পেছন থেকে আওয়াজ আসছে শোনে পেছনে তাকিয়ে দেখলেন একটা রিকশা। তিনি রিকশাটাকে থামালেন।
রিকশাওয়ালার বেজায় কৌতূহল- এতো রাইতে আফনে কই যাইবেন?
জমিলা যতটা সম্ভব সাহসী ভাব এনে শক্ত গলায় বললেন, পাশের গ্রামে। আপনি যাইবেন?
রিকশাওয়ালা ভ্রু কুচকে জমিলাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন, উডেন।
জমিলা উঠে বসলো। একটু স্বস্তি পাচ্ছে এখন। একা থাকার চাইতে অন্তত এখন একটা মানুষ পাওয়া গেলো। হাতের পুটলিতে থাকা তার বিয়ের গয়না, কিছু টাকাপয়সা নিয়ে এই রাতের বেলা সে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে। ভেবেছে চলে যেতে পারবে, পাশের গ্রামেই তো। কিন্তু রাত যে এতো ভয়ানক সে আগে বোঝেনি। কিছুদূর যাওয়ার পর খেয়াল করলো রিকশাওয়ালা একটু পর পর পেছনে তাকাচ্ছে আর পুটলিটা দেখছে আড় চোখে। জমিলা আরও শক্ত করে পুটলিটা বুকে চেপে ধরলো। রিকশাওয়ালা বললো, আফনে অতো রাইতে যাইতেছেন কেরে আফা, কুনু সমস্যা? আফনের পুটলিত কিতা?
জমিলা বললো, আপনার কোনও দরকার আছে? আপনি রিকশা চালান। কিন্তু এবার জমিলার আরও ভয় করতে লাগলো। সে বললো, আপনি থামান। থামান কইছি।
রিকশাওয়ালা থামিয়ে বললো, ওকি যাইবেন না?
জমিলা বললো, না আপনি যান।
রিকশাওয়ালা নিজের দাঁড়ি চুলকে জমিলার পুটলির দিক তাকিয়ে বললো, এতো রাইতে তো গাড়ি পাইবেন না।
সেটা আপনার দেখার বিষয় না, আপনি যান, শক্ত গলায় জমিলা উল্টো পথ ধরলো। তার মনে হচ্ছে এভাবে যাওয়াটা ঠিক হবেনা, বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। সে যত দ্রুত পারে পুটলিটা শক্ত করে ধরে আবার নিজের শহরের দিক ফিরে আসে, কিন্তু স্বামীর ঘরে যাওয়া যাবে না। কোথায় যাবে সে এখন? সে দ্রুত হাঁটতে থাকে আর ভাবে, কোথায় যাবে সে, কার কাছে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের স্বামীর বাড়ির এলাকায় চলে আসে। যাই হয় হোক, স্বামীর বাড়ি সে যাবে না। হঠাৎ মনে হলো এলাকার রিতু ভাবির কথা। সে রিতু ভাবির দরজায় কড়া নাড়লো।
রিতু ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসে দরজা খোলে জমিলাকে দেখে অবাক — একি জমিলা ভাবি, আপনি এই মাঝরাতে?
জমিলা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্রুত রিতুকে ঠেলে ঘরে ঢুকে যায়। ভাবি, আমারে আজকের রাতটা থাকতে দেন। আমি সকালে চলে যাবো। রিতু অবাক হয়ে বলে, আরে ভাবি কাহিনী কি আমিতো কিছুই বুঝতেছি না।
আমি আপনাকে সব বলতেছি, আপনি শুধু কাউকে বলবেন না, আমি আপনার এখানে আছি।
এই রনি, রনি এই উঠ!
আমি ঘুম ঘুম চোখে বললাম, মা, কি হয়েছে? আমার সকালে অফিস আছে কেনো এই মাঝরাতে বিরক্ত করছো?
আরে উঠনা। আমি উঠে বললাম, বলো কি?
