
বুড়ো শকুন মরতে বসেছে। ওদিকে সন্ধে শেষে রাত গভীর গাঁজার আড্ডায় হ্যাংলা জাকিউদ্দিন কণ্ঠার হাড় বারকতক ওঠানামা শেষে কলকেয় লম্বা টান মেরে মেরে ভাঙা চোয়াল আলিবাবা চিচিং ফাঁক করে দম ছাড়তে ছাড়তে চোখ-মুখ ভিজিয়ে ফেলে। তারপর, ঠিক তারপর পালের গোদা মতিলাল নড়েচড়ে বসে আর জাকিউদ্দিন কথা বলে ওঠে-
‘আহ্ বুকটা শুকায়ে গেছে গুরু।’
‘চোখ ভিজিয়ে লালে লাল জাকিউদ্দিন রে...আমারও বুক ফারাক্কার কারণে তৃষ্ণায় শুকায়ে গেল।’
‘একদিন চলেন বুড়াটাকে দেখে আসি...এবার বুঝি ঠিক ঠিক মরবে।’
‘শালা তুই মড়ার মুখ দেখেছিস? দেখিসনি। আমি দেখেছি আরেক শালার, বানচোত্ লাটক করত বটে!’
‘হ্যাঁ সেই তো...বাদ আছর জানাজার আগে চেহারাখান দেখিয়েছিল। কি বলব এক্কেবারে শুয়োরের মতো। যেন মড়াটা এখুনি ঘোঁত করে লড়বে।’
‘হি হি হি! এই শালাও মরবে, আর দ্যাখ্ আমি বলছি, শালার মুখটাও কুত্তা, থুককু কুত্তির পাছার মতো দেখতে হবে।’
‘এখনই তেমন হয়ে আলছে। বুড়া তা যা হোক, কট্টর কট্টর কথা কইত। আমাদের জন্য কত সুবিধা করে দিয়েছিল বল্।
‘তুই শালা জাকিউদ্দি বুদ্ধিজীবী হয়ে গেলি বে। আর আমি শালা কবি হয়ে গেলাম।’
বুড়ো শকুন মরবে। তারা বুধবার এগিয়ে যায়। তখন দুপুররোদ এই এলো বলে। উঠোনের একপাশে রোদ নেমেছে। কাঠাল গাছের পাশে পেতে দেওয়া চোকি। কাঠালের মুচি ধরেছে। কেউ এসেছে জেনে দেখে শকুনের আধভাঙা সাইকেল দেয়ালে আরও কাত হয়ে গ্যাঁট বসে যায়। চেয়ার দুটোর হাতল নেই। একটায় আবার পাটাতনে রক্তচন্দনের তিলক ফোঁটা মতো কয়েকটিট দাগ। এসবে কেমন জানি গা ঘিন ঘিন করতে লাগল। জাকিউদ্দিনের গলায় জিকজ্যাক ডিজাইন মাফলার। পুরোটাই জড়ানো। মাঘের এইসব দিনকালে কখনো আকাশ মেঘলা কখনো ঝেড়ে কাশির মতো তীক্ষè রোদ। সেই রোদ বড্ড পিপাসা তুলে ধরে। তখন কে যে কাচের ছোট ছোট গ্লাসে দু-কাপ চা দিয়ে যায়, আর সেই লালচে-খয়েরি রঙের তরলের মধ্যে লবঙ্গের কুচি মরা মাছির মতো ডুবে থাকে, ঠিক যেমন বুড়ো শকুনের ঠোঁটের কশে থকথকে শ্লেষ্মায় নছোরবান্দা মাছিগুলো বিরক্তির চরম হয়ে ওঠানামা করতে থাকে। কখনো নিশ্চিত ধ্যানীর মতো বসে অপেক্ষায় ঝিমোয়। মতিলাল শুধোয়, -
‘এখন কেমন আছেন আমিনুদ্দিন ভাই? এই তো কদিন আগেও বেশ টগবগা ছিলেন হে! কি থেকে কী হলো? কেমন করে হলো?’
