ভালোবাসতাম ও শ্রদ্ধা করতাম। আশ্চর্য বিষয় হলো, এখন সেটি হাতে না থেকেও সেই শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা নেই। উল্টো শিক্ষকরা অনেক ক্ষেত্রেই ভয়ে থাকে! শুনতে খারাপ শোনালেও এটি কিন্তু বাস্তব। বিশেষত উচু ক্লাসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে বিশেষত কোনো অন্যায় দেখলে তার প্রতিক্রিয়া করতে হিসাব করেই করতে হয়। কারণ এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে যে সামান্য বকাঝকার কারণেই তাকে রাস্তায় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এবং এটি ছাত্র ও তার অভিভাবক মিলেই করেছে। অবস্থা এমন যে শিক্ষকের এত বড় সাহস হয় কীভাবে! ঠিক এই কারণেই আজকাল চোখের সামনে ছাত্রছাত্রীর অধঃপতন দেখলেও অনেকেই মুখ বুজে থাকেন। কারণ পরিণতি জানা। কোথাও কোথাও আবার রাজনৈতিক পরিচয়েও এর ভেতর জড়িয়ে যান। তাদের ক্ষমতার দাপটেই শিক্ষক তটস্থ থাকেন! শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীর সম্পর্কের একাল-সেকালে যোজন যোজন ব্যবধান। এই সম্পর্ক তৈরিতে অভিভাবকেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেই সময় যেমন অভিভাবকরা শিক্ষা দানের জন্য পুরোপুরিভাবেই শিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন তারা তা করেন না। অনেক অভিভাবককে দেখেছি সন্তানকে সামান্য শাসন করলেই শিক্ষকের উপর চড়াও হতে! তাকে হয়রানি করতে। এমনকি শিক্ষককে এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতির মুখে পরতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর উদাহরণ বহু রয়েছে। এই ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কোন পথে চলেছি। আমার সন্তানকে আমি যে শিক্ষা দিয়ে বড় করছি সে তার সন্তানকে সেই শিক্ষাই দিবে। শিক্ষককে শ্রদ্ধা না করলে সমাজও পেছনেই থেকে যাবে। সমাজটি শিক্ষকদের হাতেই। কিন্তু এক আশ্চর্য কারণে সমাজে শিক্ষকরাই অবহেলিত। পেশার গুরুত্ব শিক্ষকতায় যেন কম। মূলত বাবা-মা নয়, আমার শিক্ষকেরাই আমাকে গড়ে তুলেছেন। অনেক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হয় চলতি পথে। আমাকে আদর দিয়ে আজও তারা কাছে টেনে নেন। এই আদর যে কতটা মধুর সেটি আমি জানি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে গাঁথা। সেখানে সম্মান, শ্রদ্ধা এবং শিক্ষা প্রদানের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে। এখানে নৈতিকতার শিক্ষা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা চর্চাও হবে। কিন্তু ইদানিংকালে তা হচ্ছে কি? শিক্ষকদের ওপর থেকে শিক্ষার্থীদের সেই সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা কমে গেছে। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীর হাতেই তার শিক্ষককে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে হচ্ছে। আবার কোথাও শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে তাদের অভিভাবকরা শিক্ষককে আঘাত করছে, অপমান অপদস্থ করছে। শিক্ষকতা একটি পেশা। অন্য পেশার মতো এখান থেকেও একজন পেশাজীবির সংসার নির্বাহ হয়। তবে অন্য পেশার সঙ্গে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কারণ শিক্ষকের দায়িত্ব অন্য পেশার থেকে অনেক বেশি। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে এই পেশায় আসতে হয়। সেই চ্যালেঞ্জ যেমন ছাত্র-ছাত্রীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার থাকে সেভাবেই থাকে তাদের বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার। সন্তান মানুষ না হলে যেমন বাবা-মা’র ওপর দায় চাপে, সেই সমপরিমাণ দায় শিক্ষকের ওপরও আসে। তাকে শেখাতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানি থাকে। আবার সফলতা আসলে বিপরীত চিত্র থাকে। এটিই শিক্ষকতা। শিক্ষার্থীকে মৃদু শাসন তো ভালো অনেক সময় কড়া ভাষায় কথা বললেও তাকে অভিযোগ শুনতে হয়! সুতরাং দেখা যায় যে, নৈতিক অধঃপতন শুধু ছাত্রছাত্রীর ঘটছে না বরং তাদের অভিভাবকদেরও ঘটছে। মোট কথা একটি সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পরেছে। যার পেছনে আছে নিজের ক্ষমতা জাহির করার মিথ্যা অহংকার। এর জন্য পুরো সমাজব্যবস্থাই এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী। এমনকি কোথাও কোথাও শিক্ষক নিজেও এর জন্য দায়ী থাকেন। এই ঘটনা কেন ঘটলো বা একজন শিক্ষকের গায়ে আঘাত করার মানসিকতা কি একদিনে তৈরি হয়েছে বা হওয়া সম্ভব? এই মানসিকতা তৈরির পেছনে শুধু ওই অপরাধী ছাত্রকে দায় দিয়ে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। সমাজটা পঁচে যাচ্ছে সে খেয়াল রাখিনি। সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ছিল আজ তা নেই। 

শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই ঘটছে। সে ছাত্র করুক বা অন্য কেউ। তার কয়টি ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে? আবার ছাত্রের দ্বারা শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কোনো শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর তাকে লাঞ্ছিত করা এক কথা নয়। আবার এটি যে কেবল এই সময়েই ঘটছে মানে ছাত্র তার শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলছে বা হয়রানি করছে তা নয়। অনেক আগে থেকেই এই নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে। একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে সেই নৈতিকতার স্থান। দেশের মেধাসম্পদ তৈরি করার মূল কারিগর হলো শিক্ষক। শিক্ষকের হাত ধরেই একজন শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করে। দেশকে কিছু দেওয়ার সুযোগ অর্জন করে। একটি শ্রেণিকক্ষ যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আন্তরিকায় স্বার্থক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেখানে থাকবে বিশ^াস, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। আর না হলে একসময় আমাদের আরো খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। 
আজকালের খবর/আরইউ