শোন তোর জমিলা আন্টি বাসায় এসেছেন। আমি অবাক হয়ে বললাম, এতো রাতে! কি ব্যাপার।
আরে উনার স্বামীর সাথে ঝামেলা। তুই বুঝবিনা। শোননা, তুই একটু তোর বাবার বিছানায় গিয়ে ঘুমা। তোর রুমটা ছেড়ে দে। উনি এখানে ঘুমাবে।
আমি অগত্যা উঠে গিয়ে পাশের রুমে বাবার পাশে ঘুমিয়ে গেলাম। মা আর আন্টি সারারাত গুজুরগুজুর করেছে। একবার ভেবেছি, বলব আমার সকালে অফিস আছে। তোমাদের জন্যে কি ঘুমাতে পারবো না? ভেবেও বলিনি কিছু, মহিলা বিপদে আছে হয়তো। থাক একটা রাতই তো। পাশে বাবাকে দেখলাম, ভোস ভোস করে নাক ডাকা শুরু করলো। যাক, আমার আজ রাতের ঘুম এর দফা রফা। শেষরাতের দিকে একটু চোখ লেগে আসতেই ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। জমিলা আন্টি কাঁদছেন, মা শান্তনা দিচ্ছে। ওদিকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। আমি ফ্রেশ হয়ে নামায পরে নিলাম। মাকে ডাকলাম, নাহ কোনও খবর নাই। আজ নাস্তাও মনে হয়না কপালে জুটবে। গোসল সেড়ে বাস ধরে সোজা অফিসে চলে গেলাম না খেয়েই।
সারাদিন শেষে বাসে আবার বাড়ি ফিরছি, রাতে ঘুমাতে পারিনি চোখ জ্বালা করছে। হঠাৎ চোখে পড়লো বাসে আমার থেকে ৬-৭ সিটসামনের এক দম্পতির ওপর। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক খুব যত্ন করে তার বোরকায় মোড়ানো স্ত্রীকে যত্নে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন। আমার বেশ ভালোই লাগলো কিন্তু হঠাৎ একটু আঁতকে উঠলাম আরে এতো জমিলা আন্টির হাজব্যান্ড না? পাশের মহিলার মুখ দেখতে পাচ্ছি না পেছন থেকে। জমিলা আন্টি তো আমার বাসায়, তাহলে ওই মহিলা কে! এরমধ্যে বাস ছেড়ে দেওয়ার সময় হলো। আঙ্কেল মহিলাকে পকেট থেকে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যেনো তার কোনও কিছু তে সমস্যা না হয় রাস্তায়। আমি উনাকে ডাক দিলাম, আঙ্কেল ভালো আছেন? তিনি আমাকে দেখে ভীত হয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললেন, হে বাবা ভালো আছি। তারপর বাস থেকে নেমে গেলেন। বাসের জানালায় দাঁড়িয়ে মহিলার দিকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন যতক্ষণ বাস চোখের সামনে রইলো।
আমি বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, মা আন্টি কোথায়? মা বললেন, সে আপাতত তার এক বান্ধবীর বাড়ি আছে পাশের এলাকায়।
ওও, আর আঙ্কেল কোথায়?
মা একগাল হাসলো। আর বলিস না, সেই বেচারা তো জমিলা ভাবিকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। সারাদিন ধরে বেচারা খুঁজেই চলেছে, আমার কাছে এসেছিলো, আমি বলেছি, দেখেন ভাই ওর বাপের বাড়ি গেছে কিনা। সে এখানে ওখানে সারাদিন টইটই করে খুঁজে বেড়াচ্ছে।বেশ হয়েছে, এবার মজা বুঝুক। বউয়ের সাথে ঝগড়া করবে না আর জীবনে।
আমি হতাশ হয়ে মাকে বললাম, মা কি বল।
না কিছু না। খেতে আয়। মা খাবার দিতে গেলো। আমি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। আর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যাপারটা। মধ্যবয়স্ক একটা মানুষকে নিয়ে আমার মাথায় এসব কি ভাবনা চিন্তা চলছে, ভেবে নিজেই বিরক্ত হলাম। এসব মাথা থেকে ঝেরে ফেলে খেয়ে উঠে পরলাম চুপচাপ। আমি যেমনটা ভাবছি তেমনটা তো নাও হতে পারে।
সন্ধ্যেবেলা আমি বসে ল্যাপটপ এ অফিসের কাজ করছি। মা হাসতে হাসতে আমার ঘরে এসে পাশে বসে বললেন, তোর আন্টিকে তার জামাইয়ের হাতে তুলে দিলাম। ওদের মিল করিয়ে দিয়ে এসেছি। আমি বললাম, ভালো করেছো। ঝামেলটা কি নিয়ে? মা বললো, আরে তোর জমিলা আন্টির সন্দেহবাতিক৷ প্রচুর সন্দেহ করে জামাইকে। এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব। আমি বললাম, সন্দেহ সে কি বিনা কারণে করে? মা, আমার কথা হেলায় উড়িয়ে বললো, আরে সংসার এসব হয় একটু আধটু। ওসব কিছু না। বলে মা চলে গেলো। আমি আমার কাজে মন দিলাম।