শকুনের বড় করুণ দৃষ্টি আর পাঁজরের ওঠানামায় যেন মৃত্যুকে কাছে থেকে দেখা যায়। জাকিউদ্দিনের চোখদুটোও কেমন আদ্র হতে থাকে। তখন উত্তর দেয়ালের ওপাশে মেহগনি গাছ থেকে একসঙ্গে অনেকগুলো পাতা ঝরাতে ঝরাতে দমকা বাতাসের ঢেউ। রোদ সরে যেতে উদ্যত হয়। আমিনুদ্দিন শুয়ে আছে পৃথিবীর সকল কাজের সাঙ্গ হলে যেমন ক্লান্তি আর অবসাদ নেমে আসে যেনবা ঠিক তেমনই। তার কোটরগত চোখের মধ্যে শুধু অতীতের ছায়া সাদা অংশ থেকে থেকে হেঁচকির মতো ভেলকি দেখায়, তারপর আপনিই নেতিয়ে পড়ে। আমিনুদ্দিন কি বুঝতে পারে জীবনের হাজার কাজের মধ্যে কোনো ন্যায়-অন্যায়-অপরাধ-পাপ? পাপ...হ্যাঁ, সে এক শব্দ বটে, যার অর্থ একেকজনের কাছে পৃথক পৃথক। জাকিউদ্দিন অবশেষে বুঝে উঠে যে, কারও ক্ষতি করাই পাপ। অবশ্য এইসব পাপ-পুণ্য নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। ‘শালা অন্ধকার থেকে এসেছি সেই অন্ধকারেই ফিরে যাব। জন্মের আগে যেমন কিছু ছিল না, মরে গেলেও কিছু নাই; বাকিসব ভাবিয়া ভাবিয়া মাথা নষ্ট করার দরকার কি?’
অবশ্য কিছু কিছু সাফল্য-ব্যর্থতা আর নবউজ্জীবনের কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষের কথা আচমকা মনে পড়ে যায়। তাকে নিয়ে অদ্ভুত এক কাহিনি করা হয়েছিল। সেই ঘটনা প্রায় ভুলে গিয়েছিল জাকিউদ্দিন। জীবনযাপনের নানা টানপোড়েন উত্থান-পতন-স্খলনের পাঁকে পড়ে কি থেকে কী হয়ে যায় অন্যসব মনেও থাকে না। এখন এই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় মনে পড়ে যায়। একদিন বাহাদুর বাজারে দেখা হলে ফেরত উন্নাসিকের মতো ব্যবহার ছিল তার। জাকিউদ্দিন সেদিন খুব হাসে আর হাসে, এমনকি অপরাহ্ণে যখন বাসায় বউয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করছিল, আর ইলেকট্রিক মিস্ত্রি কাজের ফাঁকে হুড়ুম করে এসে পড়ে, তখন যবনিকাপাতের চূড়ান্ত লগ্ন, তারপরও তার হাসি থামে না। সে আসলে কোন্ ঘটনাকে প্রাধান্য দেবে ঠিক করতে পারে না। সন্ধ্যের পরপর আবার গুঞ্জাবাড়ির আমবাগানে গিয়ে বসে থাকে। মতিলাল আসে না। আড্ডার সেই দিনগুলো ফিকে হতে শুরু করেছিল গ্রীষ্মে দাপটে। তখন পুনরায় ভাবতে বসেছিল সে।
একদিন দুপুর রোদে ওই যে শালার কোন্ পত্রিকায় একজন ছিল, কবিতা লিখত, সে আসলে চাইত উপন্যাস লিখবে, মানুষের জীবন কাহিনী লিখে যেতে পাগলপারা, সেই লোকও কোনো বিকাল কি সন্ধ্যার আগে আগে এখানে আসে। এটা-সেটা দু-একটি গল্প করে বাপের পুরনো সাইকেলে হ্যাঁচকা টানে ওঠে যেন পক্সিক্ষরাজে ভেসে ভেসে ফেরত চলে যায়, তাকে কিছুতেই কলকে ধরানো গেল না; সেই আফসোস কি এখন পীড়া দেয়? কে জানে! তারা তিনজন লোকটাকে একবার ঘায়েল করার চেষ্টা করেছিল। তখন কি আশ্চর্য আর মজার কথা যে আরো দুজন জুটে যায়! এক কবিতা পাঠের আসরে ডোবানো হয় তাকে। সেই সঙ্গে আমিনুদ্দিন প্রচার কিংবা জোর দাবি তুলে বসে হাজারও কৃতিত্বের। তারা সমস্বরে হাততালি দিয়ে জয়গানে মুখরিত করেছিল রাতের আকাশ। এইসব পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ কি মরতে বসে মনে পড়ে মানুষের? অনুতাপ হয়? কে জানে? জাকিউদ্দিন মরতে বসলে সেই অভিজ্ঞতা বলে যাবে। মতিলাল ইতিহাস রচনায় দক্ষ। সেও লিখে বিখ্যাত হতে পারে। তার নেটওয়ার্ক ভালো। জাকিউদ্দিন তাই তার পায়ের তলায় বসে থাকে। জয় গুরু!
