
দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। দেশের প্রায় সব জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে জ্বরের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখন ১২ মাসই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কারণ বৃষ্টির বাইরেও উন্নয়নমূলক কাজসহ নানা কারণে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।
ডেঙ্গু জ্বর একটি মশাবাহিত ভাইরাস সংক্রমণ। সাধারণত এডিস মশার কামড়ে মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই রোগে কেউ তখনই আক্রান্ত হন, যখন মশা সংক্রমিত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ে তারপর ভাইরাস বহন করার সময় একজন অ-সংক্রমিত ব্যক্তিকে কামড় দেয়। সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ শরীরে ব্যথা। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। সঙ্গে চামড়ায় লালচে দাগ বা র্যাশ থাকতে পারে। শরীর ঠান্ডা হচ্ছে মনে হতে পারে। ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করার লক্ষণও দেখা দিতে পারে। সিভিয়ার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তীব্র পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, রক্তবমি, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকার্য কঠিন বা দ্রুত হওয়া, শরীর ঠান্ডা অনুভব বা ঘাম হওয়া, দ্রুত নাড়ি স্পন্দন এবং ঘুম ঘুম ভাব, চেতনা হারানো। ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম থেকে মানবদেহে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্স রেট অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলে। রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন। তখন সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। বাড়ির আশপাশ যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে।
ঘরের ভেতরে থাকা ফুলের টব কিংবা ভাঙা প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা, টায়ার অথবা পলিথিন থাকলে তা দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে এবং ফুলের টব থেকে জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করার ব্যবস্থা করতে হবে। মশা নিধনের জন্য সপ্তাহে অন্তত তিন বার স্প্রে বা ফগিং করতে হবে। বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় মশা নিধনে ব্যবহৃত ক্রিম রাখতে পারলে বিল হবে। সন্ধ্যার পর বাড়ির ছোট থেকে বড় সদস্যরা মশারি ব্যবহার করতে হবে।
যেখানে সেখানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি পরিষ্কার করে ফেলতে হবে কারণ এতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। অন্যদিকে মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে মশারির পাশাপাশি ম্যাট ব্যবহার করতে হবে। এডিস মশা যেহেতু দিনের বেলা কামড়ায় তাই দিনের বেলা ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমানোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এবং ছোট ছোট কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে ডেঙ্গুজ্বর থেকে যেমন মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে। আপনি এবং আপনার আশপাশের মানুষরাও থাকবে সুস্থ। ডেঙ্গু হলে ওষুধ হিসেবে শুধু প্যারাসিটামল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। অনেকে না জেনে শরীরের বিভিন্ন অংশের তীব্র ব্যথা কমানোর জন্য ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে বিপদ ঘটতে পারে বলে সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা। কারণ, ব্যথানাশক ওষুধ শরীরে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে, যা ডেকে আনতে পারে মৃত্যু। ডেঙ্গু হলে চিকিৎসকরা বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। যেমন- ভাতের মাড়, স্যালাইন, ডাবের পানি, স্যুপ, ফলের রস, লেবুর পানি ইত্যাদি। তরল খাবার ৯০ শতাংশ কমায় ডেঙ্গুর তীব্রতা। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার ডাল, ডিম, মুরগির মাংস, ছোট মাছের ঝোল বেশি করে রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়। তাই প্লাটিলেট বাড়ে এমন খাবার খেতে হবে। যেমন- সাইট্রাস ফল, কাঠবাদাম, দই, সূর্যমুখী বীজ, গ্রিন টি, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, পালংশাক, আদা, রসুন ও হলুদ। পেয়ারার শরবত পান করা যেতে পারে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই পানীয়টি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে ডেঙ্গু সংক্রমণ উপশম করবে। রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে নিম পাতার রস ভালো কাজ করে। এটি শ্বেত রক্তকনিকার সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। নিম পাতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর গুণও আছে। খাবারের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পুষ্টিবিদরা খাবারের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে, পেঁপে পাতা পাপাইন ও কাইমোপাপেনের মতো এনজাইম সমৃদ্ধ, যা হজমে সাহায্য করে এবং প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ডেঙ্গু জ্বরের কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। তাই শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে ডাবের পানি পান করলে উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া ডাবের পানিতে রয়েছে ইলেকট্রোলাইটসের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। ডালিম পুষ্টি ও খনিজ সমৃদ্ধ ফল। এটি শরীরের ক্লান্তিভাব কমায়। ডালিমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, যা রক্তের জন্য উপকারী। এ ছাড়া ডালিম প্লাটিলেট কাউন্ট বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে হলুদ একটি উপকারী খাদ্য উপকরণ। এক গ্লাস দুধের সঙ্গে এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে এটি দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে। মেথি সহজে ঘুমাতে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। এটি অতিমাত্রার জ্বর কমিয়ে আনে, যা ডেঙ্গুর একটি সাধারণ লক্ষণ। তবে মেথি খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কমলা ও অন্যান্য ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল ডেঙ্গু জ্বরে অত্যন্ত উপকারী। কমলায় ভিটামিন-সি ছাড়াও রয়েছে এন্টি এক্সিডেন্ট, যা ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাহায্য করে। ব্রকলি ভিটামিনকে এর একটি চমৎকার উৎস, যা প্লাটিলেট বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। যদি প্লাটিলেট কাউন্ট অতিমাত্রায় কমে যায় তাহলে ডেঙ্গু রোগীর দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ব্রকলি রাখা যেতে পারে।
পালং শাক আয়রন ও ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার; যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া এটি প্লাটিলেট বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ডেঙ্গু জ্বর হলে তৈলাক্ত ও বেশি মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে হালকা তেল মশলায় রান্না করা খাবার খাওয়া উচিৎ। অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার উচ্চ রক্তচাপ ও উচ্চ কোলেস্টেরলের কারণ হতে পারে।
এই সময় শরীরে প্রচুর তরল প্রয়োজন। কিন্তু সেক্ষেত্রে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে যাওয়া ভালো। ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় দ্রুত হৃৎস্পন্দন, ক্লান্তিভাব ও পেশীর ভাঙন সৃষ্টি করে। তাই শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয়ে রিল্যাক্সিং ফ্লুইড খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। আসুন ডেঙ্গু রোগের প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সরকারের পাশাপাশি আমরাও সচেতন হই। আতঙ্ক নয়, সতর্ক হই। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু বিস্তার রোধে কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জন সম্ভব।
এস ডি সুব্রত : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