বর্ষার ঘোর না কাটতেই প্রকৃতিতে শরৎ এসেছে। তবে বর্ষা এবং শরৎ দুই ঋতু যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বর্ষায় দেখা মিলেছে শরতের আকাশ আবার শরতে দেখা যায় বর্ষার বৃষ্টি। প্রকৃতির আজব রূপ, বিচিত্র সম্ভার। গানের সুরে ভেসে আসে- আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা, নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই...’। সাদা মেঘের ভেলার এই রূপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে শরৎ কালে। শরতের ভোর, শরতের সন্ধ্যার আকাশ এসবই শরতের বৈশিষ্ট্য। তাই হয়তো কবি কণ্ঠে বেজে ওঠে, ‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি/হেরিনু শারদ প্রভাতে!/হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ঝলিছে অমল শোভাতে...’। মেঘমুক্ত আকাশ, শিউলির ঘ্রাণ, মাঠে ফসলের ঢেউ এসবই আজ জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। বর্ষামুখর সন্ধ্যা শেষে স্নিগ্ধতা মিশেছে। শরৎ এসেছে। বাংলার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ীই এদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালা করে প্রকৃতি একে এক তার ছয়টি রূপ আমাদের সামনে আনে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতুর পালাবদলের। আমাদের জীবনযাত্রায় এসব ঋতু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ফসল উৎপাদন এবং ঋতুনির্ভর ফল ঋতু বদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ভিন্ন বৈচিত্র্যে হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে। প্রিয় ঋতুর তালিকায় ভিন্ন মত আছে। তবে সৌন্দর্যের তালিকায় শরতের আলাদা কদর রয়েছে। অন্য যেকোনো ঋতুর তুলনায় এই ঋতুর বৈশিষ্ট্য একটু বেশি ভিন্ন। যদিও শরতের দু’টি মাস সমানভাবে শরতকে তুলে ধরে না। ভাদ্র মাস কিছু সময় বৃষ্টির মাস হয়ে যায়। তীব্র গরম আর আকাশ কালো করে বৃষ্টি আসে। অবশ্য তারপরই আবার সেই শরতের নীলাকাশ বেরিয়ে আসে। তবে ভাদ্র মাসের শেষের দিকে শরতের রূপ ফুটে উঠতে শুরু করে। আশ্বিন মাসটা পুরোটাই শরতের মাস। বর্ষার জলের ভাটায় চরজুড়ে কাশফুল ফুটতে থাকে। এক সময় যেখানে জল ছিল এখন সেখানে সাদা কাশের মেলা। কাশফুল বাতাসে দোল খায়। কবি সাহিত্যক, গায়কের খাতায় এ ঋতু নিয়ে নানা সৃষ্টিকর্ম উঠে এসেছে। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে শরতের বন্দনা করা হয়েছে বহুভাবে। গল্প, কবিতায় শরতের রূপ বর্ণনা করা হয়েছে। বারো মাস আর ছয় ঋতু এই তো বাংলার প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। বাংলা মায়ের নতুন নতুর রূপ তার সন্তানদের মুগ্ধ করে রাখে। তাই তো কবি বলেছেন, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’। ঋতুর পালাবদলে এখন চলছে শরৎ কাল। বর্ষার কালো মেঘ, ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি অথবা ঝরঝর মুখর বাদল দিনের শেষে বর্ষণের অবসান হয়। আকাশের কালো মেঘের জায়গায় সাদা মেঘ জড়ো হয়। প্রকৃতিতে নতুন হাওয়া লাগে। প্রকৃতির এই নতুন সাজ বাংলার মানুষের কাছে খুব চেনা। শত বছরের পরিচিত দৃশ্য। আশ্বিনের খুব ভোরে হাঁটতে গিয়ে যখন পায়ে শিশির লেগে যায়, তখন শরতের এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। হালকা কুয়াশাও দেখা যায় প্রকৃতিতে। শরতের শুরু এবং শেষ প্রকৃতির মায়াময় বৈচিত্র্যতায় ভরা।
শরতেও বৃষ্টি হয়। তবে তা কিন্তু বর্ষার বৃষ্টি নয়। এ শরতের বৃষ্টি। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দবারি। বৃষ্টির পরেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে সাদা মেঘের দেখা মেলে। মাঝে মধ্যে দুর্লভ রংধনুও ওঠে। কবিগুরু তাই লিখেছেন, আজি কি তোমার মধুর মুরতি/হেরিনু শরৎ প্রভাতে হে মাতা বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অনল শোভাতে।