‘ভাই যদি কোনো ভুলচুক হয়ে থাকে মাফ করি দেন।’
এইরকম দু-একটি উক্তি তুলতে তুলতে বুড়ো হাঁপায়। জাকিউদ্দিন দেখে ভুতুড়ে বিলের খাঁ-খাঁ অশরীরি নিঃসঙ্গতার মতো মৃত্যু কত কাছাকাছি। এই তো বছর দশ-পনেরো আগে রাস্তার পুব থেকে পশ্চিমে গিয়ে আড্ডা হতো। সুদিপবাবু পশ্চিমে মন্দিরলাগোয়া চা স্টলে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আর স্টার সিগারেটে টান মারতে মারতে তাদের দেখে নেয়। তারপর সেও যোগ দিতে আসে। সেখান থেকে এক দোকান পর উত্তরে ছাপাখানা। সেখানে প্যাডেল মেশিনে ঘটাং-ঘটাং জোর আওয়াজ ওঠে। বেদের মেয়ে জোছনার লিফলেট ছাপা হয়। কারও কানে বাজে বশীকরণ বীণ। কয়েকদিন পর ফাগুনের দিনকাল। মানুষ কতরকম উৎসবে মাতোয়ারা হবে। মেথরপট্টিতেও হোলিখেলার আয়োজন। শিমুল শাখায় লালে লাল দৃশ্যছবির দিনযাপন। সেই কথা থেকে থেকে মনে পড়ে। হায় কোথায় গেল সোনালি দিন! সেইরকম ফাগুন আবার এসে গেছে। এই আঙিনার কোণায় কোণায় তবু বিষণ্ন বাতাস ভেসে যায়। জীবনের জন্য আকুল দৃষ্টি রেখে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক।
মতিলাল গ্লাসে চুপচাপ চুমুক দিতে থাকে। মাথায় বোধকরি হাজারও ভাবনা। কত কথা কত স্মৃতি এসে ভিড় করে। সেই আসর-আড্ডা কবেই ভেঙে গেছে। রেলঘুমটির পশ্চিমে চা-স্টলে পেতে রাখা বেঞ্চে সারাদিন কত মানুষ এসে বসে। দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আলোচনা, টিভির খবরাখবর, সিনেমার জৌলুস আর বিবিধ গল্প শেষে ব্যক্তিগত অহমের কাহিনিও শুরু হয়; মানুষজন যেমন আসে আবার চলে যায়। আলমের চা-লিকারের সুঘ্রাণ যেমন ধীরে ধীরে বাতাসে মিশে যায়, পৃথিবীর গতিপথ, চব্বিশ ঘণ্টার দিনরাত্রি, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, মানুষের জীবন তেমনই এক সরাইখানা, রেলস্টেশনের প্লাটফরম, সাঙ্গ হলে যাত্রাপথ আর খেলা, এসে যায় বিদায় বেলা; এই সামান্য সময়ের মধ্যেই তবু কাবাডি রেস হয়। কে কাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দেবে তার চতুর খেলা। পরিশেষে লাভ কী? অনন্ত পরিতাপ অথবা আত্মশ্লøাঘা?
শিমুল গাছের একডালে শকুন বসেছিল। তার চোখে কপট আন্তরিকতার অভিশাপ। শকুন একদিন মগডালে উঠে বসতে গেল। মানুষেরও কতরকম সাধ-আহ্লাদ-আকাক্সক্ষা থাকে। আমিনুদ্দিন দিনরাতের নিয়মচক্রে কতজনের কত ক্ষতির বীতংশ পেতে গেছে। কেউ বলে অভিসম্পাত। এখন তার নিজের পালা। ভাগ্যবানে আকস্মিক চলে যায়, দুর্ভাগা মরে ধুকে ধুকে। কারও উপকার করতে পারেনি, ক্ষতি আর মন্দ অভীপ্সায় কাটিয়ে গেল জীবন, সে আর মানুষ কোথায়? সে তো এক শকুন। বুড়ো শকুন। বুড়ো শকুন মরতে বসেছে। মৃত্যুশয্যায়। আমরা তবে সবাই ফাতেহা পাঠ করি।