দু’দিন পর বাড়ি ফিরতে লেট হলো রাস্তায় জ্যাম এর কারণে। বাড়িতে ঢুকতে নেবো, সে সময় শুনলাম ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে, একজন পুরুষ কণ্ঠের। আমি অবাক হলাম। একটু দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। আওয়াজ শুনে বুঝলাম জমিলা আন্টির জামাই, লোকটা কেঁদে কেঁদে বলছে, ভাবি আমি ওর জন্যে কি না করি। সে আমারে শুধু সন্দেহ করে। বাড়ি থেকে বের হলে, একটু পর পর ফোন আর ফোন। কই আছো, কি করো। আজকে রাগে বলছি কাজের মধ্যে বারবার তোমার এইগুলা কি শুরু করলা। ব্যস ওর মনে হইছে আমি আকাম করতেছি। কন ভাবি এভাবে চলে? ও পাগল হয়ে গেছে ভাবি ওর মাথা ঠিক নাই। আমার তো ভয় লাগে ও কখন না জানি আমারে খুন করে ফেলে। ওর সন্দেহগুলারে ও নিজের কল্পনায় আইনা বাস্তব ভাবে।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। আঙ্কেল একটু অপ্রস্তুত হয়ে দু’হাতে নিজের চোখ মুছলো। আমি ভেতরে চলে গেলাম। মায়ের কথা কানে এলো — এখন কি বলবো ভাই, যত যাই হোক আপনার বউ৷ এই বয়সে এসে এসব যদি কানাকানি হয় তো সমাজে ইজ্জত কই যাবে৷
-আরে ভাবি আমার ইজ্জত আর রাখে নাই বাকি কিছু।
আঙ্কেল আরো কান্নায় ভেঙে পরলো।
-আমারে সবার কাছে খারাপ বানাইছে। সবার কাছে উল্টাপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছে, ভাবি ও পাগল হয়ে গেছে। আমি ওরে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
-আচ্ছা ভাই দেখেন তাহলে যদি সমাধান হয় তাহলে তো ভালোই।
এলাকার সবাই জমিলা আন্টিকে খানিকটা পাগল হিসেবে নিতে শুরু করলো। তার কথা আর কেউ গুরুত্ব দিলো না।
মাসখানেক পর একদিন শুক্রবারের সন্ধ্যাবেলা, আমি একটু বের হচ্ছিলাম বাসা থেকে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। এমন সময় জমিলা আন্টির সাথে দেখা। অনেকটা শুকিয়ে গেছেন।
আমায় দেখে বললেন, বাবা তোমার মা বাসায় আছেন?
আমি বললাম, জি জি,আসেন ভেতরে আসেন।
উনি, মায়ের কাছে গেলেন, আমি বের হতে হতে শুনতে পেলাম, উনার ভারী গলা, ভাবি, আমার বুকটা কেমন জানি করতেছে, আমার শরীরডা ভালা লাগতাছে না ভাবি।
তারপরদিন সকালে শুনলাম, জমিলা আন্টি মারা গেছেন রাতে স্ট্রোক করে। উনার স্বামীর সেকি কান্না! আমাকে কে ফোন দিবে! কে আমার খোঁজ নেবে। ওরে আমাকে ছেড়ে তুমি কেনো চলে গেলে। উনার কান্না দেখে এলাকার মানুষের চোখের পানি ঝরতে লাগলো। তবে আমাকে উনার কান্না নাড়া দিলো না।
আমি পরদিন রাতের আঁধারে আনুমানিক ২:৩৭ বাজে তখন, বাসা থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় হাঁটাহাটি করছি। তবে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে অনেকটা দূর চলে এসেছি সেদিকে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমার পিছু নিয়েছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই আমার মাথায় সজরে শক্ত কিছু একটার বারি পরলো। আমি ব্যথায় মাটিতে পরে গেলাম। মাথা ফেটে রক্ত পরছে। আমি তাকিয়ে দেখি, জমিলা আন্টির জামাই, হাতে শক্ত রড নিয়ে হিংস্র নেকড়ের মতো চোখে আমার দিক তাকিয়ে আছে।
আমার দিক ঝুকে এসে বললেন, ছিনতাইকারীর হাতে পরে তোমার প্রাণটাই গেলো আহারে। মানুষ স্ট্রোক করে মারা যায়, ছিনতাইকারীর হাতে পরে মারা যায়, কতো কষ্টের ব্যাপার তাই না বলো।
তোমাকে মারার ইচ্ছে ছিলোনা, তবে তুমি আজ না হয় কাল আমার জন্যে বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারো। তাই তোমাকে রাস্তা থেকে সড়াতে হলো।
আমি মুচকি হেসে বললাম, হয়তো বাঁচাতে পারিনি তবে সঠিক বিচার এনে দিবো না তা কি করে ভাবলেন?
-মানে! আঙ্কেল খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে দু'পা পেছনে সরে গেলেন।উনি চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলেন, উনি ফাঁদে পরে গেছেন।
আমি মাথাটা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। এই পৃথিবীতে শুধু খেলা আর খেলা। এই খেলায় মানুষ জিতে গিয়েও হেরে যায়, আবার হেরে গিয়েও জিতে যায়। কিন্তু খেলা চলতে থাকে। ভয়ানক খেলা।