শরতের উদার মাখা কমনীয়তা, এত নীল, এত সাদা, এত মাখামাখি যে চমকিত না হয়ে পারা যায় না। কবিগুরু তাইতো লিখে গেছেন, আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা গেঁথেছি শেফালী মালা/নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে/সাজিয়ে এনেছি ডালা- এসো গো শারদও লক্ষèী/তোমার শুভ্র মেঘের রথে/এসো নির্মল নীলপদ্মে।
সত্যি যেন শারদ লক্ষèী তার দুহাত দিয়ে বাংলার প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন। তার মধ্যে একটি অংশ হলো শরৎকাল। প্রতিটি ঋতুরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। বসন্ত ঋতুর রাজা হলেও শরৎ ঋতু সকলের কাছেই অত্যন্ত প্রিয় এবং আদুরে। শরৎ হলো ঋতুর রানি। স্নিগ্ধ এ ঋতুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে নদীর পারে কাশফুল মাথা দোলায়। নদীর বুকে জেলে, ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে দুদণ্ড প্রশান্তি এনে দেয় কাশফুল। গন্ধহীন এ ফুলটি সৌন্দর্যে অতুলনীয়। শিউলির মনমাতানো গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। রাতের আকাশের তারাগুলোই তো ফুটে থাকা ফুল। শরতে ফোটে নানা রূপের, গন্ধের ফুল। এ সময় ফোটে- শিউলি, বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, পদ্ম, কাশফুল, কেয়া, মাধবী, মল্লিকা, মালতীসহ আরো অনেক ফুল; যারা শরতের সঙ্গী হয়ে মন ভরায় সৌন্দর্য পিপাসুদের। শরতের ভোরে দূর্বাঘাসের ডগায় জমে বিশুদ্ধ শিশির জল। ব্যাকুল হয় মন। শরতেই হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজার ঢাক বেজে ওঠে। বাংলা মেতে ওঠে আনন্দে। শরতে শিউলির মিষ্টি সুবাস যেন দেবী দুর্গার আগমনকে ইঙ্গিত দিতে থাকে। চার দিনব্যাপী দুর্গার আরাধনা ও বিসর্জন শেষে আগমন ঘটে ধনদাত্রী দেবী লক্ষ্মীর। কিছুদিন পরই রাতের আকাশে আতশবাজির ঝলকানি নিয়ে আসে দীপাবলি উৎসব।
শরৎ হলো বর্ষার পরবর্তী ঋতু। বর্ষার অতিবর্ষণ ও অবিরাম মেঘবালিকার গুরুগুরু গর্জন থেমে গিয়ে প্রকৃতিতে শরৎ নিয়ে এসেছে এক অপরূপ দৃশ্য। শরতের রূপের তুলনা নেই। শরৎ মানেই, আকাশের নরম নীল ছুঁয়ে শিমুল তুলার মতো ভেসে চলা সাদা মেঘের ভেলা। প্রকৃতিতে ছোট বড় আরো অনেক পরিবর্তন ঘটেছে শুধু শরতের আগমনী বার্তায়। শরতের এই পরিবর্তন আর প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। কেবল কবিগুরুই শরৎ নিয়ে সহিত্য রচনা করেননি। আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি শরতের শিউলি বিছানো পথে পথিককে আমন্ত্রণ জানিয়ে রচনা করেছেন, এসো শারদ প্রাতের পথিক/এসো শিউলি বিছানো পথিক/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে/এসো অরুণ কিরণ রথে।
শরতে শুধু প্রকৃতিতেই পরিবর্তন আসে না আসে আমাদের মনেও। শরতে চারিদিকে সাদার সমারোহ দেখে মনটা একটু তো উদাস হয় সবারই। পাখি হয়ে আকাশে ডানা মেলতে ইচ্ছা হয় অথবা কাশফুলের বনের মাঝে হারাতে ইচ্ছা হয়। কখনো প্রেমিকার অঙ্গে শিউলির মালা পরাতে মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রেম ও দ্রোহের কবি শরতে হারানো প্রেমিকাকে না পেয়ে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে লিখেছেন, শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি/সাথে জাগার সাথী কৈ?। কবিতার এসব লাইন বলে দেয় শরতের আবেগ কেন সবার মনকে এত দোলা দেয়। কবি জীবনানন্দ দাশ শরতের চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। শরতের প্রকৃতি আমাদের শেখায় আমিত্ব আর অহংকার থেকে মুক্ত করে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেই। এ অহংকার বশ করার ক্ষমতা কেবল শরতেরই আছে। তাই শরতের স্নিগ্ধ আলোয় অঞ্জলি দেই।
আজকালের খবর/আরইউ